ছিল সরকারি পুকুর। ইজারা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ভরাট করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে রিকশা ও টেক্সির গ্যারেজ। সরকারকে নামমাত্র ইজারা ফি দিলেও এসব গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর নামে এক ব্যক্তি।
পুকুর ভরাটের মাধ্যমে পরিবেশ প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করার অপরাধে ২০১৪ সালে দায়ের করা একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি অভিযোগপত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়। তবে মামলা দায়েরের সময় ৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ পুকুরটির তিন চতুর্থাংশ ভরাট করা হয়। তদন্তকালের দীর্ঘ ৭ বছরে ভরাট হয়েছে পুরোটাই। এখন পুকুরের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটি ইজারা দিয়েছিল জেলা প্রশাসন।
জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ সরকারি একটি পুকুর ভরাটের সময় ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে সদরঘাট থানা পুলিশ। ওইদিন পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিদর্শক মো. আজাহারুল ইসলাম বাদী হয়ে সদরঘাট থানায় মামলা (পরিবেশ মামলা নং : ১২/২০১৪) দায়ের করেন। প্রায় ৭ বছর তদন্ত শেষে ওই মামলায় একমাত্র আসামি হিসেবে সদরঘাট এলাকার জুঁই কমিউনিটি সেন্টারের মালিক মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর প্রকাশ মহিউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের তদন্ত কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. সাখাওয়াত হোসাইন আজাদীকে বলেন, মামলাটি ২০১৪ সালের হলেও আমি ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর তদন্তভার পেয়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে অভিযোগপত্র দিতে সক্ষম হই। তিনি বলেন, সদরঘাট এলাকার জুঁই কমিউনিটি সেন্টারের মালিক সরকারি পুকুর শ্রেণীর ভূমিটি ইজারা নিয়ে ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করেছেন। ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ পুকুরটি ভরাটের সময় হাতেনাতে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে সদরঘাট থানা পুলিশ। মূলত এই মামলার অভিযোগপত্রে পাওয়া একমাত্র আসামি মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীরের নির্দেশে দৈনিক মজুরির চুক্তিতে তারা পুকুরটির ভরাট কাজে নিয়োজিত ছিল। মামলা দায়েরের সময় পুকুরটির চার ভাগের তিন ভাগ ভরাট করে পানি ব্যবহারের অনুপযোগী করে ফেলা হয়েছিল।
মামলার অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নগরীর সদরঘাট থানাধীন (সাবেক ডবলমুরিং) মাদারবাড়ী মৌজার পুকুর শ্রেণীর জমিটি ১৯৮০-৮১ সাল থেকে ইজারাগ্রহীতা মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর। ০.২৮৫৯ একর আয়তনের মধ্যে ওই পুকুরে তার ইজারার অংশ ০.০৬৫৬ একর। এটি ইজারাগ্রহীতা ভরাট করেছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে উক্ত ভূমি ব্যবসায়িক কাজে (সিএনজি ও টেঙির ওয়ার্কশপ নির্মাণ এবং কাঁচা-পাকা বাড়ি নির্মাণ করে শ্রমিকদের আবাসন) ব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
গতকাল বিকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই স্থানে উঁচু করে সেমিপাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এক পাশে তৈরি হয়েছে শ্রমিকদের বাসা। অন্য দুদিকে সিএনজি টেঙির গ্যারেজ। সেমিপাকা স্থাপনার বাইরে বাঁশের ঘেরা দিয়ে করা হয়েছে রিকশা রাখার গ্যারেজ। এই জায়গায় গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ ভাড়া দিয়ে বছরে কয়েক লক্ষ টাকা আয় হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ সময় পাশের ভাঙারি দোকানি মো. সেলিম বলেন, আমি এখানে কাজ করি তিন বছর ধরে। এখানে একটি পুকুর ছিল। তিন বছর আগেই পুকুরটি ভরাট হয়ে গেছে।
ভরাট পুকুরে নির্মিত দ্বিতল সমান সেমিপাকা গ্যারেজের এক প্রান্তে খুঁটির সাথে ঝুলানো একটি নোটিশ। নোটিশে ‘এখানে গাড়ি রাখা হয়, মোবাইল ০১৮৩৭-৭০২১৪৭, ০১৭৯৯-০৫১৫৩১’ লেখা আছে। সিএনজি টেঙির মালিক সেজে গতকাল শনিবার সন্ধ্যার পর ০১৭৯৯০৫১৫৩১ নম্বরে ফোন করে কথা হয় প্রতিবেদকের। একটি টেঙি রাখতে মাসে কত টাকা লাগবে জানতে চাইলে অপর প্রান্তের ব্যক্তি নিজেকে আজম পরিচয় দিয়ে বলেন, আগে আপনি (প্রতিবেদক) আসেন। এসে দেখে যান। সব কথা মোবাইলে বলা যায় না। আসলে ফোন দিয়েন, তারপর কথা হবে।
পরে তিনি বলেন, এখানে কেউ এক হাজার, দেড় হাজার, কেউ দুই হাজার টাকায় গাড়ি রাখে। আপনার (প্রতিবেদকের) কয়টি গাড়ি? আসলে পঞ্চাশ-একশ টাকা এদিক-সেদিক হবে। কোনো সমস্যা হবে না। গ্যারেজে কয়টি গাড়ি রাখা যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক গাড়ি।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মো. নূরুল্লাহ নূরী আজাদীকে বলেন, ২০১৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার সময় চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ে ২৯টি মামলা তদন্তাধীন ছিল। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মামলাগুলো হয়েছে। ইতোমধ্যে নতুনগুলোসহ পুরনো প্রায় ২০টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এখন ৯টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।
তিনি বলেন, মূলত মামলার তদন্তসহ আইনি নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে কর্মকর্তাদের সক্ষমতার অভাব ছিল। এতে মামলার তদন্ত ঢিমেতালে চলেছে। এখন পরিবেশ মামলার তদন্ত নিয়ে আমরা সবাই যত্নবান হয়েছি। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যে কারণে বর্তমানে দ্রুততম সময়ে মামলার তদন্তকার্য সম্পন্ন করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।