মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ

কাজী সামশুর রহমান | রবিবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৭:৪০ পূর্বাহ্ণ

২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জন্য এক গৌরবময় দিন। মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের এই দিনে স্বৈরাচারী সরকারের গুলিতে সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতসহ অনেক শাহাদাত বরণকারী শহীদের প্রতি রইলো অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। আল্লাহ্‌ জাল্লাশানুহু প্রত্যেক নবী-রসূল কে নিজ নিজ মাতৃভাষায় রচিত কিতাব ও ছহিফা প্রদান করে মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা বা অশ্রদ্ধা করা হীনমন্যতার পরিচায়ক। আমাদের অবশ্যই মাতৃভাষার চর্চা ও অনুশীলনে তৎপর থাকা বাঞ্ছনীয়। কবি আবদুল হাকিম বলেছেন-
যে জন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী
সে জন কার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষা আজ অতীব সমাদৃত। ইউনেস্কো এ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের সকল দেশেই সরকারিভাবে এ দিবসটি উদ্‌যাপন করা হয়। অনেক দেশ বাংলা ভাষা শিখতে ও ইতিহাস জানতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বাংলা ভাষাকে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করতে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন মুসলমান শাসকবৃন্দ। বিশ্বের বহু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। সুতরাং বাংলাকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বহুল প্রচলন ও উৎকর্ষ সাধনে তৎপর হওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। পবিত্র ক্বোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে- খালাকাল ইনসানা আল্লামাহুল বাইয়ান: তিনি (আল্লাহ্‌) মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে মনের ভাব প্রকাশ করার শিক্ষা দিয়েছেন। [সূরা আর্‌ রহমান: আয়াত- ৩-৪]
আমি (আল্লাহ্‌) প্রত্যেক রসূলকেই তার কওমের ভাষাভাষি করে প্রেরণ করেছি। [সূরা ইবরাহীম: আয়াত-৪]
আর তাঁর (আল্লাহ্‌র) নির্দেশনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। [সূরা রূম: আয়াত-২২]
ক্বোরআন মজিদের এসব নির্দেশনা মুসলিম মানসে প্রত্যেক জাতির বা সম্প্রদায়ের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান ও মর্যাদাদানের স্পৃহা সৃষ্টি করে এবং ইসলাম যেখানেই গিয়েছে সেখানকার অধিবাসীদের মাতৃভাষাকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছে। বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের পূর্বে এখানকার অধিবাসীদের কথা বলার বুলি খুবই অবহেলিত অবস্থায় ছিল। বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড: দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, ‘মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোন কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীনবেশে পল্লী কুঠিরে বাস করিতেছিল। পণ্ডিতেরা নস্যাদার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত স্লোকের আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং ‘তৈলাধার পাত্র’ কিংবা ‘পাত্রাধার তৈল’, এই লইয়া ঘোর বিবাদে প্রবৃত্ত ছিলেন। ইতরের ভাষা বলিয়া পণ্ডিতেরা দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন। হাঁড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মনেরা যেরূপ দূরে থাকতেন তেমনি সুধি সমাজের নিকটও অপাংক্তেয় ছিল, ঘৃণা, অনাদর আর উপেক্ষার পাত্র ছিল। কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর অপেক্ষায় থাকে, বঙ্গভাষা তেমনি কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছিল। মুসলিম বিজয় বাংলাভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। বঙ্গভাষাকে একরকম মুসলমানদের সৃষ্টি বললেও অত্যুক্তি হবে না।’
[ড: দীনেশ চন্দ্র সেন- বঙ্গভাষার ওপর মুসলমানদের প্রভাব দ্রষ্টব্য]
বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় খোলাফায়ে রাশেদার দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর আমল থেকেই (৬৪০ খ্রিস্টাব্দ)। তারপর থেকে এখানে দলে দলে আরব, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, মিসর, ইয়েমেন, খোরাসান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ইসলাম প্রচারকের আগমন ঘটে। তাঁরা বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরে গিয়ে এদেশের মানুষের ভাষা বাংলা ভাষা রপ্ত করে ইসলাম প্রচার করেন। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে বখতিয়ার খিলজীর বিজয়ের (১২৪১ খ্রিস্টাব্দ) মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। মূলত: তখন হতেই সুলতানী আমলের রাজা-বাদশাহদের আনুকুল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গভাষা শক্তিশালী হয়ে উঠে। ব্রাহ্মনেরা বহুধরনের অপপ্রচার, অপবাদ ও নরক ভোগের কথা বললেও বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তা রুখতে পারেনি মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে। মাতৃভূমি রক্ষার্থে সীমান্ত রক্ষীরা প্রাণ বিসর্জন দিলে যেমন শহীদ বলে খ্যাত হন তেমনি মাতৃভাষার মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মাহুতি দিলেও শহীদ হবেন বৈ কি। মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ বলেও ইসলামে স্বীকৃত রয়েছে। জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষার চর্চা ও ব্যবহার করা প্রত্যেক জাতির জন্য গর্বের বিষয়।
বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার জন্য রাষ্ট্র সংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রকে নির্দেশ দিয়েছে জাতিসংঘ। এ এক মহান প্রাপ্তি। বাঙালির মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা বিশ্ব দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় সমাসীন। বহু দেশ, জাতি, বাংলা ভাষা চর্চা করছে। সাথে সাথে বাংলা ও বাঙালি জাতিসত্ত্বার স্বরূপ উন্মোচনে গবেষণা করছে। মা যেমন সংগ্রাম সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে সন্তানের জন্ম দেয়, তেমনি তার সন্তানরাও মায়ের ভাষার মর্যাদার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন গৌরবান্বিত, বাঙালি পরিচয়ে আমরা গর্বিত। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ বিশ্বের এক নব বিস্ময়। আমরা বাঙালি, আমাদের ভাষা বাংলা আর আমাদের দেশ বাংলাদেশ, একই অংগের ভিন্নরূপ প্রমাণিত। অবিচ্ছেদ্য বাংলা-বাংলাদেশ, এ ভাষাকে লালন করা, চর্চার মাধ্যমে উন্নয়ন সাধিত করা, জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রতিপালন করা এবং কঠিন বাস্তবতা অথচ আমরা কি আশানুরূপভাবে করতে পেরেছি! না পারলে প্রতিবন্ধকতাগুলো অতিক্রম করার ইচ্ছা বা উপায় কি তা অনুবাধন করতে পারি কি? সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে গবেষণার বিকল্প নেই। উচ্চতর শিক্ষার গবেষণালয়ে বাংলার বিস্তার কতটুকু। বিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে বাংলার ব্যবহারে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে আমাদের। সরকারকে গবেষণা কর্মের দিকে গভীর দৃষ্টি দিতে হবে। বিদেশী সাহিত্য বিজ্ঞানসহ প্রকৌশলী জ্ঞানের উন্নয়ন প্রভৃতি ধারণ করতে হবে। বাংলা ভাষার মাধ্যমকে সহজলভ্য করতে হবে। বিদেশী ভাষায় লিখিত উদ্ভাবিত সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা প্রশাখাকে বাংলা ভাষায় আওতাভুক্ত করার নিরন্তর প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। এ জন্য পর্যাপ্ত বাজেট থাকতে হবে, গবেষণা কাজে সবচেয়ে কম বাজেট হচ্ছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
সরকারি প্রণোদনা খুবই অপ্রতুল। গবেষকদের গবেষণা কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালাতে হবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে। সম্প্রতি কোভিড-১৯ মহামারি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে উন্নত রাষ্ট্রগুলো গবেষণা ব্যয়ের হাজার হাজারগুণ বেশি মুনাফা লুঠে নিচ্ছে। আমাদের দেশেও অনেক গবেষক রয়েছেন যারা দেশে-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন তাদের আরো পৃষ্ঠপোষকতা করে দেশে গবেষণা করার সুযোগ সৃষ্টি করার সময় এখনই। আমাদের সরকার এদিকে গভীর দৃষ্টিপাত করবেন আশাকরি। লেখক: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘রাষ্ট্র চলবে বাংলায়, না চলা অন্যায়’
পরবর্তী নিবন্ধবাংলা ভাষা : বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল