দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১১:০২ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মন ভরে বেড়ানো বলতে যা বুঝায় ঠিক তাই করছিলাম দিল্লীতে। পুরোপুরি বেড়ানো। নিজের মনের শান্তির জন্য, নিজের তৃপ্তির জন্য একেবারে সর্বাঙ্গিনভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া। ছুটছি একেবারে উড়ু উড়ু মন নিয়ে। পাশে স্ত্রী থাকায় উড়ু উড়ু ভাবটি আরো বেড়েছে। স্ত্রীকে বগলদাবা করে আগেও বিদেশে ঘুরেছি। এই দিল্লী শহরেও ঘুরেছি। কিন্তু এবারকার আবহটা যেন একটু অন্যরকম। প্রতিটি সকাল দেখা দিচ্ছি বেশ জমকালোভাবে। স্ত্রীর হাতের বেড টি কিংবা ধুমায়িত কফিতে সকালে জানালার পর্দা সরছে। হাতের মুঠোতে হাত নিয়ে ঘুরছি দিনভর। কখনো দলবদ্ধভাবে, কখনো শুধু আমরা।
আমরা বেশ বড়সড় একটি গ্রুপ নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়েছিলাম। ইতোমধ্যে অনেকেই দেশে ফিরে গেছেন। আমরা নয়জনের একটি টিম একসাথে রয়ে গেছি। দিল্লীতে আরো দুজন যুক্ত হয়েছেন। এতে করে ‘ওরা এগারজনের’ মতো কিছু না হলেও আমরাও এগারজন দিব্যি আছি। এগারজনের টিমটি দিল্লীতে একই হোটেলে থাকলেও এখন আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে দিল্লী জয় করতে বেরিয়েছি। টিমের অপর সদস্যদের মধ্যে আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক লায়ন এম এ মালেক এবং ম্যাডাম লায়ন কামরুন মালেক দিল্লী শহরের হেথায় হোথায় এত বেশি ঘুরেছেন যে এখানে উনাদের আর তেমন কিছু নাকি দেখার নেই। এতে করে স্যার এবং ম্যাডাম কোন এক শপিং মলে গিয়ে বসে রয়েছেন। কনফিডেন্স সিমেন্টের অন্যতম মালিক লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া এবং সুপ্রভা বৌদি হোটেল থেকেই বের হননি, রুমে রয়েছেন। লায়ন মনজুর আলম মনজু এবং রাশু ভাবী তাদের কন্যা মানারাকে সাথে নিয়ে শপিং মাথায় তুলছেন। আর লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরীও ছুটিয়ে শাড়ি কিনছেন। আমি শপিং এর ধারে কাছে না থেকে যতক্ষণ পারি ঘুরছি, ঘুরে ঘুরে দেখছি। আর আগেই লিখেছি, এবারকার দেখাটা একটু অন্যরকম। অনেকটা হানিমুন মুডে ঘুরে বেড়ানো!!
আমাদের প্রতি পরিবারের জন্য একটি করে সার্বক্ষণিক গাড়ি দেয়া হয়েছে। এতে করে আমাদের ঘোরাঘুরি অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে। সেই সহজ ঘোরাঘুরির আওতায় আমাদেরকে হুমায়নের সমাধি দেখাতে নিয়ে আসা হয়েছে। হুমায়ন’স টম্প নামে পরিচিত মুঘল সম্রাট হুমায়নের এই সমাধি দিল্লীতে হযরত নিজামউদ্দীন আওলিয়া (রহঃ) এর মাজারের সন্নিকটেই অবস্থিত।
আমাদের গেটে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার আগের মতোই নির্দেশনা দিয়ে গেলেন। দেখা শেষ হলেই ফোন করতে বললেন। আমরা গেটে নামলাম। বিশাল লম্বা লাইন ধরে টিকেট কাটছেন মানুষ। নারী পুরুষ আলাদা করে লাইন দেয়া হয়েছে। আমরা দুজন দুই লাইনে দাঁড়ালাম। যার সিরিয়াল আগে আসবে সেই টিকেট কেটে নেবো, অন্যজন লাইন থেকে বেরিয়ে আসবো। তবে এখানেও আমরা বিদেশী! ভারতীয়দের কয়েকগুণ বেশি দামে টিকেট কাটতে হলো।
সুউচ্চ একটি রাজকীয় গেট পার হয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। প্রথম গেটের একটু পরেই দ্বিতীয় গেট। তাও বেশ খান্দানি। এই গেট পার হওয়ার পর চমৎকার একটি চত্বর, উদ্যান। এটিই উপমহাদেশের প্রথম উদ্যান সমাধি। স্বামীর স্মৃতিকে অমলিন করতে সম্রাট হুমায়নের স্ত্রী হামিদা বানু এই সমাধি সৌধ নির্মাণ করেন। স্ত্রীর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে গড়ে তোলা সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি তাজমহলের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লেও স্বামী প্রেমে মশগুল হামিদা বানুর সৃষ্টি তাজমহলের মতো খ্যাতি পায়নি। অথচ দুইটিই সমাধি। দুইটিই নির্মিত হয়েছে যুমনা নদীর তীরে। দুইটির নির্মাণ শৈলীতেও বেশ মিল রয়েছে। তাজমহলের বেশ আগেই ১৫৬২ সালে হুমায়নের সমাধি সৌধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। হুমায়ন মারা যান ১৫৫৬ সালের ২০ জানুয়ারি। তাঁর মৃত্যুর নয় বছর পর ১৫৬৫ সালে সমাধি সৌধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এর নির্মাণকাজ ১৫৭২ সালে সম্পন্ন হয়। সৌধটি নির্মাণ করতে ওই সময় খরচ হয়েছিল ১৫ লক্ষেরও বেশি টাকা। স্বামীর সমাধিকে নান্দনিক করতে খরচে কোন কার্পণ্য করেননি হামিদা বানু। দৃষ্টিনন্দন সমাধি সৌধের নির্মাণকাজ যখন শেষ হয় তখন মসনদে হুমায়ন পুত্র সম্রাট আকবর। সমাধি সৌধ দেখে বেশ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন তিনি। স্বামীর কবরের পাশের একটি কক্ষে রয়েছে হুমায়ন পত্নী হামিদা বেগম বানুর কবরও। পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারাশিকোকেও কবর দেয়া হয় এখানে। হুমায়নের সমাধির ধারে কাছে আরো অনেকগুলো কবর রয়েছে। যেগুলো মুঘল সাম্রাজ্যের বিখ্যাত সব মানুষের কবর বলেও গাইড জানালেন।
মানুষের ক্ষমতা কত ক্ষণস্থায়ী তা-ই ভাবছিলাম। ভাবছিলাম সম্রাট হুমায়নের কথা, শাহজাহানের কথা। বাবর, আকবর কিংবা হতভাগ্য সম্রাট শাহ জাফরের কথা। লালকেল্লায় ঘোরাঘুরি করার পাশাপাশি ইতিহাসের টুকটাক কিছু লেখাপড়া করে সম্রাটদের জীবনী এবং জীবনাচারের অনেককিছুই ভাসছে চোখের সামনে। সম্রাট হুমায়নের বর্ণাঢ্য জীবনও যেন দেখতে পাচ্ছিলাম চোখের সামনে। মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ন। রাজপুত্র ছিলেন তিনি। পিতা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর। এতে করে জন্ম থেকে জৌলুশে থাকা হুমায়ন মাত্র বাইশ বছর বয়সে পিতার মনোনীত উত্তরাধিকারী হিসেবে মসনদে আরোহণ করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন তিনি। মাত্র বাইশ বছরের অনভিজ্ঞ এক যুবক সাম্রাজ্য চালাতে হিমশিম খাওয়ার কথা। তবে তিনি টানা দশ বছর বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন। ১৫৩০ সালের ২৬ ডিসেম্বর অভিষিক্ত হয়ে ১৫৪০ সালের ১৭ মে পর্যন্ত। ওই সময় সৎভাই কামরানে সাথে চরম তিক্ততায় ক্ষমতা হারান তিনি। প্রায় ১৫ বছর পর আবারো ক্ষমতায় আসেন তিনি। দ্বিতীয় দফায় ১৫৫৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে মসনদে বসে মৃত্যুর দিন ১৫৫৬ সালের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন। আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারত নিয়ে গঠিত বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য জুড়েই বাদশা হুমায়নের প্রভাব ছিল অন্যরকম। সেই প্রভাবশালী সম্রাট আজ মাটির নিচে অন্ধকারে! বিশাল ভবন, খোলা চত্বর, উন্মুক্ত আকাশ, চারদিকে অনেক কবর। অন্তরটি হু হু করে ওঠে। হুমায়নের সমাধিসৌধের নকশা করেন পারসিক স্থপতি মিরাক মির্জা গিয়াস। এই নকশার সাথে তাজমহলের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নির্মাণ শৈলীতেও রয়েছে দারুণ মিল। লাল বেলেপাথর দিয়ে হুমায়ুনের সমাধি নির্মাণ করা হয়। এই ধরনের পাথর দিয়ে এর আগে ভারতে এত বড় মাপের আর কোন সমাধি নির্মিত হয়নি। ১৯৯৩ সালে এই সমাধি ক্ষেত্রকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে।
আগেই বলেছি, হুমায়ুনের সমাধিই ভারতের প্রথম উদ্যান সমাধি। এর আগে আর কোন সমাধিকে ঘিরে এমন নান্দনিক উদ্যান গড়ে তোলা হয়নি। দারুন সব আয়োজন সমাধিক্ষেত্র ঘিরে। উদ্যানে হরেক রকমের গাছ। সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। কাটছাঁট করে গাছগুলোতে নান্দনিকতাও আনা হয়েছে। বাগানের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি মাত্র কমলা গাছ। মাঝারী উচ্চতার। সবুজে সবুজে একাকার গাছটিতে ঝুলছে থোকায় থোকায় পাকা কমলা। দুর্বাঘাসের সবুজ ছাদরে আচ্ছাদিত চত্বরে কমলা গাছটিকে অসাধারণ লাগছিল। আমরা দুজনই সবুজ চত্বরে বসে পড়লাম। মাথার উপর ঝুলছে পাকা কমলা। হাত বাড়ালেই নেয়া যাবে। কিন্তু হাত বাড়ালাম না। সবসময় সব জায়গায় হাত বাড়ানো যায়না। স্ত্রীর হাতটি হাতে নিলাম। বুকের ভিতরে কেমন যেন লাগছিল। সব ছেড়ে ছুঁড়ে একদিন এমনি করে চলে যেতে হবে, এত ক্ষমতাও যেখানে অসহায়, সেখানে অতি নগন্য এই আমাদের অস্থিত্বইবা কতটুকু থাকবে! আমাদের চোখের সামনে তখন হুমায়ুনের সমাধির আলীশান ভবন। যেটি ক্ষয়ে যাচ্ছে, কেবলই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘এ চড়াই-উতরাইকে প্রতিদিনই আনন্দচিত্তে আলিঙ্গন করতে হবে’
পরবর্তী নিবন্ধপেঁয়াজ রাজনীতি এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী মৈত্রী অনুসন্ধান