মাঘ মাসের হিমেল হাওয়া; এর মাঝে জ্যোৎস্না। পাল্টে গেছে ঐতিহাসিক লালদীঘি পার্কের আবহ। লালদীঘিটাও আজ অন্যরকম। হাসছে চাঁদের আলোয়। ইট-পাথরের নগরীতে চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে। নাগরিকের মনের বাঁধও ভেঙেছে। পার্কের গাছগাছালির ভেতর উৎসবে কেউ মনে মনে, কেউবা নিচু স্বরে গাইছেন, আজ জ্যোৎন্সা রাতে সবাই গেছে বনে…
‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।/ ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো।।… এ শহরে চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস আর উছলে পড়া আলো দেখার সুযোগ দিনে দিনে সীমিত হয়ে পড়ছে। প্রতি মুহূর্তে ইট-বালু-সিমেন্ট-লোহার আস্তরণ দিয়ে যেভাবে কংক্রিটের সৌধ গড়ে উঠছে, তাতে হারিয়ে যাচ্ছে নিসর্গ, হারিয়ে যাচ্ছে নীল আকাশ আর জীবনের সারল্য। সেই সঙ্গে কৃত্রিম আলোয় ম্লান হয়ে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার রূপালি আলো। কখন জ্যোৎস্না আসে, কখন চলে যায়, অধিকাংশ নাগরিকই সেটা অনুধাবন করতে পারে না। পারে না বলেই জীবন ক্রমশ নিঃসঙ্গ, বিষণ্ন ও জটিল হয়ে যাচ্ছে। তার প্রভাব পড়েছে সামাজিক জীবনেও। এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। তবুও কেউ কেউ এখনও জ্যোৎস্না ভালোবাসেন। ভেসে যান জ্যোৎস্নায়। তেমন একজন মানুষ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। তার মতো কিছু মানুষ আমাদের ঝিমিয়ে পড়া মনটাকে জাগিয়ে তুলে বলেন, দেখ, ‘আসমান ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে’। সেই ধবল জ্যোৎস্নায় ইচ্ছেমতো অবগাহন করা যায়। চাইলে মন উজাড় করে বিলিয়েও দেওয়া যায়। এমন জ্যোৎস্নায় বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই অনুভব, ‘তোমায় আমি জোছনা দেব/তারার চাদরে জড়িয়ে নেব’।
চসিক প্রশাসকের উদ্যোগে লালদীঘি পার্কে গতকাল শনিবার রাত পৌনে ৮টায় অনুষ্ঠিত হয় জ্যোৎস্না উৎসব। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। খোরশেদ আলম সুজনের সভাপতিত্বে উৎসবে বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালাম।
উৎসবে পূর্ণিমার আলোয় সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি ছিল সঙ্গীতানুষ্ঠান। এতে লোকজ, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি, দেশাত্মবোধক, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতিসহ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন শিল্পীরা।
‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ গানের সাথে মহিলা কলেজ সাংস্কৃতিক দলের সদস্যদের উদ্বোধনী সংগীত দিয়ে সূচনা হয় উৎসবের। এরপর একে একে আজ জ্যোৎন্সা রাতে সবাই গেছে বনে, মাতাল হাওয়াসহ নানা গানে মুগ্ধ করা হয় বিপুল সংখ্যক দর্শক-স্রোতাদের।
অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ছয় বছরে যা হয়নি মাত্র ছয় মাসে তা করে দেখিয়েছেন খোরশেদ আলম সুজন। তিনি আজ জ্যোৎন্সা উৎসবের আয়োজন করে আমাদের চিত্তে দোলা লাগিয়েছেন। তিনি যে সূচনা করলেন নবনির্বাচিত মেয়র তা অনুসরণ করে এই নগরীকে বিত্তের সাথে সাথে চিত্তেও উন্নত করবেন।
খোরশেদ আলম সুজন বলেন, সুপ্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামকে বিশ্ব চেনে। ইবনে বতুতা থেকে সকলে এদেশে এসেছে এই শহর হয়ে। এ শহরের ঋদ্ধ ঐতিহ্য আছে। চিত্তের নয় বিত্তের শহর হোক এ চট্টগ্রাম। রায় বাহাদুর রাজ কুমার ঘোষ এ জমিটি দিয়েছিলেন পার্ক করার জন্য। মেয়র থাকাকালে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এ পার্ক করেছিলেন। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরী চলে যাবার পর অনাদরে-অবহেলায় এই লালদীঘি মুখ থুবড়ে পড়ে। আমি ছয় মাসের জন্য কেন এসেছিলাম জানি না। প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব দিলেন। লালদীঘিকে পুনরুদ্ধার করে সংস্কার করেছি। পাশে আছে লালদীঘি মাঠ, ছয় দফা উত্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। উপমন্ত্রী নওফেল সেটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন। শহীদ মিনার, মুসলিম হল, লাইব্রেরি, মাঠ, পার্ক হয়ে লালদীঘি হবে আমাদের সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি।
তিনি বলেন, আমরা জ্যোৎস্না উৎসবের আয়োজন করেছি। লালদীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা এ শহরের মানুষেরা দেখব অনিন্দ্য জ্যোৎস্না। আমরা চাই এ জ্যোৎস্না সবার অন্তরে অন্তরে গন্ধসুধা ঢালুক।
অনুষ্ঠানে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মোহিত উল আলম, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব প্রফেসর আবদুল আলীম ও বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার নিতাই কুমার ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। সংগীত, নৃত্য এবং আবৃত্তির পাশাপাশি ফানুস ওড়ানোসহ দারুণ সব পরিবেশনায় মুগ্ধ হন কয়েক হাজার দর্শক-স্রোতা।
উপস্থাপিকা কঙ্কন দাশের সঞ্চালনায় কবিতা আবৃত্তি করেন বাচিক শিল্পী মিলি চৌধুরী ও সাবের শাহ। নৃত্য পরিবেশন করে প্রাপন একাডেমি। অনন্য বড়ুয়ার পরিবেশনায় একে একে বেশ কয়েকটি নৃত্য পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে শিল্পী ইকবাল হায়দার, শহীদ ফারুক, বৈশাখী নাথ, মনি সেন ও পাভেল সঙ্গীত পরিবেশন করেন। যাদু প্রদর্শন করেন শিল্পী সুগত।
আগামীকাল সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টায় একই স্থানে অনুষ্ঠিত হবে কবিতা পাঠ ও পিঠা উৎসব। এতে লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন।