ভালোবাসা হলো এক ধরনের প্রতিজ্ঞা। আর বসন্ত হলো প্রকৃতির বন্দনা। বসন্ত আর ভালোবাসার মিশেলে গতকাল রোববার দিনটি ছিল অনন্য। বসন্তের নির্মলতায় ভালোবাসা হলো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গতকাল ছিল পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস। দিবস দুটিতে উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু ‘ভালোবাসা’।
একটি বাঙালি সংস্কৃতি, অন্যটি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে; একটি প্রকৃতিকে বরণ করার আর অন্যটি আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার দিন। এবার দুই-ই মিলেমিশে একাকার। আর এ কারণে আনন্দও যেন দ্বিগুণ। প্রকৃতির রঙে ভালোবাসাকে রাঙিয়ে তোলার দিন ছিল গতকাল। ভালোবাসায় বসন্তকে বরণ করে নিতে নগরবাসী গতকাল ভিড় করেছিল সিআরবি, পাহাড়তলী আমবাগান শেখ রাসেল পার্ক, থিয়েটার ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন স্থানে। খোঁপায় গাঁদা ফুল গুঁজে, বাসন্তি শাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে যে মেয়েটি একলা প্রহর গুণছিল ভালোবাসার, তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার আগেই মধুর বসন্তের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে প্রিয়তম পুরুষটি কাল বাড়িয়ে দিয়েছিল তার বিশ্বস্ততার হাত।
নগরীতে বসন্ত উৎসবের প্রতিটি স্থানে গতকাল সকাল থেকেই বসেছিল নানা বয়সী মানুষের সম্মিলন। বাংলার চিরায়ত গান, নাচ, আবৃত্তি, কথামালাসহ নানা আয়োজনে শুরু থেকেই মুখর ছিল উৎসব অঙ্গন। ভালোবাসা দিবস সেই আয়োজনে এনে দিয়েছে ভিন্নতা। করোনার কারণে উৎসব অঙ্গনের রূপ এবার কিছুটা ভিন্ন ছিল। সমবেতদের অনেকের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা দেখা গেছে। বিশেষ করে আয়োজকরা সচেতন ছিলেন। সমবেতদের কারও কারও মুখে মাস্ক ছিল, স্যানিটাইজার, মাস্ক বিলিয়েছেন আয়োজকরাও। আবার অনেকের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি।
‘আমি তোমার জন্য ফাগুনে স্লোগানে মিলেমিশে একাকার/ আমি তোমার জন্য চৈতালী সাঁঝে হতে চাই শুধু তোমার।’ শীতের জীর্ণতা সরিয়ে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছিল কাল ঘুমন্ত মন। ‘সে কি আমায় নেবে চিনে, এই নব ফাল্গুনের দিনে?’ এ আশঙ্কাকে মিথ্যে করে দিয়ে পলাশ শিমুলের লালে দুজন হারিয়েছিল দুজনার মাঝে।
বসন্ত বরণে আসা বিভিন্ন বয়সীদের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীই ছিল বেশি। কেউ গলায় ঢোল ঝুলিয়ে আর কেউ হাতে, মুখে রং মেখে মিলিত হয়েছেন বসন্ত বরণের আনন্দে। গায়ে হলুদ আর বাসন্তি রঙের শাড়ি জড়িয়ে হাতে হাত রেখে বসন্তের এই আগমনী দিনে বেরিয়ে পড়েন তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। সবার মুখে বসন্তের জয়গান।
প্রমা আবৃত্তি সংগঠন : বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে সমাজে বিদ্যমান সামপ্রদায়িকতা, কূপমণ্ডূকতা এবং পশ্চাৎপদতা দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বাংলার আবহমান অসামপ্রদায়িক সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ারও আহ্বান জানান তিনি। গতকাল বিকালে নগরীর সিআরবি শিরীষতলা মুক্তমঞ্চে প্রমা আবৃত্তি সংগঠন আয়োজিত বসন্ত উৎসবের কথামালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
নওফেল বলেন, এই বছর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের শতবর্ষ। আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে বসন্তের আগমন বাঙালি জাতির জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনুক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সমৃদ্ধশালী হচ্ছে। আমরা চাই, এই বাংলাদেশ থেকে অসাম্য দূর হোক, মানুষে-মানুষে সমতা আসুক। আমরা চাই, এই বাংলাদেশে মানবিকতার জয় হোক, নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হোক, দুর্নীতি-অনিয়ম-অস্বচ্ছতা সমাজ থেকে ধুয়ে যাক।
তিনি বলেন, এই চট্টগ্রাম শহরে উন্মুক্ত পরিবেশেই সংস্কৃতিকর্মীরা তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করবেন। এই চট্টগ্রাম ছিল সংস্কৃতির লীলাভূমি। করোনার ভ্যাকসিন দেওয়ায় ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশাল কূটনৈতিক বিজয় হচ্ছে, অনেক পশ্চিমা দেশ যেখানে আজও ভ্যাকসিন পায়নি, সেই ভ্যাকসিন আমাদের প্রতিবেশি দেশ, আমাদের বন্ধু দেশ, যে দেশের সাহায্য ছাড়া আমরা স্বাধীন হতে পারতাম না, সেই দেশ ভারতের কাছ থেকে আমরা উপহার পেয়েছি। আরও অনেক ভ্যাকসিন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ক্রয় করা হয়েছে। আমি সবাইকে অনুরোধ করব আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই ভ্যাকসিন নেবেন। আমরা চাই, বাংলাদেশ করোনামুক্ত হোক, আমরা আবারও সুস্থ-সুন্দরভাবে জীবনযাপন শুরু করব।
ভারতের সহকারী হাইকমিশনার অনিন্দ্য ব্যানার্জী বলেন, এবারের বসন্ত অন্যান্য বছরের মতো স্বাভাবিক নয়। সামগ্রিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিরূপ। তবে খুশির খবর হলো, ইতোমধ্যে করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে এবং তা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। আমি বরাবরের মতো বলতে পারি, ভারত সরকার ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিতে বিশ্বাসী। প্রতিবেশী হিসেবে ভারত যে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় তার প্রমাণ হলো ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি ২০ লাখ ভ্যাকসিন সবার আগে বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে। সামনে আরও দেওয়া হবে।
সিটি কর্পোরেশনের সদ্য বিদায়ী প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, বসন্তের আগমনে প্রকৃতি আজ নতুনভাবে সেজেছে। প্রমার আয়োজনে প্রকৃতির নতুন রূপ পূর্ণতা পেয়েছে এই অঙ্গনে।
প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসান বলেন, বসন্ত উৎসব মানুষকে করোনার অস্বস্তির জায়গা থেকে একটা স্বস্তির জায়গায় এনে দাঁড় করাবে, মানুষকে উজ্জীবিত করবে।
প্রমার সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ পালের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য রাখেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান।
বোধন আবৃত্তি পরিষদ : বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রামের আয়োজনে এবারও ‘নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এল প্রাণে’ শিরোনামে টিআইসি প্রাঙ্গণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গতকাল দিনব্যাপী বোধন বসন্ত উৎসব ১৪২৭ উদযাপিত হয়। বোধন ১৫ বছর ধরে বসন্ত উৎসব করছে। বসন্ত আবাহন, আবৃত্তি, সঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত, নৃত্য, শোভাযাত্রা, ঢোলবাদন, বায়োস্কোপ ও পিঠা-পুলির সমারোহে দিনব্যাপী এ উৎসব উদযাপিত হয়।
উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এমপি। শুভেচ্ছা জানান একুশে পদকে ভূষিত নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের যুগ্ম মহাসচিব ডা. উত্তম বড়ুয়া, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু ও চসিক কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মোহাম্মদ বেলাল।
বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি আবদুল হালিম দোভাষের সভাপতিত্বে সঞ্চালনায় ছিলেন বোধনের সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরী। বোধনের সহসভাপতি প্রবীর পালের আবৃত্তি এবং উস্তাদ স্বর্ণময় চক্রবর্তীর পরিচালনায় সদারঙ্গ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিষদের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রভাতী অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। দলীয় সংগীত পরিবেশন করে অভ্যুদয় সঙ্গীত অঙ্গন ও গীতধ্বনি। দলীয় নৃত্য পরিবশন করে ওডিসী অ্যান্ড টেগোর ড্যান্স মুভমেন্ট সেন্টার, নৃত্যম একাডেমি, রুমঝুম নৃত্যকলা একাডেমি, স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল ডান্স, নৃত্য নিকেতন এবং অদিতি সঙ্গীত নিকেতন। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে বোধন আবৃত্তি স্কুল চট্টগ্রাম। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন শ্রাবণী দাশগুপ্ত। একক সংগীত পরিবেশন করেন শ্রেয়সী রায়, শুভ দাশ, দেবলিনা চৌধুরী, নুসরাত রিনি, মধুলিকা মন্ডল ও প্রিয়া ভৌমিক।
বিকেল ৩টায় ঢোলবাদনের সাথে বর্ণাঢ্য বসন্ত বরণ শোভাযাত্রা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে। ভায়োলেনিস্ট চট্টগ্রামের যন্ত্রসংগীতের মাধ্যমে বিকালের অধিবেশনের সূচনা হয়। দলীয় সংগীত পরিবেশন করে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, সঞ্চারী নৃত্যকলা একাডেমী, নটরাজ নৃত্যাঙ্গন একাডেমী, ঘুঙুর নৃত্যকলা একাডেমী। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী এ এস এম এরফান, দুলাল দাশ ও সনজীব বড়ুয়া। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে বোধন আবৃত্তি পরিষদ। একক সংগীত পরিবেশন করেন আরিফা সিদ্দীকা, জলি চৌধুরী, গায়ত্রী চৌধুরী, কিশোরী হৈমন্তী টুম্পা, সাইফুল ইসলাম সাঈফ ও মিতালী রায়। দ্বৈত সংগীত পরিবেশন করেন জয় সেন হিরো ও ববি মনি।
এদিকে বোধন আবৃত্তি পরিষদের অপর একটি অংশ পাহাড়তলী আমবাগান শেখ রাসেল শিশুপার্কে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে। গান, কবিতা, নৃত্য, যন্ত্রানুষঙ্গ ও কথামালায় বসন্তের রঙিন আবহ মুখর হয়ে ওঠে সেখানে। সকালের অধিবেশনের শুরুতে ছিল বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম সহসভাপতি সুবর্ণা চৌধুরীর আবৃত্তি। এরপর একক সংগীত পরিবেশন করেন কান্তা দে ও সুতপা চৌধুরী। নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যরূপ একাডেমী, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, মাধুরী ডান্স একাডেমী, স্কুল অব ওরিয়েন্টাল ডান্স।
কথামালায় ফাগুনের বার্তায় সকালের অধিবেশনে ছিলেন কবি সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন শ্যামল, নাট্যজন সুচরিত দাশ খোকন, কবি জিন্নাহ চৌধুরী ও সংগঠক সাজ্জাদ হোসেন। বসন্ত ও ভালোবাসার কথন আবৃত্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেন আবৃত্তি শিল্পী হাসান জাহাঙ্গীর, তাসকিয়া-তুন-তানিয়া, মাহবুবুর রহমান মাহফুজ ও এহেতাশামুল হক। দলীয় সংগীত পরিবেশনায় বসন্তের আগমনী লু হাওয়া সমবেত কণ্ঠে জানান দেন শিল্পী শ্রেয়সী রায়ের পরিচালনায় অভ্যুদয় সংগীত একাডেমীর শিল্পীরা। একক সংগীতে ছিলেন মাহবুবুর রহমান সাগর, শুভাগত চৌধুরী, তাসনিম যারীন ইসমি, মধুলিকা, পৃথুলা বিশ্বাস ও হিমু দাশ।
উৎসব অঙ্গন থেকে বসন্ত বরণ শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে বিকালের অধিবেশনের সূচনা হয়। বিকালের অধিবেশনে অতিথি ছিলেন সিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক, প্রফেসর ড. গাজী সালাউদ্দিন, কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দীন চৌধুরী, প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ ও সাবেক ছাত্রনেতা শওকত হোসাইন।
কথামালার ফাঁকে গানে গানে বসন্ত বরণ করেন শিল্পী কেশব জিপসী, রিষু তালুকদার, তুলি দাশগুপ্তা, সাদেকুল ইসলাম ছন্দ, বাহার আহম্মেদ, অর্ণব ভট্টাচার্য, চন্দ্রিমা ভৌমিক ও ঋতু সাহা। একক আবৃত্তিতে ছিলেন মিলি চৌধুরী, দেবাশীষ রুদ্র, ইসমাইল চৌধুরী সোহেল, সঞ্জয় পাল, বিপ্লব কুমার শীল, পলি ঘোষ, সাজ্জাদ হোসেন, বীথিকা বসাক ও ঈশা দে। নৃত্যে অংশ নেয় নৃত্য নিকেতন, এবি নৃত্যাঙ্গন ও চিটাগাং ডান্স একাডেমী। যন্ত্রসংগীতে ছিল ভায়োলেনিস্ট চিটাগাং, শোভন দাশ, প্রিয়ম চক্রবর্তী ও আনিস মাহমুদ। দলীয় সংগীতে ছিল ছন্দানন্দ সাংস্কৃতিক পরিষদ এবং বোধন আবৃত্তি পরিষদ।