মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অভূতপূর্ব নিরাপত্তা চাদরের আড়ালে অবস্থান নিয়ে গত ২০ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ করতে হলো বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চরম দক্ষিণপন্থী, শ্বেতাঙ্গ-বর্ণবাদী, সশস্ত্র, হত্যার নেশায় উন্মত্ত অনুসারীদের বিপজ্জনক হামলার আশংকার পরিপ্রেক্ষিতে। মার্কিন ইতিহাসের একটা চরম রাজনৈতিক বিভেদের ক্রান্তিলগ্নে সেদেশের সর্বাধিক সাড়া-জাগানো রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আট কোটি বার লাখ বিরাশি হাজারের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন জো বাইডেন। এর বিপরীতে পরাজিত প্রার্থী ট্রাম্পও পেয়েছেন সাত কোটি বেয়াল্লিশ লাখের বেশি ভোট। এই দুটো সংখ্যাই মার্কিন নির্বাচনী ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোটের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পপুলার ভোটে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় না তবুও সত্তর লাখের বেশি পপুলার ভোটের ব্যবধানে জো বাইডেনের ঐতিহাসিক জয়ও আরেকটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বিশ্বের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ইতিহাস রচনাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী ডেমোক্রেট দলীয় হিলারী ক্লিনটন ঐ নির্বাচনে বিজয়ী ট্রাম্প থেকে পঞ্চাশ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেলেও তাঁর প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা সাত কোটি বেয়াল্লিশ লাখের কম ছিল। ইতোমধ্যেই বলেছি পপুলার ভোটে মার্কিন নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় না, ইলেক্টোরাল কলেজের সংখ্যাগরিষ্ট ভোট পেতে হয়। মোট ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে যে প্রার্থী ২৭০ বা ততোধিক ভোট পান তিনিই নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে ট্রাম্প ৩০৬টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পাওয়ায় তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন, হিলারী পেয়েছিলেন ২৩২ ভোট। এবার জো বাইডেন পেয়েছেন ৩০৬টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট, আর ট্রাম্প পেয়েছেন ২৩২ ভোট। অপেক্ষাকৃত কম জনসংখ্যা-অধ্যুষিত মার্কিন স্টেটগুলোর নির্বাচনী-গুরুত্ব যাতে বজায় থাকে সেজন্যেই ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন মার্কিন সংবিধান-প্রণেতারা, কিন্তু মার্কিন জনগণের অপেক্ষাকৃত কম-বিত্তবান শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীগুলো যেহেতু ৫০টি মার্কিন স্টেটের বড় বড় নগরীগুলোতেই কেন্দ্রীভূত হয়ে বসবাস করছেন তাই এই ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি ক্ষুদ্রতর মার্কিন স্টেটগুলোর শ্বেতাঙ্গ-বর্ণবাদী এবং মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত জনগণের জন্যে বেশি সুবিধাজনক নির্বাচনী ফলাফল বয়ে আনছে। ১০০ আসনের সিনেটেও প্রায়শই রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্টতা বজায় থাকতো প্রতি স্টেটের দুটো সিনেট-আসন থাকার নিয়মের কারণে। অবশ্য, এবার সিনেটে দু’দলের আসনসংখ্যা সমান হওয়ায় বহু বছর পর সিনেটের নিয়ন্ত্রণ ডেমোক্রেটিক পার্টির দখলে এসেছে।
বর্তমান মার্কিন মহাসংকটের পেছনেও প্রধান ইন্ধন যুগিয়ে চলেছে এই ইলেক্টোরাল কলেজ ও সিনেটের নির্বাচন ব্যবস্থা। এবারের নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টির একমাত্র কারণ ২০১৫-২০২০ পর্যায়ের মার্কিন রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাটকীয় উত্থান এবং ট্রাম্পের শাসনকালে তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা চরম দক্ষিণপন্থী, উলঙ্গ-বর্ণবাদী, কট্টর পুঁজিবাদী, বিশ্বায়ন-বিরোধী উগ্র-জাতীয়তাবাদী, অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসী-বিরোধী, ইহুদী-খৃষ্টীয় মৌলবাদী, মুসলিম-বিদ্বেষী এবং শ্বেতাঙ্গ-শ্রেয়ঃবাদী মতাদর্শ ‘ট্রাম্প-ইজম’ বা ট্রাম্পবাদ। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (মাগা, গঅএঅ) স্লোগান দিয়ে ২০১৫ সালে নাটকীয়ভাবে রিপাবলিকান রাজনীতির মঞ্চ দখল করেছিলেন চরম বর্ণবাদী, অর্ধ-শিক্ষিত, আগ্রাসী-আচরণ-প্রেমী এবং অসৎপথে ’বিলিয়নেয়ার’ বনে যাওয়া রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প, তারপর অতি দ্রুত রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন বাগিয়ে ২০১৬ সালে সকল পূর্বাভাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করে হারিয়ে দিয়েছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির অতি-আত্মবিশ্বাসী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারী ক্লিন্টনকেও। ঐ সময়ে পরাজয়ের জন্যে বিশেষজ্ঞরা প্রার্থী হিসেবে হিলারীর নানা দুর্বলতাকে দায়ী করলেও ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত আমার কলামে আমি ঐ পর্যায়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য বিজয়ের মূল কারণ চিহ্নিত করেছিলাম এই বিকৃত মানসিকতা-উদ্ভূত মতাদর্শকেই। ঐ কলামের নিচে-উদ্ধৃত অংশগুলো দেখুন:
‘‘রিপাবলিকান পার্টিকে এঙচ (এৎধহফ ঙষফ চধৎঃু) বলা হয়। দলটি যদিও অতীতে আব্রাহাম লিংকনের মত প্রেসিডেন্ট উপহার দিয়েছে, তথাপি সাম্প্রতিক ইতিহাসের বিবেচনায় এই পার্টিকে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ধারক-বাহকে পরিণত করে ফেলা হয়েছে। ’বিগ বিজনেস’ এই দলের মূল অর্থায়নকারী—আবার, ধর্মান্ধ ইভানজেলিক্যাল খৃস্টান গোষ্ঠীগুলোরও আস্তানা এটা। শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী গ্রুপগুলোও রিপাবলিকান পার্টির গোঁড়া সমর্থক।—ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্সিয়াল মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন বলতে গেলে পুরোপুরি উপরে উল্লিখিত অভিবাসী-বিদ্বেষ ও মুসলিম-বিদ্বেষ্তএই দুটো ’নিগেটিভ ইস্যুকে’ পুঁজি করে। মেক্সিকান এবং ল্যাটিনো অভিবাসী ঠেকাতে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকোর বর্ডারে নাকি আগাগোড়া দেয়াল তুলে দেবেন, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সকল মুসলিম নাগরিককে নাকি তিনি বিতাড়িত করবেন। ভবিষ্যতে আর কোন মুসলিমকে নাকি তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেবেন না। ল্যাটিনোদেরকে তিনি ’ধর্ষক’ বলে গালাগাল করেছেন।— অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নির্বাচনের পাল্লাটা তাঁর দিকেই ঝুঁকে পড়ছে।— তাঁর একমাত্র বক্তৃতার স্টাইল হলো সকল প্রতিপক্ষকে বেলাগাম আক্রমণের মাধ্যমে কুপোকাৎ করা। শালীনতা-ভদ্রতা-ভব্যতার ধার ধারেন না তিনি, অনায়াসে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ বাক্যবাণে আক্রমণ শানাতে বিশেষ পারদর্শিতা প্রদর্শন করে চলেছেন তিনি। প্রাইমারি নির্বাচন পর্যায়ে অসংখ্যবার তিনি অশ্লীল আচরণের নজির সৃষ্টি করলেও প্রতিবারই ঐ কুরুচিপূর্ণ নাটকের পর ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বরং হু হু করে বেড়ে গেছে, রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ কেউ তাঁর সাথে রুচিহীন বাগাড়ম্বরের প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে পারেননি। বর্তমান পর্যায়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়নের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হিলারী ক্লিন্টন এহেন অভদ্র ও অশালীন প্রতিপক্ষকে কিভাবে সামাল দেবেন, তা নিয়ে ডেমোক্রেট শিবিরে রীতিমত আতংক সৃষ্টি হয়েছে।”
ট্রাম্পের শাসনের মেয়াদে আমেরিকা এবং সারা বিশ্ব ‘ট্রাম্প-ইজম’ এর যে অসহনীয় অনাচার, শ্বেতাঙ্গ-বর্ণবাদী স্বৈরাচার এবং অভব্য তাণ্ডবের শিকারে পরিণত হয়েছিল তার নজির বিংশ অথবা একবিংশ শতাব্দীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘ট্রাম্পবাদ’ কোন রাখঢাক না করেই সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে আদিবাসীদেরকে হত্যা করে প্রধানত ইউরোপীয় অভিবাসীদের দেশদখলের মাধ্যমে গড়ে ওঠা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী গণতন্ত্র থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্পবাদের অনুসারীরা শ্বেতাঙ্গ মানুষের সংখ্যাগরিষ্টতা এবং রাজনৈতিক আধিপত্য কখনোই নষ্ট হতে দেবে না। এসব শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে কয়েক’শ বছর ধরে যেসব আফ্রিকানদেরকে বন্যজন্তুর মত আটক করে, জাহাজভর্তি পাচার-করা ক্রীতদাস বানিয়ে ক্রয়-বিক্রয় করে তাদের সভ্যতা গড়ে তুলেছে তাদেরকে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬২ সালে দাসত্ব থেকে মুক্তিদানের আইন পাস করলেও ১৫৮ বছর পরও আফ্রিকান-আমেরিকানদেরকে শ্বেতাঙ্গ-আমেরিকান বর্ণবাদীরা সমমর্যাদা ও ন্যায্য নাগরিক অধিকার দিতে নারাজ। একইভাবে নারাজ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়া অশ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের সম-অধিকার প্রদানে। কিন্তু, বিশ্ব-জনসংখ্যাতাত্ত্বিক গতি-প্রকৃতি এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসনের স্বাভাবিক নিয়মেই ক্রমশ ৩২ কোটি মার্কিন জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশে পৌঁছে যাচ্ছে অশ্বেতাঙ্গ জনগণ। এই বাস্তবতাই ঘুম হারাম করে দিচ্ছে ট্রাম্পবাদী বর্ণবাদীদের। ট্রাম্প তাঁর শাসনামলে সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়েছেন আমেরিকায় অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসন থামিয়ে দিতে। যুক্তরাষ্ট্রে হিস্পানিক এবং মুসলিম অভিবাসন ঐ চার বছরে অভূতপূর্ব বৈষম্যের শিকার হয়েছিল, একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ভারতীয় অমুসলিমরা। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী মার্কিন ভোটারদের প্রায় ৩২ শতাংশ ছিল অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী, যার মধ্যে ১৭ শতাংশ ল্যাটিনো বা হিস্পানিক, ১৪ শতাংশ আফ্রিকান-আমেরিকান এবং এক শতাংশ এশিয়ান। এই ৩২ শতাংশ অশ্বেতাঙ্গ ভোটারদের ৮০-৯০ শতাংশই ডেমোক্রেটিক পার্টির ভোট ব্যাংক। বাকী ৬৮ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ-আমেরিকান নাগরিকদের মধ্যে যারা ডঅঝচ (ডযরঃব অহমষড়-ঝধীড়হ চৎড়ঃবংঃধহঃ) তারাই অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে মার্কিন সমাজে সবচেয়ে সুবিধাভোগী। তাদের বৃহদংশই যেহেতু আমেরিকান মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং তাদের সিংহভাগ যেহেতু রিপাবলিকান পার্টির ভোটার তাই ট্রাম্পবাদের প্রধান উদ্দেশ্য তাদেরকে ভোট দিতে উৎসাহিত করা এবং একইসাথে অশ্বেতাঙ্গ ভোটারদেরকে যেভাবেই হোক্ নিরুৎসাহিত ও বাধাগ্রস্ত করা। ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থকদের অনুপাত শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে ৩০ শতাংশেরও কম। (অবশ্য, ক্যাথলিক খৃস্টান জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগুরু অংশ ডেমোক্রেট ভোটার। জো বাইডেন নিজেও ক্যাথলিক, তিনি জন এফ কেনেডির পর আমেরিকার ইতিহাসের দ্বিতীয় ক্যাথলিক প্রেসিডেন্ট।)
২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারী ক্লিন্টন তাঁর স্বভাবজাত অহমিকার কারণে ডেমোক্রেটিক পার্টির এই মূল ভোট ব্যাংককে অবহেলা করার বিপরীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব হারানোর ভয় ঢুকিয়ে দলে দলে নির্বাচন কেন্দ্রে নিয়ে যেতে সমর্থ হওয়ায় কেল্লা-ফতে করে ফেলেছিলেন। কিন্তু, ভয়ংকরভাবে ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট ট্রাম্পবাদ’ ২০২০ সালে অশ্বেতাঙ্গ ভোটারদের অস্তিত্বকেই সংকটাপন্ন করে ফেলায় এবার তাদের মধ্যে ঐতিহাসিক নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত, ২০২০ সালের মে মাসে অমানুষিক ‘জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের’ ঘটনাবলী বর্বর-বর্ণবাদী ট্রাম্পের কুৎসিত চরিত্রকে এমনভাবে নগ্ন করে দিয়েছে যে ৩ নভেম্বরের নির্বাচনকে অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী আক্ষরিকভাবে অস্তিত্বের সংগ্রামে রূপান্তরিত করে নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাদেরকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা। এই নবজাগ্রত ভোটারদেরকে মহাসুযোগ এনে দিয়েছে করোনা ভাইরাস মহামারি, যার কারণে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার পরিবর্তে মেইল-ব্যালটে ভোট প্রদানকে প্রধান নির্বাচন-কৌশল হিসেবে ব্যবহারের ডাক দিয়েছিল ডেমোক্রেটিক পার্টি। নিজেদের দলগত সাংগঠনিক শক্তিকে জোরদার করে এবারের নির্বাচনে এই কৌশলে ঐতিহাসিকভাবে সর্বোচ্চ ভোটার-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারায় ট্রাম্পের ভরাডুবি ঘটাতে পেরেছে ডেমোক্রেটিক পার্টি। ট্রাম্প ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন মেইল-ব্যালট তাঁকে এবং রিপাবলিকান পার্টিকে ডোবাবে। তাই, নির্বাচনের প্রচারাভিযানে আগাগোড়া তিনি মেইল-ব্যালট পদ্ধতিতে ভোট জালিয়াতির আশংকা ব্যক্ত করেছেন। ভোট গণনা যখন পরাজয়ের আশংকাকে সত্য প্রমাণিত করে চলেছিল তখন মরিয়া হয়ে ট্রাম্প ভোট কারচুপির মাধ্যমে তাঁর কথিত ‘ভূমিধস বিজয়’ ডেমোক্রেটিক পার্টি চুরি/হাইজ্যাক করে নেয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলে গত আড়াই মাসে মোট ৬১টি মামলায় হারার পরও তাঁর হাজার হাজার অন্ধ-বর্ণবাদী, প্রতিশোধ-উন্মত্ত সমর্থকদেরকে ৬ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে প্রত্যক্ষ উসকানি দিয়ে ক্যাপিটল হিলের মার্কিন কংগ্রেস ভবনে তান্ডব সৃষ্টিতে ন্যক্কারজনকভাবে লেলিয়ে দিলেন!
পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির ভিত্তিতে ২০১৪ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ায় বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের একচ্ছত্র অধিপতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়াশীলতা ও প্রতিশোধ-উন্মত্ততায় ক্রম-নিমজ্জমান একটি পড়ন্ত-পরাশক্তি। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নমিনাল ডলারের হিসাবেও চীন আমেরিকাকে টপকে যাবে। আমি নিঃসন্দেহ, ইতিহাসের রায়ে ট্রাম্প মার্কিন ইতিহাসের নিকৃষ্টতম প্রেসিডেন্ট বিবেচিত হবেন। কিন্তু, ট্রাম্প আপাতত বিদায় নিলেও ‘ট্রাম্পবাদ’ যেহেতু শ্বেতাঙ্গ শ্রেয়ঃবাদ (হোয়াইট সুপ্রিমেসি) এবং মার্কিন একাধিপত্যবাদে কট্টর বিশ্বাসী ক্রোধান্ধ-বর্ণবাদী ও ‘মাগা-ফ্যাসিবাদী’ জঙ্গি সংগঠনগুলোর মতবাদ তাই ট্রাম্পবাদ থেকে অদূর ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্কৃতি মিলবে না। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর শাসনকালে ট্রাম্পবাদকে মার্কিন শ্বেতাঙ্গ-বর্ণবাদীদের মনোজগত থেকে হঠাতে পারবেন কি?
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়