: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র এবং নির্যাতিতা মা-বোনদের প্রশ্ন।
: আজ থেকে প্রায় ৩৬ বছর আগে চট্টগ্রামে এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। সময়টা ছিলো ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ। যাঁরা প্রতিষ্ঠানের সাথে থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বের করে আনার গবেষণায় নিয়োজিত তাঁরা সবাই ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা ও সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা। প্রকৃত ইতিহাস বের করতে হলে প্রয়োজন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ। গবেষণা কেন্দ্র মূলত এই কাজটিই করছে। আজকের আলোচনার বিষয় গবেষণা কেন্দ্রকে নিয়ে নয়। বরং গবেষণা করতে গিয়ে তথ্য উপাত্ত যা পেয়েছি তাতে করে ৫৫ জন মা-বোনকে খুঁজে পেয়েছিলাম যাঁদের ত্যাগে স্বাধীন বাংলাদেশ। এরা শহর চট্টগ্রামের মা-বোন। একাত্তরের নির্যাতিতা। সমাজ সভ্যতায় আমরা অনেকে পিছিয়ে রয়েছি তাই তাদের ত্যাগের কথাগুলো বলেছি নাম ঠিকানা গোপন করে। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরের প্রাক্কালে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। একজন বোন যখন প্রশ্ন করেছেন, আমারতো কিছুই পাওয়ার নেই। সবই শেষ হয়ে গেছে একাত্তরে কিন্তু দেশটা কি পেয়েছে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছে একাত্তরের বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন সার্বিক সূচকে এগুচ্ছে সত্য কিন্তু একাত্তরের চেতনায় কি আমরা আছি? পাকিস্তানী বাহিনী, তাদের এদেশীয় দোসর আল্ বদর, রাজাকার, আল্ শামস্ বাহিনীর নির্যাতনের শিকার যাঁরা হয়েছেন তাদের সামাজিক মর্যাদা আজো প্রশ্নের মুখোমুখি। যে বোন হারিয়েছিলেন সম্ভ্রম তিনি কি নিজের ইচ্ছায় তা হারিয়েছিলেন? আমরা সমাজের মানুষ কি তাঁদের সম্মান মর্যাদায় গ্রহণ করেছি? তাও না। ফলে বেঁচে যাওয়া এবং মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের উদ্ধার করে পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দিয়েছেন। যন্ত্রণা ও ক্ষোভের বিষয় হচ্ছে অনেক পরিবার তাদের গ্রহণ করেনি। আবার কোন কোন পরিবার নিজেদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করার জন্য লুকিয়ে রেখেছিলেন অন্য কোন ঠিকানায়। ফলে তারা হয়েছিলেন অবহেলার শিকার। রাষ্ট্র যখন তাঁদের বীরাঙ্গনা সম্মান দিলেন তখন তারা সাধারণের নিকট হয়ে পড়লেন আরো অস্পৃশ্য। তাদের দেখলে বা ছায়া মাড়ালে জাত যায় এমন এক অবস্থা।
ত্রিশ লক্ষ শহীদ আমাদের বাংলাদেশ এনে দিয়েছেন। আড়াই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের ত্যাগ ছিলো স্বাধীন দেশের জন্য বড়ো ত্যাগ। আমরা কথায় বলি, লেখায় লিখি এসব ত্যাগের কথা বাস্তবে কি ঐ মা-বোনদের প্রকৃত সম্মান? প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুনেছি একাত্তরের নির্যাতনের শিকার মা-বোনদের নিকট থেকে। আজো এমন অনেকে স্বীকার করতে চাইছেন না সেই নারকীয় দিনগুলোর কথা। কারণ যারা সংসার পেতেছিলেন তারা এখনো আতংকে রয়েছেন যদি সত্য প্রকাশ পায় অথবা স্বামী বা বাবার সংসারে দুর্ভোগ নেমে আসে। তাই বুকের যন্ত্রণা বুকে রেখেই চেপে যাওয়া ভালো নয়কি? কেন চেপে যেতে হচ্ছে,
১. মানুষ নির্যাতিতা মা-বোনদের উদার চিত্তে গ্রহণ করেননি।
২. এমনদের এখনো সমাজের কিছু মানুষ বাঁকা চোখে দেখেন।
৩. রাজনৈতিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকের কথা হলো একাত্তরে যা হারিয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশে এগুলো চর্চায় এনে পরিবারকে নেতিবাচক ধারায় ফেলতে চান না। এমন কথার বাইরে আরতো কিছু নেই। রাষ্ট্র সবই করতে পারে তবে সমাজতো আর রাষ্ট্রের কথায় চলে না। কারণ সমাজ, সমাজযন্ত্র রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থাপনার ঊর্ধ্বে ওঠতে পারছেনা। সমাজ এখন বিচ্ছিন্ন এবং বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে। দল এবং মানুষ, সরকার, রাজনৈতিক দল অনেকে একাত্তরের চেতনায় নেই। একাত্তরের চেতনা এখন শুধু মাত্র স্লোগানে ও লেখার কাগজে। অন্তর শুদ্ধ হয়নি বলে আমরা আত্মশুদ্ধি থেকে অনেক পিছিয়ে। স্বাধীনতার ৫০ বছর সমাগত কিন্তু আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক অবস্থান একাত্তর নিয়ে একটি কমন স্থানে আসতে পারিনি। ফলে একাত্তরের নির্যাতিত মা-বোনরা প্রশ্ন করেছেন ‘আমরাতো নির্যাতনের শিকার হওয়ার ৫০ বছর পূর্ণ করবো ২০২১ খ্রিস্টাব্দে’। আপনারা যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করবেন তখন আমরা কি করবো, ৩০ লক্ষ শহীদ পরিবার কি করবেন? ভেবেছেন একথাগুলো? যখন আকাশে বাজি ফুটবে, অসংখ্যবার তোপধ্বনি করবেন তখন আমাদের হৃদয় কোণে জ্বলবে সেই নির্যাতন শিবিরের কথাগুলো। চোখের জলে হয়তো বলবো এদেশতো আমরাও এনেছি, আমাদের ত্যাগের ফসল এই বাংলাদেশ। যন্ত্রণার মধ্যেও বলবো…আমাদের কথা মনে রেখো শুধু চেতনায়। আমরা দ্বিতীয়বার বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পেয়ে আর সমাজ ও পরিবারের নিকট অপমানিত হতে চাই না।
একাত্তরে চট্টগ্রাম নির্যাতন শিবিরের সংখ্যা অন্তত: ৩৬টির তথ্য গবেষণা কেন্দ্র পেয়েছে। এগুলো শুধু শহর চট্টগ্রামের। এসব নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালনায় থেকেছে ঘাতক বাহিনীর সহযোগী বাঙালি অবাঙালি প্রতিষ্ঠানগুলো। শতশত বাঙালি মা-বোনদের করুণ কান্না এখনো শেষ হয়নি। বেশির ভাগই মারা গেছেন নির্যাতন সইতে না পেরে এবং ব্যবহার অনুপযোগিদের হত্যা করে নদী, সাগর জলে বা বড় বধ্যভূমিতে ফেলে দিয়েছে। শহর চট্টগ্রামে তাঁদের সংখ্যা কতো হবে সে হিসাব সম্ভব হয়নি। তবে এক একটি নির্যাতন কেন্দ্রে প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন মেয়েদের বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে আনা হতো। এই কেন্দ্রগুলো বিলাসী নৌজানেও ছিলো বড় বড় কর্তা ব্যক্তিদের জন্য। এলাকাভিত্তিক তথ্যে কেউ কেউ বলেছেন…আমাদের পাড়ার বিভিন্ন ঘর ঘেরাও করে মেয়েদের তুলে নিয়ে গেছে। তাদের আর খবর পাওয়া যায়নি। এমনকি ভুক্তভোগী পরিবারগুলো লোকলজ্জার ভয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এখানে বলা প্রয়োজন যে, নির্যাতনের শিকার প্রায় সকলে প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন যে তাদের নাম ঠিকানা যেন গোপন রাখি ঈমানের সাথে। শহর এলাকার বাইরে বিভিন্ন থানায় নারী নির্যাতন কেন্দ্র তেমন ছিলো না তবে বাড়িতে হামলা চালিয়ে মা-বোনদের ইজ্জত লুঠে নিয়েছিলো ঘাতকের দল। তাছাড়া স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধী কিছু মানুষ কোন ঘরে মা-বোন আছে বা সুন্দরী নারীদের তথ্য দিয়েছিলো। সে অমানুষ ঘাতক এখনো অনেকে … এবং তারা বিভিন্ন দলে অনুপ্রবেশ করে নিজেরা এখনো খিলখিলিয়ে হাসছে। আর ত্যাগী মা-বোনরা রাগে, ক্ষোভে, দু:খে লুকিয়ে রয়েছেন পর্দার আড়ালে। এখনো তারা ভয়ে রয়েছেন যদি পরিচয় প্রকাশ পায়! এটাই হচ্ছে একাত্তরের মা-বোনদের ট্র্যাজেডি।
: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র চট্টগ্রাম তৃণমূলে কাজ করছে একাত্তরকে জানার এবং আগামিদের জানানোর জন্য। একাজে মানুষের মধ্যে আগ্রহের ঘাটতি দেখছি শুধু রাজনৈতিক কারণে। তবে মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তরকে নিয়ে রাজনৈতিক কৃপণতা দূর হওয়া উচিত। প্রত্যেকের অবদানকে স্বীকার করে সম্মানের মাধ্যমে আনার জন্য নির্যাতনের শিকার মা-বোনরা অধীর আগ্রহী।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।