আজ বিশ্ব বেতার দিবস। তথ্য সরবরাহ এবং বিস্তৃতির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বিবেচনায় প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের অনেক দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও বিশ্ব বেতার দিবসটি পালিত হচ্ছে। বেতারকে বর্তমান বিশ্বের যোগাযোগের নির্ভরযোগ্য সমাজ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি, নীতি নিয়ম, দুর্যোগ দুর্বিপাক, শিক্ষা সংস্কৃতি, সংবাদ ও বিনোদনের বিশেষ বাহন হিসেবে ধরা হয়।
দুঃসময়ে বেতারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সিডর, আইলা, নার্গিস, মহাসেন, রোয়ানুর মতো বিভিন্ন দুর্যোগের সময় বেতারের কর্মীবাহিনী দুর্যোগকালীন বিরামহীন নিরবচ্ছিন্নভাবে তথ্য প্রদান করে দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত থেকেছে। এখনও বেতারের ওপর নির্ভর করে অগণিত মানুষ। বিশেষ করে দুর্যোগ দুর্বিপাকে যখন অন্য সব মিডিয়াগুলো অকোজে স্থবির স্তব্ধ বন্ধ হয়ে যায় তখনও বেতার সেবা দিয়ে যায় নিরবচ্ছিন্নভাবে। গ্রামের শহরের কৃষক, মজুর, শ্রমিক, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, মেহনতি মানুষগুলো এখনো রেডিওকে তাদের বিনোদনের প্রধান এবং বিশেষ ভরসার মাধ্যম হিসেবে মনে করে। তাছাড়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিনোদন ও তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে সাধারণ মানুষের আচরণগত পরিবর্তনেও বেতার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে গর্বের সাথে। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, আত্মহত্যা, নারী নির্যাতন এসব অনেকাংশে কমেছে বেতারের উদ্বুদ্ধকরণ প্রোগ্রামের মাধ্যমে।
মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট নামে খ্যাত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের এক বলিষ্ঠ প্রচার কাণ্ডারি। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত কালজয়ী কথিকা, সংবাদ, প্রবন্ধ, নাটিকা, রম্যরচনা, গান, সাক্ষাৎকার, ভাষণ ও অনুষ্ঠানগুলো একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে শক্তিশালী সুদৃঢ় করেছে, অন্যদিকে দেশের জনগণকে স্বাধীনতার দিকে অনুপ্রাণিত উজ্জীবিত করেছে প্রতিনিয়ত।
সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করতে বেতার শক্তিশালী হাতিয়ার ও মাধ্যম। এছাড়াও জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ সম্পাদন করা এবং দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেতারের ভূমিকা অনন্য অসাধারণ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বর্তমান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও নতুন তথ্য প্রযুক্তি বেতারকে আরও অমিত সম্ভাবনাময় করে তুলছে চলমান সময়ের প্রেক্ষাপটে।
দেশে সমপ্রতি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সমপ্রচার করছে শহরভিত্তিক বেসরকারি এফএম রেডিও, অনলাইন রেডিও। আর কমিউনিটি রেডিওগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রামবাংলার তৃণমূল কার্যক্রমকে তুলে ধরছে উন্নয়নে, সহমর্মিতায়, সহযোগিতায়, সুন্দরে, সফলতায় আর সমৃদ্ধিতে। সব মিলিয়ে রেডিওর প্রচার কার্যকারিতা দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে দক্ষতা যোগ্যতা আর একনিষ্ঠ শ্রোতাবান্ধব হিসেবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার বেতারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই বলছেন, এখন বেতারকে ইন্টারনেট এবং টেলিভিশনের সাথে টিকে থাকার লড়াই করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বেতার সমপ্রচার জগতে পরিবর্তনের এই সময়টাতে কতটা তাল মেলাতে পারছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তবে বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এই এগুনোর জন্য বেতারের জনপ্রিয়তা বরং বাড়ছে। তথ্য প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে দেশের সবচেয়ে পুরনো এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ বেতার কতটা তাল মেলাতে পারছে, সেই প্রশ্ন নিয়ে তাঁরা ভাবছেন না। তাঁরা বলছেন, তাঁরা পরিস্থিতিটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই পরিকল্পনা করছেন। বলছেন, চ্যালেঞ্জের কারণে প্রতিযোগিতার বিষয় আসছে। সেজন্য আমরা শ্রোতাদের সাথে কথা বলছি। তারা কোন ধরনের অনুষ্ঠান চায়, সে ব্যাপারে আমরা গবেষণাও করছি। জরিপ করছি। শ্রোতাদের মতামত এবং গবেষণার ভিত্তিতেই আমরা অনুষ্ঠান সাজানোর চেষ্টা করছি।
একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রায় দেড় কোটি মানুষ রেডিও শোনে। এর বড় অংশ বাংলাদেশ বেতারের শ্রোতা। তবে এই শ্রোতাদের বেশির ভাগই দুর্গম এবং প্রত্যন্ত এলাকার। বেতার সামাজিক নেটওয়ার্কসহ সব মাধ্যমেই দৃশ্যমান হওয়ায় তাদের জনপ্রিয়তা ১০ শতাংশ বেড়েছে বলে দাবি করেন। আসলে বেতার পুরনো এক গণমাধ্যম। নিত্য নতুন অনুষ্ঠান পরিকল্পনার মাধ্যমে শ্রোতার সংখ্যা ধরে রাখতে হবে। যদিও আমরা জানি, তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রসারের ফলে সমপ্রচার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিযোগিতাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। তবু গ্রামগঞ্জ ও দুর্গম এলাকায় এখনও বেতার তথ্য আদান-প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম হিসেবে নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখেছে।