কে বা আঁখি মেলে রে
‘তবে ছবি তুলে রেখেছি লোগোটার, পরে সার্চ করে জেনে নেবো’ যুগলবন্দী উত্তরের পিছু পিছু আসা দীপ্রর ঘোষণায় অভ্র মনে হয় একটু দমে গেল। কারণ তার ছোয়াযন্ত্র আইপডে চার্জ না থাকায়, এ যাত্রা সে ভাইয়ার কাছ থেকে একটু পিছিয়ে গেছে যে। বুঝলাম তাতে আমি বাসে উঠে বসার পরপরই কেন সে চেয়েছিল পাওয়ার ব্যাঙ্ক। যতই আমরা মনে করি না কেন হাতানোযন্ত্রে ওরা সারাক্ষণই বুঝি খেলাধুলা করে, আসলে সে ধারণাটা ঠিক না। খেলাধূলা ছাড়াও যে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ওরা এটা দিয়ে, বোঝা গেল তা। কিন্তু এ মুহূর্তে সে বিষয়ে কথা বাড়ালে অভ্রর জন্য সেটা হয়ে দাঁড়াবে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো। অতএব ও নিয়ে কথা না বাড়িয়ে, দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে বাসটার ভেতরের আগাপাশতলা চোখজরীপ করতে লেগে গেলাম।
কত সিট হবে মোট এ বাসে? হুম তা হবে মনে হয় গোটা পঞ্চাশেক সিট। যার আধাআধি ভর্তি হয়ে গেছে এরই মধ্যে, একটু আগেকার যাত্রিদলটি উঠার পর। বাজে কত এখন? পকেট থেকে ছোঁয়াফোন বের করে সময় দেখলেই হয়, তবে তা করলাম না আলসেমির কারণে। মাঝে মধ্যে এরকম ছোটখাট আলসেমি করতে ভালই লাগে।
আচ্ছা বাস কি সময় হলেই ছাড়বে? নাকি সময়ের আগে ভর্তি হয়ে গেলেও অযথা বসে না থেকে ছেড়ে দেবে? কি নিয়ম এখানকার? কে জানে? চোখজরীপ আর মনকথনের এ পর্যায়ে ড্রাইভিং সিটে বসে কি কারণে যেন পাইলট চাচা পিছু ফিরতেই , চোখে চোখে চোখ পড়তেই, মনে হল নিরবে জিজ্ঞেস করলেন উনি -‘কি মিয়া, হঠাত খাড়াইলা কিয়ের লাইজ্ঞা? কোন সমইস্যা’? না না কিছু না, এমনিতেই খাড়াইছি, হাসিমুখে চাচার কথার নিরব উত্তর দিয়ে বসে পড়লাম ফের সিটে।
বসতে বসতে ভাবলাম বাস ছাড়ার নিয়ম যা ই হোক , বাস ভর্তি হয়ে গেলে কি চায়নিজ যাত্রীরা তাড়া দিবে নাকি যে, ‘দাও পাইলট বাস ছাইড়া। বাস তো গেছে ভইরা; বইসা থাইক্কা আর কি করবা? রাস্তায় নাইমাই তো জ্যামে পড়বা, তাতে তো সময় মতো পৌঁছাইতে পারবাই না, হুদা মিছা দেরি করনের আর কি দরকার?’ অবশ্য দু একজন বাদে সিটে বসে থাকা সবাই দেখলাম যে, নিজ নিজ হাতযন্ত্র নিয়ে এতোটাই মগ্ন, তাতে মনে হয় না যে বাস অনির্দিষ্টকাল ধরেও যদি না ছাড়ে, তবে তাতে কারো কিছু যায় আসবে। যে দু একজন হাতযন্ত্র হাতানো বাদ দিয়ে বসে আছে, তারা আসলে বসে নাই, বাসের সিট যতটা পারা যায় পেছনে হেলিয়ে, আধশোয়া হয়ে দিয়েছে ঘুম। তাদের একজনের দেহভঙ্গি আর আরেকজনের নাসিকাধ্বনি ঘোষণা করছে যে, এ ঘুম নেহাতই চায়নিজ ঘুম না,এক্কেবারে যাকে বলে নাক ডেকে দেয়া বাঙ্গালির ভাতঘুমের মতো ঘুম। ঐ নাক ডেকে ভাতঘুম দেয়া চায়নাম্যানের নাসিকাধ্বনি বাদে বাসের মধ্যে এয়ারকন্ডিশনারের হিটার চলার অত্যন্ত ক্ষীণ একটা শব্দ ছাড়া গোটা বাসই নিঃসীম নীরব।
সিটে বসে ফের নজর ফেললাম জানালার কাচের বাইরে। এক্কেবারে ভাতঘুম না হলেও কেমন যেন একটু ঝিম ঝিম ঘুম ঘুম ভাব লাগছে নিজেরও। জানি না ঐ চায়নাম্যানদের ঘুমের আছর আমার উপর পড়লো কি না। নাকি প্লেন থেকে নেমে হোটেলে যাবার তাড়ায় স্নায়ুতন্ত্র এতোক্ষণ উত্তেজিত থাকার পর এখন বাসে উঠে সব কিছুর ব্যাপারে আশ্বস্ত হয়ে পড়াতে ঐটি ঝিমিয়ে পড়েছে, সেজন্য এরকম ঘুম ঘুম লাগছে। ঘুম ঘুম লাগুক আর যা ই লাগুক এখন ঘুমানোর কোনই ইচ্ছা নেই, কারণ তাতে যেতে যেতে জানালা দিয়ে আমার চায়না দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হবে, যা আমি মোটেও চাই না।
বাইরে তাকিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই একঘেয়ে লেগে উঠলো, কারণ যেদিকটায় বসেছি তার জানালা থেকে বাইরে তাকালে চোখ ধাক্কা খায় ঐ আগমনী লাউঞ্জের দেয়ালে বা দরজায়, যার ভেতর থেকে বেড়িয়েছি কিছুক্ষন আগেই, অতএব বাসের সিটের আইলের ওপারের সিটলাগোয়া জানালায় চোখ রাখলাম। মলিন ধোঁয়াশা মাখা বাতাসের আধো অস্পষ্টতা পেরিয়ে চোখে পড়লো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একই রকম আরকেটা বাস। তার পর পর আরো ক’টা বাসও দাঁড়িয়ে আছে, বাস স্ট্যান্ডের নিজ নিজ নির্ধারিত জায়গায়। আমাদের বাসটি থেকে সবচেয়ে কাছের বাসটির মাথার উপরে থাকা লাইটপোস্টের বাল্ব এসময় জ্বলে উঠতেই চোখে পড়লো ঘোলাটে আলো। একই সময় সম্ভবত বাকি লাইট পোস্টের বাল্বও জ্বলে উঠেছে নিশ্চয়। কারণ চোখের সামনে ডানে বাঁয়ে, আরও কটা ওরকম ঘোলাটে আলো দেখতে পেলাম। বাস স্ট্যান্ডে তেমন হৈ চৈ ভিড় নেই, যেমন থাকে আমাদের দেশে। অবশ্য সেই প্রথম যখন না বুঝে হিমসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তড়িঘড়ি ফিরে গিয়েছিলাম পুত্রদের বগলদাবা করে লাউঞ্জের ভেতরে; তখনো তেমন কোন ভিড়ভাট্টা দেখিনি মনে পড়লো। বরং এখনই মাঝে মধ্যেই দুএকজন যাত্রীকে দেখছি ভারী গরম কাপড় পড়ে হয় ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে কিম্বা পিঠেব্যাগ পিঠে নিয়ে যাচ্ছে যার যার বাসের দিকে। এর মধ্যে একজন দেখছি পিঠ ব্যাগের ভারে এক্কেবারে কুঁজো হয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে সেই বাসটির দিকে।
বাসের ভেতরের উষ্ণতায় বসে, বাইরের হিমসাগরে চোখের এরকম টো টো ঘুরে বেড়ানোর যবনিকাপাত হলো এসময়, কারণ ওপাশে দাঁড়িয়েছে আরেকটি বাস,এক্কেবারে আমাদের বাসটির পরের শূন্যস্থানটি পূরণ করেই। অতএব কি আর করা? সেই ঝিম ঝিম ঝিমুনি ভাবকে পাত্তা দিয়ে ভাবলাম মিনিট দশেকের পাওয়ার ন্যাপ নিয়ে নেই। আর বাস ছাড়লে তো টের পাবই, তখন না হয় আবার শুরু করবো চোখভ্রমণ। অতএব মুছলাম চোখ! পাওয়ার ন্যাপ নিতে গিয়ে মনে হয় ভাতহীন পেটে ভাতঘুমই দিয়ে ফেলেছিলাম, না হলে এইমাত্র যখন বাসটি নড়েচড়ে পিছু হাঁটা শুরু করতেই টের পেলাম কেন? আশেপাশের সামনে পেছনে পাশের সব সিটেই তো লোকজন বসে আছে দেখছি! তার মানে তো হলো যে এর মধ্যে এক বা একাধিকবার বাসের হুসসসসস আর তৎপরবর্তী ঘটাং শব্দসহযোগে বাসের গেট যে খুলেছিল নিশ্চয়। কিন্তু কানে ঢোকেনি কেন তা? নাহ আসলে কানে ঢুকেছিল, কিন্তু মস্তিস্ক ঐ শব্দকে আমলে নেয়নি বা পাত্তা দেয়নি মোটেই।
অবশ্য এখনো যে খুব একটা পাত্তা দিতে চাচ্ছে বাসের এই নড়াচড়াকে তাও না । বরং গল্পের সেই অলসশিরোমনির মতো বলছে কেউ মনে মনে, চলছে বাস চলুকরে, ‘কে বা আঁখি মেলে রে’! বাইরের উদ্দীপনা আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহকে যেভাবেই উদ্দীপ্ত করুক না কেন, ইন্দ্রিয় দিয়ে আহরিত আমাদের অভিজ্ঞান, যুক্তি যাই বলুক না কেন, মাঝে মাঝে মনের ডাক শুনতে হয়, এমুহূর্তে ওইরকম আইনের শরণ নিয়ে, ফের তাই চোখ বুঝে গা এলিয়ে দিলাম সিটে; এই ভেবে যে এই এয়ারপোর্ট এলাকা পার হয়ে উঠুক না আগে গাড়ি সদর রাস্তায়, তারপর না হয় দেখা যাবে আশপাশ নয়ন মেলে। যদিও এরকম শেষ বিকেলের এরকম মন খারাপ করা ধোঁয়াশার অন্ধকারে, কতোটাই বা দেখা যাবে আশেপাশে? আর হাইওয়ের পাশে তো ল্যাম্পপোস্টও তো থাকার কথা না। আর থাকলেই বা কি, এখানেই যে রকম তেজ দেখছি ঐসব বাতির, তাতে তেমন কিছু দৃশ্যমান হওয়ার তো কথা না। এসব ভাবতে ভাবতে একটু আগেকার গভীর ঘুমটির লেজ ধরে আবারো তলিয়ে যেতে চাইলাম ঘুমের গভীরেই।
আশেপাশের সবকিছুর ব্যাপারে মোটামুটি সজাগ থেকে এভাবে কতোক্ষণ ঝিমুলাম, কে বা আখি মেলেরে নিয়মে, তা জানি না। এমুহূর্তে যখন মনে হলো হঠাৎ শরীরের উর্ধ্বাংশ সিটচ্যুত হয়ে যাচ্ছে ধড়মড় করে উঠে পড়িমরি করে সিটে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতেই বুঝলাম, এ মুহূর্তে ছুটছে বাস বেশ ভাল গতিতে। পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনেই বাসের এই হঠাৎ সরণ বৃদ্ধিতেই, শরীরে ঐ অনুভূতি হয়েছিল। জানালার বাইরে চোখ ফেলে দেখলাম যা ভেবেছি তাই, তেমন কিছু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, বাইরের ধোঁয়াশার জন্য। অবশ্য বেশ চওড়া রাস্তার পাশে ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভুতুরে গাছগুলো ছাড়া দর্শনীয় আর কিছু আছে এ এলাকায় তা মনে হলো না। অতএব আবারো মানলাম সেই সূত্র মানে ‘কে বা আঁখি মেলেরে’।
নাহ হলো না। যতই ভাবি চোখ খুলবো না, ততই বারবারই পিটপিট করে চোখ খুলে জানালার বাইরে চোখ ফেলে ফের চোখ বন্ধ করতে থাকলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ করতে হল না অমন, কারণ অচিরেই দেখা মিলে গেল, বেইজিং এর বিখ্যাত সান্ধ্যকালিন জ্যামের। অতএব দাঁড়িয়ে গেল বাসঠায়, রাস্তায়। প্রমাদ গুনলাম মনে মনে, কারণ বেইজিং এর হাইওয়েতে ১০০ কিলোমিটার লম্বা জ্যাম লাগার রেকর্ড আছে; যে জ্যাম ছুটতে নাকি লেগেছিল পাক্কা দশদিন! অবশ্য সেই জ্যাম এই হাইওয়েতে লেগেছিল না কি, অন্য কোন হাইওয়েতে লেগেছিল তা তো জানি না নিশ্চিত। কথাটা মনে হতেই, ঘাবড়ে গেলাম মনে মনে।
সাথে সাথেই ফের মনে হলো সেই কথাটা, আচ্ছা সারাক্ষণ যে আমাদের লোকজন ঢাকার জ্যামকে কেন্দ্র করে সরকার থেকে শুরু এক্কেবারে বাঙালি জাতিকে শাপশাপান্ত করছে, তাদের অনেকেই তো আজকাল আসছে বেইজিং এ ব্যবসায়িক কারণে। কই তাদের তো কখনোই শুনিনি ওইরকম কিছু বলতে। বাঙালি না হয় বুঝলাম লম্বা সময়ের পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ নানা কারণে, যার একটি হল রাজনৈতিক অস্থিরতা। সেই ১৯৮৯ এক তিয়েন আন মেন স্কয়ারের সরকার বিরোধীগণ জমায়েত বাদে, গত পঞ্চাশ বছরে এখানে তো রাজনৈতিক কোন অস্থিরতার কথা শোনা যায় নি। তাহলে সে দেশে লম্বা সময়ের পরিকল্পনা করে, তা বাস্তবায়নের পথে তো কোন কাঁটা নেই। আমাদের দেশে না হয়, যে কোনভাবেই সরকার বদল হোক না কেন, নতুন সরকার এসে প্রথম যে কাজটি করে তা হল পূর্ববর্তী সরকারের যাবতীয় কিছুকে বাতিল ঘোষণা করা। অতঃপর শুরু হয় নতুন পরিকল্পনা। আর সেইসব পরিকল্পনার পেছনে যতো না থাকে দেশের ভবিষ্যৎ ভাবনা, তার চেয়ে বেশী থাকে লুটপাট করে নিজের পকেট ভারী করার দুরভিসন্ধি। তদুপরি থাকে নানান শক্তিধর নানান বিদেশী দেশের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক স্বার্থের ধান্দাবাজি। চায়নার তো ওসবের বালাই নেই, অন্তত কোন শক্তিধর দেশের সরাসরি বা গোপনে চোখ রাঙানোকে তার পাত্তা দিতে তো হয় না। বরং বেশ কিছুকাল তো সে বলছে কথা যে কোন শক্তিধরের চোখে চোখ রেখেই।
আর দুর্নীতির ব্যাপারে কমিউনিস্টরা যে এক্কেবারে ধোয়া তুলসি পাতা না, তার প্রমাণ তো পাওয়া যায় অহরহই পত্র পত্রিকায়। ৯০ এর দশকে যখন গর্ভাচেভ কাণ্ডের পর একে একে ভেঙ্গে পড়ছিল যখন সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের রাজনৈতিক আর সামাজিক ব্যবস্থাসমূহ, ঐ সময় তো পত্রিকা সমূহ ভর্তি থাকতো ইউরোপের এক সময়ের সমাজতান্ত্রিক দেশ সমূহের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রপ্রধানদের, একেকজনের দুর্নীতির নানান খতিয়ানে? যা পড়তে পড়তে তখন তুমুল আহত হতাম স্বপ্নভঙ্গের হতশায়। তবে সবচেয়ে বেশী দুঃখ পেয়েছিলাম মনে আছে, যখন পড়েছিলাম পত্রিকায়; যে ছিল একসময় আমার কিশোর নাকি বালকবয়সী হৃদয়মুচড়ে দেয়া নায়িকা, সাত সমুদ্দুর তের নদীপাড়ের সেই রাজকন্যার, নিজ দেশ ত্যাগ করে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর ঘটনায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক