খলীফাতুর রাসূল হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র পরিচয়: তাঁর নাম: আবদুল্লাহ, উপনাম: আবু বকর, উপাধি: সিদ্দিক ও আত্বীক। পিতার নাম: ওসমান, কুনিয়াত: আবু কুহাফা, মাতার নাম: উম্মুল খায়র সালমা,তাঁর বংশধারা উপর দিকে সপ্তম পুরুষে গিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হয়েছে। তিনি আমূল ফীল বা হস্তী বছরের প্রায় আড়াই বৎসর পর পবিত্র মক্কা মোকাররমায় জন্মগ্রহণ করেন। (তারিখুল খোলাফা, পৃ: ২১)
সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণ: অনেক সম্মানিত সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈন’র বর্ণনা মতে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মায়মুনা ইবন মিহরানকে কেউ প্রশ্ন করলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছেন নাকি হযরত আলী (রা.)? তখন তিনি উত্তর দিলেন, “আল্লাহর শপথ! আবু বকর পাদ্রী বুহাইরার যুগে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান আনেন। ইবনে আসাকির হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, পূরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন, হযরত আবু বকর (রা.)। এতদসংক্রান্ত সকল মন্তব্যের সমাধানে হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা (র.) বলেন, পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মহিলাদের মধ্যে হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) বালকদের মধ্যে হযরত আলী (রা.) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। (তারিখুল খোলাফা, পৃ:২৬)
হযরত আবু বকর (রা.) সাহাবী হওয়া পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত: হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর মর্যাদা শ্রেষ্ঠত্ব, দানশীলতা ও গুনাবলী বর্ণনায় পবিত্র কুরআনুল করীমে অসংখ্য আয়াতে করীমা নাযিল হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, “যদি তোমরা তাকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর তবে আল্লাহ তো তাকে সাহায্য করেছেন। যখন কাফিররা তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল এবং সে ছিল দুজনের দ্বিতীয় জন। যখন তারা উভয়ে গুহায় ছিল সে তখন তার সঙ্গীকে বলেছিল দু:খিত হয়োনা আল্লাহ তো আমাদের সাথে আছেন। অত:পর আল্লাহ তার উপর প্রশান্তি বর্ষণ করলেন এবং তাকে শক্তিশালী করলেন এমন এক সৈন্যবাহিনী দ্বারা যা তোমরা দেখনি আর কাফেরদের কথাকে পদস্থ করলেন আর আল্লাহর বানীই সর্বপরি এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। (আলকুরআন: সূরা: তাওবা, আয়াত: ৪০)
উপরোক্তে আয়াতে বর্ণিত, “ইয ইয়াকুলু লিসাহিবিহি” আয়াতাংশ দ্বারা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহ তা’আলা আনহু সাহাবা হওয়াটা পবিত্র কুরআনের আয়াতে অকাট্যভাবে প্রমানিত।তাঁরসাহাবী হওয়াকে অস্বীকার করা কুরআন অস্বীকারের নামান্তর। কুরআন পাক অস্বীকার করা কুফরী। অতএব শিয়া রাফেযী সম্প্রদায় যারা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে সাহাবা মানতে অস্বীকার করে তাঁকে গালমন্দ করে তারা নি:সন্দেহে কাফির। এ প্রসঙ্গে হযরত হুসাইন বিন ফযল (রা.)’র মন্তব্য প্রনিধান যোগ্য, তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি বলবে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী ছিলেন না সে কুরআনের অকাট্য প্রমান অস্বীকারের কারণে কাফের। (বাগভী, ম’আলিমুত তানযীল ৪/৪৯)
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.) খোলাফায়ে রাশেদীনের ইমামত ও খিলাফত’র বর্ণনা ও শিয়া রাফেয়ীদের ভ্রান্ত আক্বিদা নিরসনে রচনা করেন “গায়্যাতুত তাহকীক ফী ইমামাতিল আলী ওয়াসসিদ্দিক ও আল কালামুল বাহী ফী তাশবিহীসিদ্দিক বিন্নবীসহ অসংখ্য উল্লেখ যোগ্য গ্রন্থ। (হিজরি: ১২৯৭)
মহান আল্লাহ তা’আলা এ মহান সাহাবী সম্পর্কে আরো এরশাদ করেছেন, “যিনি সত্য এনেছেন এবং যারা সত্যকে সত্যবলে মেনেছে তারাই তো মুত্তাকী।” (আল কুরআন, সূরা: জুমার, আয়াত: ৩৩)
হাদীস শরীফের আলোকে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র মর্যাদা: সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকে স্ব-স্ব স্থানে মর্যাদা সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র। কোনো সাহাবাকে অসম্মান, অপমান, কটুক্তি, সমালোচনা ও দোষক্রটি আলোচনা করা গুনাহের কাজ। স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা তাঁদের উপর সন্তুষ্টির স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁদের ত্যাগ কুরবানী ও বহুমুখী অবদানের নিমিত্তে ইসলামের মর্মবানী ও সুমহান আদর্শ বিশ্বব্যাপী প্রচারিত প্রসারিত। সকল সাহাবাদের মধ্যমনি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ছিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অতীব প্রিয়। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “মানব জাতির মধ্যে ঈমানের সাথে ভালবেসে ও ধনসম্পদ উজাড় করে আমাকে সর্বাধিক সহযোগিতাকারী ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.)। যদি আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকে বন্ধু বানাতাম তাহলে আবু বকরকেই বন্ধু বানাতাম। কিন্তু ইসলামের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কহ যথেষ্ট। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ৩৬৫৪)
নবীজি হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে সম্বোধন করে এরশাদ করেন, হে আবু বকর! শোন আমার উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম তুমিই জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মিশকাত শরীফ, পৃ: ৫৫৬)
নবীজি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)কে এরশাদ করেছেন, “সওর পর্বতের গুহায় তুমি আমার সাথী ছিলে হাউজে কাউসারেও তুমি আমার সাথে থাকবে। (তিরমিযী শরীফ, খন্ড:২, পৃ: ২০৮)
নবীজির অসুস্থবস্থায় নামাযের ইমামতি: হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ছিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। আল্লাহর নবী রোগাক্রান্ত থাকাকালীন তিনিই নবীজির নির্দেশে নামাযের ইমামতি করেন। নবীজি হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)কে বললেন, “আবু বকরকে বলো, তিনি যেন লোকদের নামায পড়ান। (বুখারী শরীফ, খন্ড: ১, পৃ: ৯১, মুসলিম শরীফ, খন্ড: ১, পৃ: ১৭৮)
রাসূলুল্লাহর অন্তিম মূহুর্তে তিনি মসজিদে নববীতে সাতাশ ওয়াক্ত নামাযের ইমামতি করেছিলেন। এ কারণে তিনিই রাসূলুল্লাহর প্রথম উত্তরসূরি এবং প্রথম খলীফাতুল মুসলিমীন।
ইসলাম প্রচারে তাঁর অবদান: হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র ঐকান্তিক প্রচেষ্টার বদৌলতে উল্লেখযোগ্য সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেন। তাঁরা হলেন যথাক্রমে হযরত ওসমান গনি (রা.), হযরত যুবাইর ইবনুল আউয়াম (রা.), হযরত তালহা (রা.), হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.), হযরত ওবায়দা ইবনুল জারবাহ (রা.) প্রমূখ সাহাবাগণ ঈমান গ্রহণ করেন। (তারিখুল খোলাফা, পৃ:৩২)
হিযরতের পর তিনি হযরত বিলাল (রা.) ও উমাইয়া বিন কুহাফাসহ অনেক ক্রীতাদাসকে ক্রয় করে মুক্তিদান করেন।
ধর্মত্যাগী ও ভণ্ডনবীদের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপ: নবীজির ওফাতের পর কিছু লোকেরা ইসলাম ধর্মত্যাগ করল, হযরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাদেরকে মোকাবেলা করেন। ইসলামের বিজয়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। খতমে নবুয়াত ইসলামের মৌলিক বিষয়। আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী হওয়াকে যারা অস্বীকার করবে তাঁরা কাফির।
রাসূলুল্লাহর ওফাতের পর বিভিন্নস্থানে একাধিক ভন্ড নবীর উপদ্রব হয়। আসওয়াদ আনাসী তোলায়হা, মোসায়লামা, সাজা নামী এক মহিলা কুখ্যাত মুরতাদগণ নিজেদেরকে নবী বলে দাবী করে খতমে নবুওয়াতের সুমহান পবিত্র মর্যাদায় কুঠারাঘাত হানে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এসব ভন্ড নবীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাদেরকে নির্মূল, পরাভূত ও প্রতিহত করার জন্য সাহাবাদের মাধ্যমে বিভিন্ন অভিযান প্রেরণ করেন। সকল প্রকার চক্রান্ত মোকাবিলা করে তিনি ইসলামকে কলুষমুক্ত করেন। (তাফসীর মাদারিক, তাফসীরে খাযিন, তাফসীরে মাযহারী, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড: ২, পৃ: ১৮৬)
হাদীস বর্ণনা :তাঁর থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৪২। কম হাদীস বর্ণনার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো:-
১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর কম সময় জীবিত থাকা। ২. খলিফাতুল মুসলেমীন হিসেবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালান অধিক ব্যস্ততা। ৩. অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা।
আমিরুল হুজ্জাজ নিযুক্ত ও ধন সম্পদ উৎসর্গ: নবম হিজরিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে আমিরুল হুজ্জাজ নিযুক্ত করেন। ইসলামের প্রতিটি যুদ্ধে তিনি অংশ গ্রহণ করেন।তাঁর সকল সম্পদ তিনি ইসলামের খিদমতে উৎসর্গ করেন। নবীজি এরশাদ করেছেন , “কোন ব্যক্তির সম্পদ আমাকে এত উপকার করেনি যেটুকু উপকার আবু বকরের সম্পদ দিয়েছে।” (তিরমিযী শরীফ, পৃ: ১১৯)
একদা নবীজি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছেন, হে আবু বকর! তোমার পরিবার পরিজনের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি উত্তর দিলেন তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি। (তারিখুল খোলাফা, পৃ: ৩০)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র খিলাফতের সূচনা ১৩ রবিউল আউয়াল ১১ হিজরি, সমাপ্তি ২২ জমাদিউস সানি ১৩ হিজরি। মেয়াদকাল ২ বৎসর ৩ মাস ৬দিন।
অসুস্থতা ও ইন্তিকাল: ওয়াকিদী ও হাকেম’র বর্ণনা মতে ১৩ হিজরির ৭ জমাদিউস সানি সোমবার তিনি গোসল করলেন, তীব্র ঠান্ডায় জরাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। দীর্ঘ ১৫ দিন অসুস্থ থাকার পর ১৩ হিজরির ২২ জমাদিউস সানি মঙ্গলবার রাত্রে ৬৩ বৎসর বয়সে ইহকাল ত্যাগ করেন। (তারিখুল খোলাফা, পৃ: ১৪৮)
হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র ওসীয়ত মোতাবেক তাঁর গোসল কাফন ও দাফন সম্পন্ন করা হয়। হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)’র হুজরায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। হে আল্লাহ আমাদেরকে এই মহান সাহাবীর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। কুরআনের বরকত ও উপদেশ দ্বারা আমাদের নাজাত দিন। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু, আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।