ঊনবিংশ শতাব্দীর এক যুগ সন্ধিক্ষণে এশিয়া মহাদেশের পূর্বাঞ্চল ঘেঁষে অবস্থিত বাংলাদেশের উর্বর অঞ্চল ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত মাইজভাণ্ডার গ্রামে একদা এক শুভ মুহূর্তে ১২৪৪ হিজরি মোতাবেক ১২৩৩ বাংলা ১৮২৬ ইংরেজি ১১৮৮ মঘী ১লা মাঘ বুধবার শিশু গাউছ সৈয়দ আহমদ উল্লাহ প্রখ্যাত সৈয়দ বংশে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ মতিউল্লাহ এবং মাতার নাম বিবি খায়রুনেছা।
গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী হযরত শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) স্থানীয় মক্তবে লেখাপড়া শেষে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১২৬০ হিজরি সনে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং ইলমে শরীয়তের প্রতিটি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে ১২৬৮ হিজরি সনে কৃতিত্বের সাথে মাদ্রাসা আলিয়ার শিক্ষা সমাপনী শেষে ১২৬৯ হিজরি সনে যশোর কাজী পদে যোগদান করেন। মাত্র ১ বছর চাকুরি শেষ করে ১২৭০ হিজরি সনে কলকাতা মুন্সী বুঁ আলী সাহেবের মাদ্রাসায় এবং পরে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনা শুরু করেন। তথায় কাদেরিয়া তরিকতের শায়খ গাউছে কাউনাইন আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ কাদেরী লাহুরী (রহ.) এঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করতঃ গাউছিয়ত লাভ করেন এবং কুতুবুল আকতাব দেলোয়ার আলী পাকবাজ (রহ.) এঁর সান্নিধ্যে কুতুবিয়তের ফয়জ লাভে ধন্য হন। তিনি দীর্ঘ ৩ বছর স্বীয় পীরের খেদমতে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। পীরের নির্দেশ মোতাবেক ১২৭৫ হিজরীতে হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী নিজ দেশে ফিরে আসেন এবং মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে আপামর জনগণকে প্রভুর প্রেম ভালবাসার দীক্ষা দিতে লাগলেন। ১২৭৫-১৩২৩ হিজরী দীর্ঘ ৪৮ বৎসর যাবত হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (কঃ) “মাইজভাণ্ডারী তরিকা” প্রবর্তনের মাধ্যমে ‘বেলায়তে মোতলাকা’ প্রজ্ঞাময় আহবানে মানব ও মানবতার কল্যাণ সাধন করে মানবজাতিকে সকল ধর্মীয় এখতেলাফ, গোঁড়ামি, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি ইত্যাদি পরিহার করে অদ্বৈত মহান খোদার মিলন পথকে সুগম করে দিয়েছেন।
তিনি সর্বজনীন হিসেবে তাঁর অনুরাগী বা বিরাগী প্রত্যেকের জন্য তাঁর তরিকতের অন্যতম শুদ্ধি প্রণালী স্বাভাবিক ও সহজতম কর্মপন্থা হিসেবে উছুলে ছাবয়া বা সপ্তকর্ম পদ্ধতি প্রণয়ন করেন। এর সাহায্যে মানব খোদা পরিচিতি জগতে উন্নিত হয়ে ঊর্ধতম সত্যবস্তু স্রষ্টার সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করে নিজ স্রষ্টা সম্বন্ধে এক ‘কাশফী’ নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করতে সন্দেহাতীত ভাবে সামর্থ হয়। এ সপ্ত কর্মপদ্ধতিকে তিনি কার্যকরী প্রত্যক্ষ কোরআনী হেদায়ত বলে সাব্যস্ত করেন। যা সকল সম্প্রদায় ও সকল ধর্মাবলম্বীর জন্য নির্বিরোধ ও সহজসাধ্য।
সপ্তকর্ম পদ্ধতিঃ
ফানায়ে ছালাছা বা রিপুর ত্রিবিধ বিনাশ স্তর ঃ
ক. ফানা আনিল খাল্কঃ অর্থাৎ কারো নিকট কোনোরূপ উপকারের আশা বা কামনা না থাকা, যার ফলে মানব মন আত্মনির্ভরশীল হয় এবং নিজ শক্তি সামর্থের প্রতি আস্থা জন্মে।
খ. ফানা আনিল হাওয়াঃ অর্থাৎ যা না হলে চলে সে রূপ কাজকর্ম ও কথাবার্তা হতে বিরত থাকা যার ফলে জীবন যাত্রা সহজ ও ঝামেলা মুক্ত হয়।
গ. ফানা আনিল এরাদাঃ অর্থাৎ খোদার ইচ্ছাশক্তিকেই প্রাধান্য দেওয়া এবং নিজ ইচ্ছা বা বাসনাকে খোদার ইচ্ছার নিকট বিলীন করা যার ফলে সুফি মতে ‘তসলিম ও রজা’ হাসিল হয়।
মউতে আরবা বা চতুর্বিধ মৃত্যুঃ
ক. মউতে আবয়্যাজ বা সাদা মৃত্যু। এটা উপবাস এবং সংযমে আয়ত্ত্ব হয়, যার ফলে মানব মনে আলো এবং উজ্জ্বলতা দেখা দেয়। যেমন রমজানের রোজা বা নফল রোজা ইত্যাদি হলো উপবাস ও সংযম পদ্ধতি।
খ. মউতে আছওয়াদ বা কালো মৃত্যু। এটা শত্রুর শত্রুতা বা নিন্দুকের নিন্দাতে হাছিল হয়।
গ. মউতে আহমর বা লাল মৃত্যু। এটা কাম ভাব ও লালসা হতে মুক্তিতে হাছিল হয়। এবং বেলায়ত প্রাপ্ত হয়ে অলিয়ে কামেলদের মধ্যে গণ্য হয়।
ঘ. মউতে আখজার বা সবুজ মৃত্যু। এটা নির্বিলাস জীবন যাপনে অভ্যস্ত হলেই হাছিল হয়। যার ফলে মানব অন্তরে স্রষ্টার প্রেম ভালবাসা ছাড়া অন্য কামনা বাসনা থাকে না। এটি বেলায়তে খিজরীর অন্তর্গত।
হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর জিন্দেগী মোবারক ছিল শরিয়ত, তরিকত, মারফত ও হাকিকত দ্বারা পরিপূর্ণ। উল্লেখ্য যে, হযরত কেবলা সাত বছর বয়স থেকে নামাযের পাবন্দী করতেন এবং জামাতে নামাজ আদায় করতেন। অতিবেশি নফল নামায, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত, রোযা পালন ও মোশাহেদা মোরাকাবাতে রত থাকতেন।
হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (ক.) অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি তাঁর সহধর্মীনিকে বলতেন, “দুনিয়া মুসাফিরের জায়গা এখানে আড়ম্বরের দরকার কি? হযরত আকদাছ আড়ম্বরমূলক খুশি পছন্দ করতেন না। কেউ শাদী শব্দ উল্লেখ করে বিয়ের অনুমতি প্রার্থনা করলে বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ জগতকে ‘দারুল হাজান’ বলেছেন, তুমি আমাকে খুশি শুনাতে এসেছ!” দয়ার সাগর হযরত কেবলা হাজতি মকছুদি লোকদের আনিত টাকা পয়সা এবং বিভিন্ন সামগ্রী যে যেভাবে চাইতেন দান করে দিতেন।
হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) নীতি. আদর্শ মানব ও মানবতার কল্যাণের জন্য সময় ও বাস্তব উপযোগী অনুকরণীয় আদর্শিক পন্থা। সর্বজাতি ও সর্ব ধর্মের ধর্মীয় লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার এবং সকলের গ্রহণোপযুগীই সহজতম পন্থা। বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয় শান্তিসহ সকল ধর্মের বিভেদ মিটানোর জন্য হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) প্রণীত মাইজভাণ্ডারী তরিকার মূলনীতি সমূহ অত্যন্ত কার্যকর ও উপকারী। তাই অছিয়ে গাউছুল আজম, খাদেমুল ফোক্রা হযরত মওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.) বলেছেন, “গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর আদর্শ উর্ধ্বে তুলিয়া ধরিলে বিশ্ববাসীর চোখ চট্টগ্রাম মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের দিকে ঘুরিয়া যাইবে।”
মানব কল্যাণ সাধনে তাঁর অজস্র অগণিত কারামতের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তিনি এমন এক খোদায়ী প্রদত্ত্ব শ্রেষ্ঠত্ব সম্পন্ন আল্লাহর অলি ছিলেন, জনগণের না হওয়ার মত কাম্য বস্তুকে খোদার ইচ্ছা শক্তিতে তাঁর গাউছে আজমিয়তের প্রভাবে হওয়ার রূপ দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন।
হযরত কেবলা (ক.) কালাম করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুইটি টুপির মধ্যে একটি টুপি আমার মাথায়, অপরটি আমার ভাই বড় পীর ছাহেবের মাথায় দিয়েছেন।” “আমার নাম পীরানে পীর ছাহেবের নামের সাথে সোনালী অক্ষরে লিখা আছে।” অর্থাৎ ধর্মে নতুনত্ব দানে শাহে বাগদাদীর অনুরূপ জীবনদাতা। এই কালামগুলি তাঁর গাউছে আজমিয়তের প্রমাণ ও স্বীকৃতি বহন করে। হযরত শায়খুল আকবর আল্লামা মুহিউদ্দিন ইবনে আরবী (রহ.), মওলানা তোরাব আলী কলন্দর (রহ.), জৈনপুরী হযরত শাহাবুদ্দিন (রহ.), কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার মুদাররিছ হযরত মওলানা ছফিউল্লাহ (রহ.), সুপ্রসিদ্ধ মোহাদ্দেস মওলানা আবদুল হক (রহ.) প্রমুখ অলিউল্লাহগণ হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) গাউছে আজমিয়তের স্বীকৃতিপূর্বক তাঁর গুণগান করেছেন। এছাড়া ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা আল কাদেরী (রহ.), বাহারুল উলুম হযরত সৈয়দ আবদুল গণি কাঞ্চনপুরী (রহ.), মুফতিয়ে আজম আল্লামা সৈয়দ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী (রহ.)সহ প্রমুখ যুগশ্রেুষ্ঠ আলেমগণ তাঁেদর স্ব স্ব কিতাবে গাউছে আজমিয়তের স্বীকৃতি দিয়ে ব্যাখ্যাসহকারে বিবৃত করেছেন।
১৩২৩ হিজরী সনে বাংলা ১৩১৩ সালে ইংরেজি ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ১২৬৮ মঘীয় ১০ই মাঘ মোতাবেক ২৭ জিলক্বদ সোমবার দিবাগত এক পবিত্র শুভ নিভৃত মুহূর্তে নিঝুম রাতে ১ টার সময় ৭৯ বছর বয়সে পরম প্রিয়তম একমাত্র মাহবুব মহান আল্লাহর শুভ মিলনে বিশ্ববাসিকে ছেড়ে এ ধরাধাম ত্যাগ করেন।
লেখক : গবেষক, দারুল ইরফান রিসার্চ ইনস্টিটিউট