এক রতনের যত কথা

চুরিতে বের হয় রাত দুটায়, গ্রিল বেয়ে উঠে যায় ৯ তলায়ও

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

বয়স মাত্র ২৩ বছর। দিনে তার ইয়াবা প্রয়োজন হয় ৬০ থেকে ৭০ টি। দীর্ঘ সময় নিয়ে ইয়াবা সেবনের পর তার ভাষায় সে ‘কেরেক (ক্র্যাক)’ হয়ে যায়। রাত দুইটার দিকে শুরু হয় অভিযান। পাঁচ তলা থেকে ৯ তলা পর্যন্ত সে তরতর করে উঠে যায় গ্রিল বেয়ে। হাত ও পায়ের কারসাজিতে গ্রিল ফাঁক করে ঢুকে পড়ে ভেতরে। নগদ টাকা, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকারসহ যা পায়; নিয়ে নেমে আসে ভোরের আজান দেয়ার আগে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ভোরে তাকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ ব্যাটারি গলিতে একটি চুরির ঘটনায়। পরে তিন দিনের রিমান্ডে আনে। গতকাল ১৯ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনে রতন দাশ নামের এই অপরাধী অকপটে স্বীকার করে তার অপরাধ জীবনের ইতিকথা। কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজাম উদ্দিন আজাদীকে বলেন, আমার চাকরি জীবনে দেখা অন্যতম এক অপরাধী রতন। ছোট থেকে বঞ্চনার স্বীকার হওয়ার পাশাপাশি, মাদকাসক্তি তাকে করে তুলেছে দুর্ধর্ষ। দুই বছর জেল খেটে বের হয়ে দুই সপ্তাহও হয় নি, সে আবারো গ্রেপ্তার হয়েছে কোতোয়ালী পুলিশের হাতে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সে অসংখ্য চুরি করলেও দুইটি মামলা ছাড়া তার বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা হয় নি। এখন ধরা পড়ার খবর শুনে ভুক্তভোগীরা যোগাযোগ করছে থানায়।
অপরাধ জগতে প্রবেশের কারণ প্রসঙ্গে রতন পুলিশকে জানিয়েছে, ‘আমার মা বাবার ঠিক নাই, ভাই বোনের ঠিক নাই, আমার ঠিক নাই। বাবা আরেক মেয়ের পাল্লায় পড়ে মেডিকেল থেকে বাচ্চা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে জেলে ছিল সাত বছর। ওই সময় আমার মা আমরা তিন ভাই দুই বোনকে নিয়ে কষ্টে ছিল। এক ভাইকে এতিমখানায় দিয়ে আসে। এ ভাই না খেতে পেয়ে জন্মানোর কিছুদিন পরেই মারা যায়। এক বোনকে প্রবর্ত্তক বিদ্যাপীঠে দিয়ে দেয়। আরেক বোনকে দেয় এক নার্সের কাছে। আমাকেও চকবাজার একটি বাসায় দিয়ে দেয়। আমি থাকতে চাইতাম না, কাঁদতাম। কিন্তু তাতে মারধর করা হতো। বাবা জেল থেকে বের হয়েও আমাদের দেখতো না। তখন ভাবলাম, এখানে থেকে আর কী হবে, অন্য কোথাও চলে যাই।’ এরপর রতন চকবাজারে একটা জুয়ার বোর্ডে থাকতো আর জুয়া খেলতো, তবে এরই মধ্যেই চলতে থাকে ছোট খাট চুরির ঘটনা।
রতন জানায়, আট বছর বয়সে সে প্রথম চুরি করে লোহা। চুরির জগতে তার বিচরণ দশ বছর ধরে। এর মধ্যে পাঁচ বছর ধরে সে নগরীর বিভিন্ন বাসায় চুরি করেছে অগণিত। তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনাকারী টিমের সাব ইন্সপেক্টর মোমিনুল ইসলাম রতনের বরাত দিয়ে আজাদী বলেন, সর্বোচ্চ নগদ পাঁচ লাখ টাকা চুরি করেছিল সে মিমি সুপার মার্কেটের পাশে একটি অফিস থেকে। বাসা ভেবে ঢুকে দেখে সেটা অফিস। ড্রয়ার খুলে পেয়েছিল পাঁচ লাখ টাকা আর একটি মোবাইল ফোন। এসে রেল স্টেশনে ইয়াবার স্পটে ইয়াবা সেবন করেছিল। স্পটের বস তার থেকে দুই লাখ টাকা জোরপূর্বক রেখে দেয়। ওই স্পটের জনৈক ‘ইলা ভাই’ তাকে শেল্টার দিত জানিয়ে রতন বলে, ইলা ভাইকে একবার পাঁচ লাখ টাকা ধার দিয়েছিলাম। সে ওই টাকা মেরে দেয়। পরে দিয়েছিলাম আরো তিন লাখ টাকা। সেখান থেকে অবশ্য এক লাখ টাকার ইয়াবা খাইয়েছিল আমাকে। ইলা ভাইয়ের পর পুরান রেল স্টেশনের আনোয়ার মামুর (বর্তমানে চোরাই মোবাইল কেনার অপরাধে কারান্তরীণ) শেল্টারে আছি গত আড়াই বছর ধরে।
রতন জানায়, চান্দগাঁওয়ে চুরি করতে গিয়ে একবার জনতা তাকে ধাওয়া দিলে, সে এক বাসার বাথরুমের ওপরে সিলিংয়ে আশ্রয় নেয়। টানা চার দিন সেখানে ছিল। রাতে নেমে রান্নাঘরে রান্না করা খাবার খেয়ে নিত। তারা ভাবতো বিড়ালে খেয়েছে। চার দিন পর সুযোগ বুঝে রাতে পালিয়ে যায় ওই বাসা থেকে।
অভিযান টিমের সদস্য এএসআই অনুপ আজাদীকে জানান, তাকে গ্রেপ্তারের পর আমরা বিভিন্ন বাসায় গেছি তাকে নিয়ে, যেখানে যেখানে সে চুরি করেছে। সে দেখিয়েছে, কীভাবে জানালার গ্রিল বা সিলিং বেয়ে পাঁচ তলা থেকে নয় তলা পর্যন্ত উঠে যায়। কীভাবে মরচে ধরা গ্রিল সজোরে লাথি দিয়ে ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। রাত দুইটার দিকে চুরি করতে যায়, আজানের আগে করে বেরিয়ে আসে।
রতন আরো জানিয়েছে, কাজ হলে সে দিনে ৬০ থেকে ৭০ টা ইয়াবা সেবন করে। কীভাবে সম্ভব জানতে চাইলে বলে, ‘একটা পান্নির (ইয়াবা সেবনে ব্যবহৃত ফয়েল পেপার) মইদ্যে এক লগে ৭/৮ টা ইয়াবা নি টানি’। সে জানায়, ‘ইয়াবা খাইলে চুরি চামারি বেশি করতে মন চায়, ভাত খেতে মন চায় না। এক জায়গায় নীরবে কাম করতে মন চায়, মাল খাইলে ‘কেরেক’ অই যাই গা। তখন খালি কাম করতে মন চায়’।
রতন জানায়, সপ্তাহ দুয়েক আগে সে জেল থেকে বের হয়েছে। বের হওয়ার পর সপ্তাহ খানেক ইয়াবা সেবন করে নি। পরে আবারো ফিরে যায় নেশার জগতে। আর নেশার টাকা যোগাতে শুরু করে চুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজনগণ সোচ্চার হওয়ায় রক্ষা পেল শতবর্ষী পুকুর
পরবর্তী নিবন্ধপাপুলের রায় পর্যালোচনায় সংসদ