ইসির বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা শাহাদাতের

‘বাস্তবে ভোটগ্রহণ হয়েছে ৭ শতাংশ’, নির্বাচন বাতিল করার দাবি

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

ইভিএমের প্রিন্টেড ফলাফল দিতে না পারলে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। একইসঙ্গে নির্বাচনের দিন প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় ভোটগ্রহণের পার্সেন্টিজ না জানানো এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের ‘মিথ্যা’ আশ্বাস দেয়ায় আরো দুইটি পৃথক মামলা করারও ঘোষণা দেন তিনি। ডা. শাহাদাত বলেন, ভোট ডাকাতির মহোৎসব হয়েছে। ২০১৫ সালে আমাদের আটজন কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিল। তাদেরসহ ৪১ ওয়ার্ডের কাউকে জিততে দেয়নি। তিনি স্মরণকালের ভোট ডাকাতির এ নির্বাচন বাতিল করার দাবি জানান। গতকাল দুপুরে নাসিমন ভবনস্থ দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এ ঘোষণা দেন। এসময় তিনি ‘অনিয়ম’ হয়েছে দাবি করে গত ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন বাতিল করে পুন:নির্বাচনের দাবি জানান। এতে ইভিএমের প্রিন্টেড ও ছাপানো কাগজে হাতে লেখা ফলাফল সম্বলিত রেজাল্টশিট তুলে ধরে ডা. শাহাদাত বলেন, ‘পাঁচলাইশ তিন নম্বর ওয়ার্ডের মাত্র চারটি সেন্টারে প্রিন্টেড কাগজ দেয়া হয়েছে। বাকিগুলোতে তাদের ছাপানো কাগজে দেয়া হয়েছে। ছাপানো কাগজে তারা ২২ ভোটকে ২২শ করেছে। আবিদা আজাদের (সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী) কথায় সেটা ওঠে এসেছে। প্রিজাইডিং অফিসার যার সত্যতা স্বীকার করেছে। এধরনের একটি ভিডিও সবাই দেখেছেন, সেটা ভাইরাল হয়েছে’।
তিনি বলেন, আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রিন্টেড ফলাফল চাইবো। ২৭ জানুয়ারির ফলাফল দিতে হবে। পরবর্তী তারিখের হলে হবে না। দিতে না পারলে মামলা করবো।
শাহাদাত বলেন, ঘন্টায় ঘন্টায় আমরা ভোটের পার্সেন্টিজ চেয়েছিলাম। আমি নিজে আড়াইটার দিকে ৬০টি কক্ষ ঘুরে রিটার্নিং অফিসারের কাছে গিয়েছিলাম। তখন তার পিএস বলেছিলেন, পার্সেন্টিজ দিতে পারবেন। কিন্তু রিটার্নিং অফিসার জানালেন, পারবেন না। অথচ বোয়ালখালীর (চট্টগ্রাম-৮) ভোটে ঘন্টায় ঘন্টায় পার্সেন্টিজ দিয়েছিল। এখন আমরা প্রতি ঘন্টার পার্সেন্টিজ চেয়ে আবেদন করবো। দিতে না পারলে আরেকটি মামলা করবো। যদি ভৌতিকভাবে দেয় সেটাও আমরা তদন্ত করবো।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছি বেলা ২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ। কিন্ত ভোট দেখানো হয়েছে ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ। দুইঘন্টার মধ্যে এতো ভোট কিভাবে এসেছে? এতে বুঝা যাচ্ছে প্রিজাইডিং অফিসারের ১৫ শতাংশ ভোটদানের ক্ষমতা নৌকার পক্ষে কাজে লাগিয়েছে।

শাহাদাত বলেন, নির্বাচন কমিশন বার বার আশ্বস্ত করেছে ব্যালট প্যানেলের সুরক্ষা দেবে। কিন্তু দিতে না পারায় আমার ভোট নৌকা প্রতীকে দিয়েছে। একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে আমাদের নির্বাচনে এনেছে। নির্বাচনের আগে আমরা বিভিন্ন দাবি দিয়েছিলাম, তারা সেগুলো পূরণের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু পূরণ না করে তারা শেষ পর্যন্ত মিথ্যুকে পরিণত হয়েছে। তারা আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। সেজন্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা দায়ের করবো।
শাহাদাত বলেন, বাস্তবে ভোটগ্রহণ হয়েছে ৭ শতাংশ। ব্যালট প্যানেল সুরক্ষার নামে একজন টেকনিশিয়ান রেখেছে। দিনশেষে এসব টেকনিশয়ান ১৫ শতাংশ ভোট কারচুপি করেছে। অরজিনাল যে ৭ শতাংশ সেখানেও কারচুপি করেছে আমাদের এজেন্ট বের করে দিয়ে। প্রশাসনযন্ত্র ও সন্ত্রাস মিলেমিশে নৌকাকে জয়ী করেছে। তারা নির্বাচনকে নির্যাতন, নিপীড়ন ও অমানবিকতার দিকে নিয়ে গেছে। নির্যাতনে আমাদের আড়াই শতাধিক আহত হয়েছে, ১২শ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং দু্‌ইশ’ জনের বেশি জেলে আছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) মাহবুবের রহমান শামীম, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক এ এম নাজিম উদ্দিন, নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক আবু সুফিয়ান, এস এম সাইফুল আলম, কাউন্সিলর প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম দুলাল ও আবুল হাসেম, বিএনপি নেতা গাজী মোহাম্মদ সিরাজ উল্লাহ, নগর মহিলা দলের সভাপতি মনোয়ারা বেগম মনি।
এতে লিখিত বক্তব্যে ডা. শাহাদাত বলেন, নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রতিটি থানায় বিএনপি নেতাকর্মী ও ধানের শীষের সমর্থক এবং এজেন্টদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশ প্রশাসন নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় গিয়ে এলাকা ছাড়ার হুমকি দিয়েছে। বিনাকারণে গ্রেপ্তার করে ভোটাদের মাঝে আতংক
সৃষ্টি করে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়।
লিখিত বক্তব্যে নির্বাচনের দিনের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, ইভিএমে ভোটের ফলাফল পেতে সনাতন পদ্ধতির চেয়েও বেশি সময় লাগার বিষয়টি রহস্যজনক। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে কিভাবে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা সকাল থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে? বহিরাগতদের অনেকে প্রিজাইডিং অফিসারের সহায়তায় ভোট কেন্দ্রের গোপন কক্ষ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নৌকার ভোট নিশ্চিত করেছে। আইনশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা ভোটারদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার পর ব্যালট প্যানেলে নৌকার প্রতীকে নিজেরাই চাপ দিয়ে দেয়। অনেক থানার ওসি’র নির্দেশে মেয়র প্রার্থীর জন্য রক্ষিত ইভিএম মেশিন কেন্দ্রের গোপন বুথ থেকে বাইরে এনে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করার নজির সৃষ্টি করেছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিধি অনুযায়ী প্রতিটি কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা করার নিয়ম থাকলেও এবার নির্বাচনে তা করা হয়নি। পাঁচলাইশ চালিতাতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ধানের শীষের ১১ জন এজেন্ট কেন্দ্রে অবস্থান নেয়ার পর পুলিশ তাদেরকে ডেকে নিয়ে একটি কক্ষে বাইরে তালা দিয়ে দুপুর ১টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে রাখে। পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান লিটনকে নির্বাচনের আগে থেকে গৃহবন্দী করে রেখেছিল প্রশাসন। ভোটের দিন তার বাসায় হামলা করে তাকে ঘর থেকে বের হতে দেয়নি। পাথরঘাটা ওয়ার্ডের বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী ইসমাইল বালির বাসায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি বর্ষণকারীকে গ্রেপ্তার করেনি। উল্টো ইসমাইল বালিকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
শাহাদাত বলেন, এলাকা ভেদে ভোটের ব্যবধান ছিল অস্বাভাবিক। যেমন কোনো কেন্দ্রে এক শতাংশ এবং আবার কোনো কেন্দ্রে ৯৪ শতাংশ। এমনকি একই ভবনের দুইটি কেন্দ্রের একটিতে ৮৪ অন্যটিতে এক দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট দেখানো হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, কিছুদিন আগে ৪০জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য কমিশনের প্রতি যে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন এবং বিচার দাবি করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকপত্র দিয়েছেন তার যৌক্তিতা আবারো বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিজেরাই প্রমাণ দিয়েছেন। চসিক নির্বাচন হচ্ছে সেইসব বিশিষ্ট নাগরিকদের অভিযোগ এবং নির্বাচন কমিশনের করা সর্বশেষ সংস্করণ।
শাহাদাত বলেন, ভোটের আগের দিন নির্বাচন কমিশন সচিব আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘একটি ভালো নির্বাচন দেখবেন’। ভোট পরবর্তী মূল্যায়নে তিনি বলেছেন, ‘আমরা বলব, ভালো নির্বাচন হয়েছে।’ এটা অবাক করার মতো একটি সংঘাতময়, প্রাণহরণকারী ও রক্তক্ষয়ী নির্বাচন শেষেও কমিশন সচিব বরাবরের মতো তুষ্টির ঢেঁকুর তুলেছেন!

পূর্ববর্তী নিবন্ধছাত্রলীগের শূন্যপদে চট্টগ্রামের তিনজন
পরবর্তী নিবন্ধনতুন ধারার সূচনা করতে চাই : রেজাউল