সংস্কৃতি একটি জাতির আয়না। সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তা নিজেকেই লালন ও চর্চা করতে হবে। সাংস্কৃতিকভাবে চট্টগ্রামের একটা ঐতিহ্য আছে। যেকোন স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয় চট্টগ্রাম থেকেই। চট্টগ্রামে অনেক বীরপুরুষের জন্ম। তেমনি অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও চট্টগ্রামে জন্ম নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে আলো ছড়িয়েছেন। আর সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সদাজাগ্রত চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি। শিল্পের বিভিন্ন শাখার প্রসার ও বিকাশে সৃজনশীল আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি নিরন্তর কাজ করে চলেছে ১৯৮০ সাল থেকে। শিল্পচর্চার নান্দনিক নগরী হিসেবে চট্টগ্রামকে প্রতিষ্ঠা করাই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য। পাশাপাশি চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটিও নিরলসভাবে করে চলেছে শিল্পকলা একাডেমি। ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির হাজার বছরের শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ, চর্চা, সংরক্ষণ ও প্রচার প্রসারের স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তী সময়ে দেশের ৬৪টি জেলায় সমপ্রসারিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়।
মূলত ১৯৭৩ সালের ২৩ এপ্রিল ফরাসি বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা আঁদ্রে মারলো এই স্থানে তৎকালীন কলা ভবনের উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর, ১৯৭৩ সালে ‘চট্টগ্রাম কলাভবন’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন চিত্রশিল্পী রশিদ চৌধুরী। একই বছর ২৩ এপ্রিল ফরাসি মনীষী আঁদ্রে মারলো বর্তমান শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে কলাভবন উদ্বোধন করেন। চার বছর পর ‘চট্টগ্রাম উৎসব ১৯৭৭’ উদযাপনের উদ্দেশ্যে শিল্প ও সাহিত্য পরিষদের সভাপতি এবং তৎকালীন জেলা প্রশাসক হাসনাত আবদুল হাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রাম কলাভবন নামে একটি অস্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। ১৯৮০ সালে সেখানেই গড়ে ওঠে শিল্পকলা একাডেমি। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্বয়ংক্রিয় নবায়নযোগ্য লীজ হিসাবে প্রদানকৃত একাডেমির বর্তমান স্থানে শিল্পকলা একাডেমি ভবন নির্মাণ করা হয়।
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অধীনে পরিচালিত জেলা শহরগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম ও বৃহৎ চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা, বিকাশ ও প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক অঞ্চল চট্টগ্রামের মানুষের হাজার বছরের জীবনযাপন ও প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা নিজস্ব ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিসহ সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গগুলোকে চর্চা ও পরিবেশনের মাধ্যমে জেলা শিল্পকলা একাডেমি স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা বর্তমান সময়ে চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান মিলনায়তন শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তন। এখানে প্রশিক্ষণ, পরিবেশন ও প্রদর্শনের সুযোগ- সমৃদ্ধ কোলাহলমুক্ত পরিবেশে রয়েছে মূল প্রশাসনিক ও প্রশিক্ষণ ভবন, মিলনায়তন, দৃষ্টিনন্দন স্থায়ী মুক্তমঞ্চ, মহড়া ভবন ও আর্ট গ্যালারিসহ প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। তিনশ আসন বিশিষ্ট এ মিলনায়তনে রয়েছে নিজস্ব আলোক ও শব্দ সরঞ্জাম। এছাড়া তিনতলা বিশিষ্ট আর্ট গ্যালারি ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় চিত্রকলা, আলোকচিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা এবং নীচতলায় রয়েছে যে কোনো কর্মশালা, সেমিনার বা স্বল্প পরিসরে যে কোনো অনুষ্ঠান উপযোগী স্থান। তিন তলার মূল প্রশাসনিক ভবনে আছে অফিস ও প্রশিক্ষণ কক্ষ এবং তার পাশেই রয়েছে ২০০৯ সালে নির্মিত দ্বিতল বিশিষ্ট চার কক্ষের ‘অনিরুদ্ধ মহড়া ভবন’। যে কোনো উন্মুক্ত উৎসব অনুষ্ঠানসহ মুক্ত নাটক, আবৃত্তি, নৃত্য ইত্যাদি আয়োজন ও পরিবেশনের জন্য রয়েছে শিল্পকলা প্রাঙ্গণের দক্ষিণ-পূর্বকোণে ২০১০ সালে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ‘অনিরুদ্ধ মুক্তমঞ্চ’।
উল্লেখ্য ‘অনিরুদ্ধ মহড়া ভবন’ ও ‘অনিরুদ্ধ মুক্তমঞ্চ’ তৎকালীন জেলা প্রশাসক ফরিদ উদ্দিন আহমদের প্রচেষ্টায় ও বিশিষ্ট শিল্পপতি লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়ার আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হয়েছিল। এই মিলনায়তনে চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের বিভিন্ন প্রযোজনা সমূহ নিয়মিতভাবে পরিবেশন ছাড়াও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ও তাদের নানা প্রযোজনা পরিবেশন করে আসছে। এ ছাড়াও মিলনায়তন ও মুক্তমঞ্চকে ঘিরে বিভিন্ন সময়। আয়োজিত হচ্ছে নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব। এছাড়াও এখানে দেশি-বিদেশি নানা মাধ্যমের স্বনামধন্য শিল্পীরাও বিভিন্ন সময় তাদের প্রশংসিত পরিবেশনের মাধ্যমে উৎসব মুখর করে তুলেছে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। বর্তমানে প্রায় ২০টির বেশি নাট্য সংগঠন ছাড়াও বিভিন্ন আবৃত্তি, নৃত্যসহ সংশ্লিষ্ট অনেক সংগঠনের নিয়মিত চর্চা ও পরিবেশনের অন্যতম স্থান চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিশেষ কার্যক্রম হচ্ছে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির অনুষঙ্গ সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, চারুকলা, নাট্যকলা ও তাল যন্ত্র বিষয়ে শুদ্ধ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। নিয়মিত ও পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তরা পরবর্তী সময়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রকে করছে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য চারুকলা, নৃত্যকলা, সংগীত, আবৃত্তি ও তবলা বিষয়ে দুই বছর মেয়াদি ফাউন্ডেশন কোর্স। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে তদুর্ধ্ব বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে চার বছর মেয়াদী সংগীত, নৃত্যকলা, তবলা বিষয়ে কোর্স, ৩ বছর মেয়াদী চারুকলা বিষয়ক কোর্স এবং দুই বছর মেয়াদী আবৃত্তি ও নাট্যকলা বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ কোর্স। প্রায় ২৫০০ শিক্ষার্থীর জন্য এখানে নিয়োজিত স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বরা বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষক হিসেবে উল্লেখিত কোর্সে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য, প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যার দিক থেকেও এটি দেশের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
শিল্প ও শিল্পীর সমাদর ও তাদের কর্মের স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ২০১৩ সাল থেকে আবহমান বাংলার শিল্প সংস্কৃতির বিভিন্ন বিশেষ অবদান রাখা স্থানীয় গুণীজনদের ‘জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা ’ প্রবর্তন করেছে। চট্টগ্রামেও তা অব্যাহত আছে। এছাড়াও জেলা শিল্পকলা একাডেমির বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও চারুকলা প্রদর্শনী ও বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার, কর্মশালা আয়োজন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসসমূহ পালন, বাংলা বর্ষবিদায় ও বরণ অনুষ্ঠান, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, ঋতুভিত্তিক সাংস্কৃতিক উৎসব, আবৃত্তি উৎসব, নাট্য উৎসব, লোক সাংস্কৃতিক উৎসব, চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ সংশ্লিষ্ট নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এর বাইরেও সরকার নির্দেশিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয় জেলা শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে।
সংস্কৃতি বান্ধব চট্টগ্রাম গড়ে তোলা সময়ের চাহিদা। কেউ এককভাবে কোনো কিছুর পরিবর্তন আনতে পারবে না। সবাই মিলে জায়গাটাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। সব জায়গায়ই সংকট রয়েছে। সংকটের মাঝেই কাজ করে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও ছিল বড় অবদান। সাংস্কৃতিক কাজগুলো একটি সংঘবদ্ধ প্রয়াস। তৃণমূল পর্যায়ে সুস্থ সাংস্কৃতিক বিকাশে শিল্পকলা একাডেমির ভ্থমিকা অগ্রগন্য। বর্তমান সময়ে নাট্য ও শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি তার ধারাবাহিক কার্যক্রম ও সংশ্লিষ্ট নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে দেশজ সংস্কৃতির চর্চা , বিকাশ ও প্রচার প্রসারে আরো ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে- এটাই চট্টগ্রমিের সংস্কৃতি কর্মীদের আশাবাদ।
শিল্পকলা একাডেমিতে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জেলা শিল্পকলা একাডেমি চট্টগ্রামের উদ্যোগে আজ ১৯ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় একাডেমি মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান।