রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল এনএলডি সরকার ও নির্মম মিয়ানমার সেনারা। হাজারো মুসলিম রোহিঙ্গাদের তাজা রক্তে ভেসে উঠেছে আরাকানের রাজপথ, মংডুর গিরিপথ, রাখাইনের সবুজ ভূমি। রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত হত যে সূর্য, তা কিন্তু সেদিন মেলেনি চোখ, আঁধারের পেজা তুলোয় ভর দিয়ে চলেছে আরাকানের আকাশ। করুণ চিৎকারে শব্দময় নিরীহ রোহিঙ্গাদের আপাদমস্তক। নির্বিচারে গোলার আঘাতে জর্জরিত অবুঝ শিশু, গর্ভধারিণী মা ও অশীতিপর বৃদ্ধ। তাদের চিৎকারে কেঁপে উঠেছে শালবন, পত্র-পল্লব, নিরীহ প্রাণীকুল। পাষাণ চরিত্রের স্বৈর সেনাশাসক ও নিষ্ঠুর স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির যৌথ মহড়ায় রক্তের বান ভাসিয়েছে সারা মিয়ানমার। এতেও মন গলেনি তাদের-চিরতরে মূলোৎপাঠন করে পুশ ইন করেছে দামাল সন্তান বাংলার শরীরে। অসহায় মানবেতর জীবনের জয়গান গেয়ে ভিটে-ভূমি ছেড়ে চলে এসেছে ওরা অচিন দেশে। এখানেই শেষ নয়, যেন আকাশের তারাগুলো খসে পড়ছে মাথার উপর, শান্তির বার্তাবাহী বুদ্ধের দর্শনে যেন কষাঘাত করছে নেপিদোর কুলাঙ্গার সন্তানেরা। নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্তে ভিজিয়েছে সারা শরীর-ক্লেদাক্ত পর্যটন যেন থমকে দাঁড়ায়, দুঃখবোধের শরীরে আচমকা দেয় অসম্ভব ঝাঁকুনি। বাংলার শরীরে ঢুকেছে সাড়ে ৭ লাখ নিঃস্ব মানব, যেন কংকালসার ভ্যানগগের শিল্প। ওরা চেঁচিয়ে বলে-বেদনার শিল্প উজাড় করে সেই সত্য বিধানের সত্য কথন, ‘তোমাদের এ কি হয়েছে, তোমরা আল্লাহর পথে সে সব অসহায় নর নারী ও (দুস্থ) শিশু সন্তানদের (বাঁচাবার) জন্যে লড়াই করো না, যারা (এই বলে) ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব, জালেমদের এই জনপদ থেকে তুমি আমাদের বের করে দাও, অতপর তুমি আমাদের জন্যে তোমার কাছ থেকে একজন অভিভাবক বানিয়ে দাও, তোমার কাছ থেকে আমাদের জন্যে একজন সাহায্যকারী বানিয়ে দাও’-সূরা আন নেসা- আয়াত-৭৫। নেপিদোর রাজপথে আঁধারঘেরা ছিল সেদিনের সোমবার। ঝাঁকে ঝাঁকে বর্মী সেনারা টহল দিচ্ছে রাজপথ-যেন স্বৈরতন্ত্রের অশুভ উন্মোচন। স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ এনএলডির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে আটক করা হয়েছে। সেনা প্রধান মিন অং হ্লাইং কে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে জারি করা হয়েছে এক বছরের জরুরি অবস্থা। অর্ধ শতাব্দি ধরে সামরিক শাসন চলা মিনায়মার ২০১৫ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সুবাতাস পেতে শুরু করে। নভেম্বরের নির্বাচনে সেটা কিছুটা ভিত্তি পায়। কিন্তু বিধিবাম, সোমবার সে গণতন্ত্রের বুকে পেরেক মেরে দেয় অশুভ সামরিক শাসন। এটাই হল নিয়তি, এটাই হল বাস্তবতা। অসম পাপের পাহাড়ে নিমজ্জিত পুরো মিয়ানমার। সু চি ও মিন অং- এ দু’য়ে মিলে অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের কবর রচনা করেছিল সে দেশেরই মাটিতে। কিন্তু মহাশক্তিধর আমার আল্লাহতায়ালার কুদরতি খেয়ালে তাদের সে মহাপরিকল্পনা ভেস্তে বসেছে। আর এটাই মজলুম রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক বিজয়। কুকুরে-কুকুরে কামড় খাচ্ছে রাজপথের বুকে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জর্জরিত দু’পক্ষ। এভাবেই নিঃশেষ করে দেবে শান্তির বার্তাবাহী বুদ্ধের সমগ্র শৈল্পিক নিদর্শন। আমার ভাইয়ের বুক খামছে ধরেছে শান্তিতে নোবেল জয়ী সু চি অথচ অশান্তির রোষানলে পড়েছে লাখো মুসলিম বনি আদম। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশটির রাখাইন রাজ্যে তল্লাশি চৌকিতে হামলার জেরে সেখানে অভিযান শুরু করে সেনা প্রধান মিং অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে সাড়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে আসে বাংলাদেশে। রাখাইনের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোয় বর্মি সেনারা গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটায়। রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলাও চলমান রয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও এ নিয়ে মামলার প্রক্রিয়া চলছে। আইসিজেতে গাম্বিয়ার করা মামলায় অং সান সু চি স্বশরীরে হাজির হয়ে রাখাইনে সেনা অভিযানের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন। রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় সেনাবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। আর সেই সেনাবাহিনী গত সোমবার তাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে দিল। এটা হয়তো সম্ভব হয়েছে মজলুম রোহিঙ্গাদের নীরব কান্নার বদৌলতে। ১৫ বছর গৃহবন্দি থাকার পর ২০১০ সালে মুক্ত হয়েছিলেন শান্তিতে নোবেল জয়ী সু চি। ২০১৫ সালে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ নির্বাচন ছিল মিয়ানমারে বিগত ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম ভোট। এতে সূ চির এনএলডি বিপুল জয় পেয়ে ক্ষমতায় আসে কিন্তু সেনাবাহিনী রচিত সংবিধান দেশটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। শেষে স্টেট কাউন্সেলরের পদ সৃষ্টি করে সে পদে আসীন হন সু চি। এর মাধ্যমে দেশটিতে অর্ধশত বছরের সেনা শাসনের অবসান ঘটে। সু চির ব্যাপক জনপ্রিয়তা কখনোও ভালোভাবে নেয়নি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। গত নভেম্বরের নির্বাচনে সু চির দল ৮৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৯৬টি আসনে জয় পায় আর সংসদের ৪৭৬টি আসনের মধ্যে সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি পেয়েছে মাত্র ৩৩টি। এটাই কাল হয়েছে সু চির, কোনমতে মেনে নিতে পারছে না সেনাসমর্থিত দলটি। তারা ভোটে কারচুপির অভিযোগ আনে। মিয়ানমারের সেনাপ্রধান বলেছে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং ভোটার তালিকা যাচাই বাছাই করার পরই কেবল দেশে আবার নির্বাচন হতে পারে। জরুরি অবস্থা চলবে ১ বছর। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মিয়ানমার। ১৯৬২ সালে সেনা অভ্যূত্থানের মাধ্যমে দেশটিতে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। সে সময়ে জাতীয় নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন মিনানমারের স্বাধীনতার প্রতীক অং সান এর মেয়ে অং সান সুচি। এর দু’বছরের মাথায় দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন দেয় সেনা সরকার। এতে সুচির দল ব্যাপক জয় পায়। কিন্তু সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা এ ফলাফল মেনে নিতে পারেননি। সূচী গৃহবন্দি হন, বন্দি অবস্থায় ১৯৯১ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। রোহিঙ্গা নিপীড়নের দায়ে তার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের জন্যে আবেদন করেছিলেন বিশ্বের অন্তত ১০ জন নোবেল জয়ী। তৎমধ্যে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসও ছিলেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া যখন কয়েক ধাপ এগুতে শুরু করেছিল, তখনই এ অবাঞ্ছিত ঘটনা বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছে। কিছুটা হলেও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলছে সেনা নিপীড়নে নিপীড়িত রোহিঙ্গারা। তাদের ভাষ্য, মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী, মহান আল্লাহতায়ালার খেয়ালেই অসম্ভব অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে দেশটি। রোহিঙ্গাদের রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই যেন গৃহযুদ্ধে জড়াতে যাচ্ছে দেশটি।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল