বাবার নামে সাত খুন মাফ

অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান | রবিবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২১ at ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ

যে সময়ের কথা বলছি তখন আজকের মত স্কুলে স্কুলে সরকারি উদ্যোগে বই বিতরণ করা হতনা। গ্রামের এম.ই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির পড়া শেষ করে চট্টগ্রাম শহরে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। বছরের প্রারম্ভে নতুন বইয়ের তালিকা বিতরণ করা হত ছাত্রদের মাঝে। বই ক্রয়ের ব্যাপারটি অতি আনন্দের মধ্যে কাটত। আমি শহরে নিজে কিছু চিনি না। বাবা ঠিক করলেন তিনি আমাকে বই কিনে দেওয়ার জন্য সঙ্গে যাবেন। দিন তারিখ ঠিক হল, সময় বিকেল বেলা। আমি যথারীতি নির্ধারিত দিনে অর্ধেক দিন স্কুল করে চট্টগ্রামের লাইব্রেরি পাড়া আন্দরকিল্লায় যাব। সেখানে বাবার সঙ্গে জোহরের নামাজ শেষে বই কেনা হবে। বাবা কলেজ (কর্তব্যস্থল) থেকে জামে মসজিদে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। যথানিয়মে দুজনে বই কেনার কাজ শেষ করলাম।
পরদিন। সব বই কেনা শেষ হয়েছে, মনে আনন্দের সীমা নেই। ঝোলাভর্তি বই নিয়ে ক্লাসে ঢুকতে বড় তৃপ্তি পাচ্ছি, আজ কোন স্যারের “বই আনিনি কেন” এরকম বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবেনা। সামনের দিকের সারিতে বসেছি। শহরের স্কুলে নতুন এসেছি মনে হচ্ছেনা। পুরোদস্তুর এখানকার ছাত্র। যথাসময়ে প্রথম পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজল। শ্রেণি শিক্ষক কক্ষে ঢুকলেন। চারদিক দেখে নিয়ে নাম ডাকা শুরু করলেন। রেজিস্টারিতে আমার নাম সবার শেষে। আমি হাজিরা দিয়ে বসতে যাচ্ছি, তিনি আবার আমার নাম ডাকলেন। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বললেন, “তোমাকে সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষে যেতে হবে। পিয়ন এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।” আমি কিছু না বুঝে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বেশি সময় লাগল না, স্যারের পিয়ন এলে শ্রেণি শিক্ষক বললেন, “তুমি কাল দুপুরে স্কুল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে।” আমি কিছু বলার আগেই তিনি পিয়নের দিকে ইঙ্গিত করলেন। সে আমার কাছে এসে সঙ্গে যাবার জন্য হাত বাড়াল। দেখলাম শ্রেণিকক্ষে সব সহপাঠী আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি মন্ত্রচালিতের মত পিয়নকে অনুসরণ করলাম।
সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের এককালের পর্তুগিজ দালান, দ্বিতল বাড়ি। সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষ আমাদের শ্রেণিকক্ষের একই তলায়। কিন্তু, এ দিকটা আমার আগে আসা হয়নি বলে দেয়ালগুলো অনেক পুরু এবং কক্ষগুলোর ছাদ খুব উঁচু মনে হলো। কটি কক্ষ পার হয়েছি মনে নেই। দালানের একদিকের প্রান্তের একটি কক্ষে আমাকে ঠেলে দিয়ে পিয়ন বাইরে থেকে গেল। ভেতরে দৃষ্টি দিতেই দেখলাম দরজার দিকে মুখ করে শশ্রুমণ্ডিত ফেজ টুপি মাথায় সৌম্যমূর্তির একজন সুন্দর মানুষ। সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকে তাঁর দুপাশের আলমারিতে তাকভর্তি বড় বড় বই দেখলাম। উপরের তাকে বিভিন্ন সাইজের বেতও থরে থরে সাজান রয়েছে।
আমাকে তাঁর টেবিলের কাছে ডেকে নিয়ে দাঁড়াতে বললেন। নাম জিজ্ঞাসা করে আসল কথায় এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন আমি কাল পূর্ব অনুমতি ছাড়া বিকালের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম কিনা। গম্ভীর গলায় গুরুজনের মুখে এমন প্রশ্নশুনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। স্কুল পালানোর ব্যাপারটা ইতিপূর্বে গ্রামের স্কুলে সহপাঠীদের দেখে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কিন্তু, তাই বলে আমাকেও এরকম অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হবে এটা কখনও মনে আসেনি। তাছাড়া ক্লাস ফাঁকি দেয়ার ব্যাপারটার সাথেও আমার পরিচয় ছিলনা। প্রশ্নশুনে সম্বিত ফিরে পেতে আমার দেরি হচ্ছিল। আমার হতবিহ্বল অবস্থা দেখে বোধহয় তাঁর অভিযোগের হাঁ সূচক উত্তর পেয়ে যাচ্ছিলেন। দেখলাম তিনি একবার আমার দিকে আবার আলমারির উপরের তাকের দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমার ভয় বেড়ে গেল। আমতা আমতা করে বললাম- স্যার, আমি পালাইনি। তিনি বললেন, চালাকি করবেনা, দুপুর ছুটির পর পঞ্চম পিরিয়ডে তোমার অনুপস্থিতির রেকর্ড কি করে হল তাহলে? উত্তরে আমি সত্য ঘটনাটা বলতে শুরু করেছি। আমাকে বাধা দিয়ে তিনি বললেন, এটা তুমি আগে অনুমতি নিয়েও করতে পারতে। তোমাকে এর নির্ধারিত শাস্তি পেতে হবে। আগে বেতের দৃশ্য দেখেছি, এখন স্যারের মেজাজ দেখলাম। দোয়া ইউনুস মনে পড়ল!
সাহস করে বললাম, স্যার এরকম অসদাচরণ আর করবোনা। আমি এ স্কুলে নতুন, স্কুলের নিয়ম জানিনা। বাবা আগে ঠিক করে রেখেছিলেন দুপুর ছুটির পর আমাকে নতুন বই কিনে দেবেন। আমি বই কিনতে গিয়েছিলাম। উনি আমার বাবা কে, কী করেন, কী তাঁর নাম ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন। নাম শুনে আবার জানতে চাইলেন উনি কী করেন। আমি সব উত্তর ঠিক ঠিক দিলাম। হঠাৎ তাঁর চেহারায় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল। তিনি নিজের আসনে গিয়ে বসে গেলেন। আমি বুঝতে পারলাম তিনি আমার কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। আমাকে অনেকগুলো উপদেশ দিলেন। স্কুলের নিয়মকানুন জেনে নিয়ে চলতে হবে। এখানে কাউকে কোন ব্যাপারে নিয়মের ব্যত্যয় করতে দেয়া হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি।
পরে জেনেছি, স্কুলের সার্বিক শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব সহকারী প্রধান শিক্ষকের উপর ন্যস্ত। এই স্যার সম্পর্কে সহপাঠীদের কাছে অনেক শুনেছি। স্যারের কক্ষ থেকে আমি অক্ষত ফিরেছি এটা দেখে আমার সকল সহপাঠী যারা স্যারের কক্ষে যাবার সময় আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তারা আবার অবাক বিস্ময়ে তাকাল আমার সুস্থ স্বাভাবিক প্রত্যাবর্তন দেখে। ক্লাস শেষে আমাকে তাদের অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল, তবু কিছুতেই তাদের বিস্ময় কাটছিল না। আমি এত ভাগ্যবান, এটা তারা মানতে পারছিল না। নতুন এই সহপাঠীর প্রতি তাদের সহানুভূতি আমাকেও আপ্লুত করেছিল।
জনান্তিকে জানাচ্ছি, এ স্যারের বড়মেয়ে এক সময় আমার ঘরে এসেছিলেন গৃহিণী হয়ে। এখনও টিকে আছেন। নানা ঝামেলায় উভয় বাবাকে স্মরণ করতে হয়, সংসার জীবন নির্ঝঞ্ঝাট রাখার প্রয়োজনে।
লেখক : উপাচার্য, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় নিশান কাপ ক্রিকেটে ফকিরপাড়া চ্যাম্পিয়ন