হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ

শীতে কাবু গোটা ইউরোপ : বরফপ্রেমীদের উৎসব
“শীতের পরশ থেকে থেকে, যায় বুঝি ওই ডেকে ডেকে
সব খোওয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন সকালে”।
সারা রাত ধরে শূন্য থেকে নিঃশব্দে পেজা তুলার মত ধবল তুষার নিচের দিকে ধেয়ে আসছে। বাইরে মাইনাস সাত ডিগ্রি। কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ছে। কিন্তু এইভাবে এক নাগাড়ে বরফ পড়া অনেকদিন ঘটেনি হল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। গত ১০ বছরের তুলনায় হল্যান্ডে রেকর্ড তুষারপাতের ঘটনা ঘটেছে এই সপ্তাহে। এক সময় দেখি চোখ যতটুকু ধায় কেবল ধবধবে সাদা আর সাদা। বাইরে নিয়ন বাতির আলো যেখানে পড়েনি সেখানে এই তুষারের সাদা রং অন্ধকার ভেদ করে এক ধরনের মায়াবী আলোর সৃষ্টি করেছে। দেখতে ভালো লাগে। অপূর্ব সৌন্দর্য্য সে আলোর ছটা। বর্ণনা করি সে সাধ্য নেই। বারান্দার বড় কাঁচের দেয়াল এক সময় সাদা তুষারে ঢেকে যায়। অনেক আগেই গাছগুলো থেকে পাতা ঝরে গেছে। আর গাছগুলোর শুকনো ডালে যেন পরম মমতায় আটকে আছে বরফ। এক সময় শক্ত আকার ধারণ করে সে বরফ। পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘরের দরোজা বরফে শক্ত হয়ে গেছে। একটু টানাটানি করতেই শব্দ করে খুলে যায়। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো ঢেকে গেছে বরফে। কোনটা কার ঠাহর করা মুশকিল। করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। অনেকেই কাজ করছে ঘর থেকে প্রায় বছর ধরে। তারপরও অনেককেই ঘর থেকে বের হতে হয় কাজোপলক্ষ্যে। ট্রাম-বাস চলাচল অনেকটা থেমে আছে কিংবা অনিশ্চিত। কেননা ট্রামের মাথার উপর যে বৈদ্যুতিক তার সেগুলি অনেক স্থানে বরফের কারণে সাময়িকভাবে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। একই দশা ট্রেনেরও। যাদের নিজ গাড়ি নিয়ে বের হতে হয়েছে, তাদের আগ বাড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে বিশেষ ‘এন্টি-ফ্রিজ’ স্প্রে করে উইন্ডস্ক্রীন পরিষ্কার করতে হয়েছে। গাড়ি রাস্তা হয়েছে পিচ্ছিল। কোনভাবে চলাচলের উপযোগী করার জন্যে সরকারিভাবে হাইওয়ে ও প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে রাতভর লবণ ছিটানো হয়েছে, যাতে গাড়িগুলো কিছুটা নিরাপদভাবে চলাচল করতে পারে। সাইকেলের রাস্তাগুলোতেও ছিটানো হয়েছে বরফ। সরকার আগ বাড়িয়ে তুষারপাত মোকাবেলা করার সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। তীব্র শীত ও তুষারপাতের কারণে মধ্য হল্যান্ডসহ ইউরোপের কিছু বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে অনেক স্থানে। সরকার খুব প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে গাড়ি নিয়ে বের হতে নিষেধ করেছে। অন্যদিকে এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পূর্ব ফ্রান্সে প্রায় দুই হাজার গাড়ি হাইওয়েতে আটকা পড়েছে। ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ডের সীমান্তবর্তী এলাকায় ৪০ গাড়িতে থাকা লোকজনকে জরুরি আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জার্মানির কয়েকটি মহাসড়কে বেশ কিছু গাড়ি তুষারে আটকা পড়ে। পরে হাইওয়ে পুলিশ গাড়িতে থাকা লোকজনকে উদ্ধার করে। ডর্টমুন্ড শহরের নিকটবর্তী মহাসড়কে বড় ট্রাক আটকা পড়লে চালকদের কম্বল ও খাদ্য বিতরণ করেছে পুলিশ।
এবারের মত বরফ ও তুষারপাত অনেক বছর ধরে ইউরোপ দেখেনি। তবে বরফের সাথে শীতল বাতাস সাধারণ জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুললেও এমন ভাবার কোন কারণ নেই যে সবাই ঘরে বসে আছে। বরফ-প্রেমীদের জন্যে তো পোয়াবারো। সে যে কেবল ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে তা নয়। শীতের দেশ হল্যান্ড। এমন তুষারের জন্যে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে ডাচরা। দিন কয়েক প্রচণ্ড হারে তুষারপাত হলে খাল, নদী, লেক, জলাশয়গুলির পানি জমে শক্ত হয়ে যায়। সেখানে আয়োজন চলে ‘আইস স্কাটিংয়ের’। ছেলে-মেয়ে বুড়া-বুড়ি সবাই যোগ দেয় তাতে। নদী, খালের জমে যাওয়া পানির উপর দিয়ে হল্যান্ডের অতি জনপ্রিয় একটি খেলা আছে, যার নাম ‘এলফস্টেইডেনতকত’ অর্থাৎ ‘এগারটি নগর ভ্রমণ’। বোঝার সুবিধার জন্যে বলতে হয়- এগারটা নগরের মধ্য দিয়ে যে বহমান খাল আছে, বরফে জমে যাওয়া ঐ খালের উপর দিয়ে স্কেটিং প্রতিযোগিতা। এর মোট দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার। হল্যান্ডের উত্তরে ফ্রিসল্যান্ড প্রদেশে এই খেলার আয়োজন করা হয়। তবে তার জন্যে প্রথম শর্ত হলো, পানির উপর জমা বরফের ঘনত্ব হতে হবে কম করে ১৫ সেন্টিমিটার কিংবা ৬ ইঞ্চি পুরু। যাতে এর উপর দিয়ে স্কেটিং করলে কোথায়ও ভাঙন না ধরে এবং দুর্ঘটনা না ঘটে। বরফের ঘনত্ব নিশ্চিত করার জন্যে রয়েছে নির্দিষ্ট কমিটি। যে হারে দিন কয়েক ধরে বরফ পড়ছে তাতে এখনো ১৫ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি পৌঁছায়নি। তবে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ঠান্ডা বেড়ে গিয়ে মাইনাস ১৭ ডিগ্রিতে পৌঁছার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আবহাওয়াবিদরা ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, আর তাতেই আশান্বিত স্কেটিং-পাগল ডাচরা। যদি তাই হয়, তাহলে হয়তো এই জনপ্রিয় ডাচ শীতকালীন খেলা, ‘এলফস্টেইডেনতকত’ হয়তো এই বছর হবে। স্কেটিং-মোদীরা প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন কবে ১৫ সেন্টিমিটার পুরু হবে বরফের ঘনত্ব। যে ১১টি শহরের মধ্যে দিয়ে প্রতিযোগীরা খালের মধ্যে জমে যাওয়া পানির উপর দিয়ে স্কেটিং করে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবেন তা হলো: লিওয়ার্ডেন, স্নিক, আইলস্ট, স্টোলেন, স্টাভরেন হিন্দেলুপেন, বরককুম, বোলসোয়ার্ড, হারলিঙ্গেফ্রানেকার এবং ডককুম। এই ১১টি শহরের মধ্যে দিয়ে চলা এই স্কেটিং শেষ হবে স্টার্টিং পয়েন্টে অর্থাৎ লিউয়ার্ডেনে ফিরে এসে।
এ কেবল বরফের উপর দিয়ে চলা নয়। এতে যেতে হয় বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে, মাইনাস ১৭/১৮ ডিগ্রী তাপমাত্রার সাথে প্রচন্ড হারে তুষারপাত ও তীব্র বাতাসকে উপেক্ষা করে। তারপরও এতে অংশ নেবার জন্যে নাম লেখায় হাজার হাজার প্রার্থী। ১৯৬৩ সালের ‘এলফস্টেইডেনতকতকে বলা হয় ‘দি হেল অব ৬৩’, এই কারণে সে বছর দশ হাজার অংশগ্রহণকারীর মধ্যে মাত্র ৬৯ জন এই ১১টি শহর স্কেটিং শেষ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেবার পড়েছিল প্রচন্ড ঠান্ডা, তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ১৮ ডিগ্রি এবং ছিল প্রচণ্ড বাতাস ও তুষারপাত। সেবার রেইনার পাপিং বিজয়ী হলেও তিনি ফিনিশ লাইন পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হননি। বরফ এমনভাবে পড়ছিল অনেকে চোখে কিছু দেখতে পারছিলেন না এবং অনেকের হাত-পা ভাঙাসহ চোখের সমস্যা হয়েছে। বৈরী আবহাওয়াকে চ্যালেঞ্জ করে প্রথম যে ডাচ মহিলা ১৯১২ সালে এই প্রতিযোগিতা শেষ করতে পেরেছিলেন তিনি হলেন, ইয়েকে গাস্টরা। তবে তিনি ফিনিশ লাইন তক পৌঁছাতে সক্ষম হননি, কেননা স্নিক পর্যন্ত পৌঁছে দেখা গেল সেখানে বরফ তেমন শক্ত হয়নি। এরপর ১৯১৭ সালে ইয়ানা ফান দের ভেগ হলেন প্রকৃতপক্ষে প্রথম মহিলা যিনি ফিনিশ লাইন পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭৬০ সাল ফ্রিসল্যান্ডে এই খেলার প্রবর্তন ঘটে।
রাজ পরিবারেও এই ১১টি শহরের মধ্যে দিয়ে স্কেটিং খেলা সমানভাবে জনপ্রিয়। বর্তমান ডাচ রাজা উইলিয়াম আলেকজান্ডার ১৯৮৬ সালে (তখন তিনি প্রিন্স) এই ‘এলফস্টেইডেনতকতে’ যোগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। তিনি যোগ দিয়েছিলেন ডব্লিউ এ ফান ব্যুরেন ছদ্মনামে। কেন সে কারণ জানা নেই। নিরাপত্তার কারণে কিনা জানিনে। শীত এলে, বরফে-বরফে যখন গোটা ইউরোপ ঢেকে যায় তখন অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যাণ্ড হয়ে উঠে স্কী খেলার স্বর্গ। প্রতি বছর ডাচ পরিবারের সদস্যরা সেখানে এই খেলা খেলতে ও উপভোগ করতে যান। বর্তমান রাজার ছোটভাই প্রিন্স ফিজো ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রিয়ায় স্কী করতে গিয়ে বরফ-ধ্বসে চাপা পড়ে ‘কমায়’ চলে যান। প্রায় দেড় বছর কমায় থাকার পর তিনি ৪২ বছর বয়সে মারা যান।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েদের ইন্টারনেটে আসক্তি : লাগাম টানা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধমুজিববর্ষের উপহার তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার