বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যার দায়ে পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড ও একজনের যাবজ্জীবন দিয়েছেন আদালত। মঙ্গলবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এ রায় দেন। রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচজনের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে শাহাব, মোজাম্মেল হোসেন ওরফে সাইমুম, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ও আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনান। এছাড়া আসামি শফিউর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন দিয়েছেন আদালত। দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে মেজর জিয়া ও আকরাম পলাতক। বাকি চারজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশের জন্য অভিজিৎ রায়কে নিজের জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে- এমন মন্তব্য করে বিচারক বলছেন, তাঁর বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্যরা তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিচারক বলেন, ‘অভিজিৎ রায় হত্যায় অংশ নেওয়া অভিযুক্ত আসামিরা বেঁচে থাকলে আনসার আল ইসলামের বিচারের বাইরে থাকা সদস্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে এবং বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তমনা লেখকরা স্বাধীনভাবে লিখতে এবং মতামত প্রকাশ করতে সাহস পাবে না। কাজেই ওই আসামিরা কোনো সহানুভূতি পেতে পারে না’। রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেন, ‘অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্য হলো জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ এবং নিরুৎসাহিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশ না করতে পারে।’
অন্যদিকে আসামিদের আইনজীবী এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অসন্তুষ্ট, আসামিদের আপিল করার পরামর্শ দিয়েছি’। তিনি বলেন, ‘সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটা প্রমাণিত হয়নি যে, তারা এবিটির সদস্য বা এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি। এমন একজন সাক্ষীও ছিল না।’ আসামিদের আরেক আইনজীবী এবিএম খায়রুল ইসলাম লিটন বলেন, ‘শুধুমাত্র বিভিন্ন তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষীর ভিত্তিতে তাঁদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।’ তবে রায় প্রসঙ্গে এপিপি জাকির বলেন, ‘আমরা সন্তুষ্ট’। এছাড়া আদালত প্রাঙ্গণে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আবদুল্লাহ আবু সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই দেশে জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদের কোনো জায়গা হবে না, সেই বার্তায়ই দেওয়া হয়েছে এই রায়ের মাধ্যমে।’ তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ দমনের জন্য এই রায়টি অপরিহার্য ছিল। এর ফলে এমন অন্যায় কাজ করতে ভবিষ্যতে কেউ সাহস পাবে না’।
দণ্ডপ্রাপ্ত সোহেলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে আদালতের নথিতে বলা রয়েছে, তাদের সংগঠনের ‘অপস’ শাখার চারজন অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে। তবে আইনজীবী জাকির বলেন, ‘হত্যার দায়ে দণ্ডিত পাঁচজনের মধ্যে আরাফাত অভিজিৎ রায়কে কুপিয়েছিল, বাকিরা জায়গাটা ঘেরাও করে রেখেছিল। মূল পরিকল্পনাকারী জিয়াও সেখানে ছিল।’ বাকি তিনজনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আরাফাতের সাথে আলী ওরফে খলিল, অনিক এবং অন্তু নামের আরও তিনজন অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে বলে জানিয়েছিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। কিন্তু তাদের প্রকৃত নাম-ঠিকানা না পায়নি তারা।’
অভিজিৎ রায়কে হত্যার এ ঘটনা যেমনই নৃশংস, তেমনই বেদনাদায়ক। এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানো হয়েছিল সেই সময়ে। অভিজিৎ পেশায় একজন প্রকৌশলী হলেও মুক্তচিন্তার চর্চা করে আসছিলেন। মুক্তমনা ব্লগটির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নানা কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী আগেই তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের খুঁজে পায়নি। আজ এই হত্যাকাণ্ডের রায়ের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হলো যে জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদের কোনো জায়গা এ দেশে হবে না। মানুষ রায়ের দ্রুত বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করে। তবে জঙ্গিবাদীরা যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এই চক্রকে সমূলে উৎপাটন করতে হলে চাই সমাজের সব শুভশক্তির সম্মিলিত উদ্যোগ।