তৃতীয় লিঙ্গ
বাসের গেটের সামনে এসে দাঁড়াতেই বেশ জোরে হুসসসস শব্দ করে কবাট দুটো নিজেদের কোমর, মানে মাঝ বরাবর ভেঙ্গে গিয়ে বাকি অংশের সাথে এক হয়ে ঘটা করে শব্দ করে দু দিকে সরে গিয়ে, আমার জন্য ভেতরে ঢোকার পথ সুগম করে দিতেই, দ্রুত বাসের ওম ওম বুকে আশ্রয় নেবার নিমিত্তে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাব যখন, তখনই মনে হল; আরে ওরকম মুখ হা করে রাখা লাগেজ ক্যাবিনে এক্কেবারে অরক্ষিত অবস্থায় যে রেখে আসলাম আমাদের বাঙ পেটরা, ওগুলোর নিরাপত্তার কি হবে? কোন চোর বাটপার যদি সরিয়ে নেয় এক বা একাধিক ব্যাগ বা সুটকেস! আরে অন্য কোন কারণে না হোক অন্তত এ কারনেও তো ড্রাইভারের সাথে একজন বাড়তি লোক থাকা দরকার ছিল এ বাসে। নাহ এক্ষুণি বাসের ওমের লোভ না করে, বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত বরং আমার বাইরে দাঁড়িয়ে ঐ ব্যাগ সুটকেসের পাহারায় থাকাটাই উত্তম। এরকম ভেবে বাস থেকে নামার জন্য ঘুরতি হাঁটা দেবো ভাবতেই, পেছন থেকে ফের সেই ধাতব ঘটাং আর হুসসসস শব্দ শুনে বুঝলাম নেই উপায় পিছু ফেরার!
না, এক্কেবারে যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাব না, সম্ভবত আমার চেহারায় হাহাকারভাবের সাথে আমতা আমতা ভাবের মিশেলে লেখা হয়েছে যা এমুহূর্তে, পাইলট চাচা তার মাথা মুন্ডু কিছুই যে বোঝেনি, বুঝলাম তা, হাসিমুখে উনি যখন হাত দিয়ে ইশারা করে ভেতরে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করলেন।
কিছুটা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে উপরে উঠে, বাসের ভেতরে চোখ ফেলতেই দেখলাম ওখানে জনা তিনেক চায়নিজ ইতোমধ্যে এসে আসন নিয়েছেন। দু পাশের জোড়া সিটগুলোর মধ্যে এমুহূর্তে আমার বা দিকের জোড়া সিটগুলোর সামনে পিছু এক জোড়ায়, বাসের মাঝ বরাবর জোড়ায় জোড়ায় পরিবারের বাকীরা ইতোমধ্যে বসে পড়ায় , বেজোড় আমাকে বসতে হবে আলাদাই। অতএব মনে মনে আন্দাজ করলাম যে বাসের তলপেটের ঠিক কোন জায়গাটাতে ঢুকিয়ে এসেছি ব্যাগসুটকেস। মনে হচ্ছে ঐ খানটার সিটগুলো ফাকাই আছেই। অতএব ঐ সিটগুলোর একটার দিকে এগুনো শুরু করতেই, ড্রাইভিং সিটের পেছনের সিটের পরের সিটসংলগ্ন জানলায় সাঁটা ল্যামিনেটেড কাগজে আঁকা রঙ্গিন রুটম্যাপটির দিকে নজর পড়তেই, দাঁড়ালাম ওটার সামনে।
বড়ই নিশ্চিন্ত হলাম যখন দেখলাম ঐ রুট ম্যাপের প্রথম স্টপেজটির জায়গায় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে আমাদের হোটেলের নাম! ওটা দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে চোখ চলে গেল অজান্তেই পাইলট চাচার দিকে। তার চোখে চোখ পড়তেই রুটম্যাপে আমাদের স্টপেজের উপর আঙ্গুল রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললাম, এই যে পেয়েছি! এই প্রথম স্টপেজেই চাচা নামিয়ে দিয়েন আমাদের এ যাত্রা।
আমার কথায়? নাকি আঙুলের দিকে তাকিয়ে পাইলট চাচা হাসিমুখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালেন বুঝলাম না। কারণ আমার ভাষা তো তার বোঝার প্রশ্নই উঠে না, আবার ড্রাইভিং সিটে বসে ঐ রুট ম্যাপের কোথায় আঙ্গুল রেখেছি তা তো তার চোখে পড়বার কথা নয়। কিন্তু তারপরও উনি কেন নিশ্চিন্ত করলেন হ্যাঁ সূচক জবাবে?
‘এই দেখো আবারো শুরু হয়েছে ফাজলামি’ পাইলট চাচার নিশ্চয়তার পিঠাপিঠি লাজুর এই মন্তব্যের কোন জবাব না দিয়ে, ওদের উল্টো দিকে মনে মনে ঠিক করে রাখা সিটে গিয়ে বসার আগে নিজের পিঠটা হালকা করলাম ব্যাগটা লাজু আর অভ্র যে সিটে বসেছে তাদেরই মাথার উপরের তাকে রেখে। অতঃপর মনে মনে ঠিক করে রাখা ওদের উলটো পাশে মানে আইলের এপাশের তিনটা সিট সামনে বসেই জানালার কাচের ওপাশে দৃষ্টি ফেলে বোঝার চেষ্টা করলাম যে, বাসের তলেপেটের সেই লাগেজ ক্যাবিনের খোলা ঢাকনাটির হদিশ!
‘কি ব্যাপার ঘটনা কি? অতোদূরে ঐপাশে গিয়ে বসছ কেন? একসাথে থাকতে থাকতে টায়ার্ড হয়ে গেছ নাকি?’ এমনিতেই লাগেজ ক্যাবিনের ঢাকনাটির হদিশ না করতে পেরে আছি টেনশনে তার মধ্যে অকারণ এই খোঁচায় মেজাজ খিচড়ে গেলেও, ঠাণ্ডায় গলায় বললাম যে আমাদের ব্যাগ সুটকেস গুলোর উপর নজর রাখার জন্যই বসেছি এখানে।
‘মানে কি? তুমি কি ওগুলো না ঢুকিয়েই চলে এসেছো নাকি? এটা একটা কথা হলো? কি করেছ তা হলে এতোক্ষণ নীচে?’ লাজুর একটানা এই প্রশ্নের তোড়ে ফের হৃদয়ঙ্গম করলাম যে, আমার কাণ্ডজ্ঞান বলি আর বাস্তববুদ্ধির কথাই বলি, তার কোনটার উপরই যে কোনরকম স্ত্রীআস্থা তৈরি করতে পারিনি আজো এ ব্যাপারে তাকে যেমন দোষারোপ করার কিছু নেই, তেমনি নেই আমার কোনও দায় । কারণ এটাই হলো নিয়তিনির্ধারিত স্বামীকপাল। তারপরও হতাশ ও বেশ বিরক্ত হয়ে বলতে চাইলাম যে, শোন বাইরে এমন ফুরফুরে দখিনা হাওয়া বইছে না যে আমি এতোক্ষণ ওখানে সুখে হাওয়া খাচ্ছিলাম। কিন্তু অবচেতন মনের আমাকে রক্ষার অতিসচেতন প্রয়াসে অবশেষে কি না বললাম, ওগুলো লাগেজ ক্যাবিন থেকে কেউ যাতে বের করে না নিয়ে যায় সেই পাহারাদারি করার জন্যই বসেছি এখানে।
এমত জবাবে আইলের ওপাশে নিরবতা নেমে আসতেই, বাইরের দিকে নিবিষ্ট চোখ ফেলতেই মনে হল, আরে সেই যে গতকাল কানমিং এর স্টোন ফরেস্ট থেকেই দেখে আসছি আকাশের গোমড়া মুখ, বেইজিং এ এসেও তো দেখছি, এখনো তা পিছু ছাড়ে নি! ঠাণ্ডার বেমক্কা ধাক্কা, হিম চ্যানলের সুপেয় জলের অভাব, আর হোটেলে পৌঁছুব কখন, কিভাবে? এসব নিয়ে সারাক্ষণ মনমগজ ব্যস্ততটস্থ থাকায়, ব্যাপারটা আমলে আসে নি এতক্ষণ। এখন যখন সেটি নজরে আসতেই মনে হল, একই চায়নিজ আকাশের এই দুই অংশের দুই গোমড়া মুখের পেছনের গোমর সম্পূর্ণ আলাদা। এখান থেকে মাত্র ঘণ্টা তিনেকের উড়াল দূরত্বের কানমিং হল কিনা চিরবসন্তের রাজ্য, সেখানে এই বেইজিং তো হল শীতরাজ্য। বসন্তের রাজ্যের আকাশে, মেঘেদের আনাগোনার কারণেই ওখানে ছড়িয়ে ছিল চারদিকে মুখ গোমড়া ভাব। আর এখানে তুমুল ঠাণ্ডায় আকাশে ফুঁড়ে রোদ নীচে নামার আগেই জমে গেছে হয়তো বা উপরে কোথাও।
আরে ধ্যাত কি যে বলো না অবৈজ্ঞানিক কথা, রোদ মানে আলো কি জমে নাকি ঠাণ্ডায় বলে উঠলো ভেতরের দ্বিতীয়জন। শোন এটা হলো ঠাণ্ডায় সৃষ্ট কুয়াশা, না আরো ঠিক করে বললে বলতে হয় ধোঁয়াশার প্রভাব। যে সময় থেকে আউটসোর্সিংয়ের ঘাড়ে ভর করে চায়নার অর্থনীতির ঘোড়া টগবগ করে সামনে এগুতে শুরু করেছিল, সেই একই সময় থেকে কিন্তু তাদের পরিবেশেরও বারোটা বাজতে শুরু করেছে। আর বেইজিং হল চায়নার দুষিত বায়ুমোড়া শহর গুলোর অন্যতম । এখানে আজকাল কুয়াশা হয় না। হয় যা তা হলো ধোঁয়াশা, বুঝলে। এইজন্যই এই অবস্থা এখানকার।
শোন এটাই হলো তোমার সমস্যা, আমি যখন একটু কাব্য করতে যাই, তুমি তখন নির্ঘাত ঢুকিয়ে দাও বিজ্ঞানের খটমট ; আবার যখন একটু বিজ্ঞান নিয়ে ভাবতে যাই তুমি তার ভেতরে হয় ঢুকিয়ে দাও ঢলঢল কাব্য না হয় মাথা নষ্ট করা দর্শন। অথচ এই তিনটাতেই আমি হলাম ক অক্ষর গোমাংস, প্রথমজন এটুকু বলতেই -হুসসসস শব্দের পিছু পিছু ঘটাং করে ধাতব শব্দ হতেই এসময় চোখ চলে গেল সামনে। দেখলাম গেটের দিক থেকে একে একে আসছেন, পিঠে পিঠ ব্যাগ আর গায়ে জবরদস্ত গরম কাপড়ে মোড়ানো দু তিন জন চায়নিজ তরুণ তরুণী।
ওদের দিকে নজর দিয়েই ফের পাহারদারির চোখ ফেললাম জানালার বাইরে। নাহ ওখানে কেউ নেই এখনো । তার মানে এরা কেউই কোন বড় ব্যাগ সুটকেশ নিয়ে আসেন নি। যদিও এরকম শীতে, শুধুই শীতের বাড়তি কাপড় নিতে হলেও, দরকার বড়সড় ব্যাগসুটকেশ, কিন্তু তারা কেউই সেই ঝামেলায় যান নি মনে হচ্ছে। তাহলে কি তারা এয়ারপোর্ট এলাকার বাসিন্দা, যাচ্ছেন এই এলাকা থেকে বেইজিং শহরে এই বাস ধরে? না কি এসেছেন তারা প্লেনে করে অন্য কোন শহর থেকে? এসেছেন এক বা দু রাতের জন্য বেইজিঙে, যার কারনে গরম কাপড় সব গায়েই চড়িয়ে নিয়েছেন, আর বাকি টুকটাক দরকারি জিনিষপত্র নিয়েছেন পিঠ ব্যাগে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য চোখ ফেরালাম ফের বাসের ভেতরে, গেইটের দিকে। দেখি আসছেন আর কয়েকজন।
গুনছি না সঠিক, তারপরও গনাগুনতিতে অভ্যস্ত চোখের আন্দাজে মনে হলো জনা দশ বারো উঠলেন এইমাত্র বাসে। তাদের কারো কারো হাতে ঝোলানো স্যুটের প্যাকেট দেখে মনে হলো, যে তারা সম্ভবত নেমেছেন কিছুকাল আগে নামা কোন ফ্লাইট থেকেই। আগামীকাল হয়তো তাঁদের কোন অফিসিয়াল মিটিং ফিটিং আছে যার জন্য, ফর্মাল ড্রেস স্যুট হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছেন। বাকীদের হাতে ওইরকম স্যুটের প্যাকেট না থাকলেও ধরে নেয়া যায় যে তারাও এসেছেন বেইজিং এ ক্ষণিকের অতিথি হয়েই , কারণ এসেছেন তারা যেহেতু এক দলভুক্ত না হয়েও অনেকটা একই সাথে।
‘বাবা তোমার পাওয়ার ব্যাংকটা’ ওপাশের পেছন থেকে অভ্রের দাবী ভেসে আসতেই, ওর দিকে ফিরে হাত দিয়ে একটু ধৈর্য ধরার জন্য ইশারা করলাম; কারণ এ মুহূর্তে সিট ছেড়ে উঠে গেলে যদি হাতছাড়া হয়ে যায় আমার পাহারাদারি সিটটা। কারণ যে দশ বারোজন উঠেছেন উপরে একটু আগে তাদের সবাই সিটে বসেন নি এখনো। বরং কারো কারো চোখ জরিপের ভাবে মনে হচ্ছে এই সিট টাই বুঝি তাঁদের পছন্দ, কিন্তু এখানে আমার মতো অতিশ দীপঙ্করের বংশধর বসে পড়ায় আমার পাশে কেউ হিউয়েন সাং হয়ে বসছেন না। আমাদের দেশে যেমন এক ঘর মে দ পীর থাকতে পারে না, তেমনি হয়তো চায়নাতে এক সিটেও দুই পরিব্রাজকের মনে হয় বসার নিয়ম নেই। উপরন্তু ঐ দরজাটি এখনো বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে আসেনি, যার মানে হলো আরো কেউ ওঠার অপেক্ষায় আছে নিশ্চয় বাইরে। অভ্র কে নিবৃত করে জানালার বাইরে নজর দিতেই দেখি, বাসের তলপেটে দুইজন নারী পুরুষ কিছু ঢোকাতে ব্যস্ত। হ্যাঁ এখন ঐ ডালাটা ও চোখে পড়ছে। আর দুজনেরই শরীরের উর্ধ্বাংশ ডালার আড়ালে চলে যাওয়ায় বাকি অংশের পোশাকের রং ডিজাইন যা দেখতে পাচ্ছি তাতে বুঝতে পারছি না দুজনেই পুরুষ নাকি নারী? নাকি একজন পুরুষ আরেকজন নারী? কারণ কালো বা বাদামি রঙের ওভার কোট তো হল যাকে বলে আজকালকার ফ্যাশন সামগ্রী বিপণনকারীদের আবিষ্কৃত তৃতীয় লিঙ্গ, ইউনিসেঙ রং। পরনে তাঁদের ঐ দুটো রংগেরই গরম কাপড়ের আভাস দেখতে পাচ্ছি ওলট পালট করে। মানে একজনের ওভার কোট কালো আর প্যান্ট বাদামি রঙের উলেন কাপড়ের হলেও আরেকজনও চড়িয়েছে একই রং উল্টে পাল্টে।
আচ্ছা এটা আবার কেমন ঘটনা? আমাদের সমাজ আর ধর্মে তো অবশ্যই, পৃথিবীর কোন সমাজ আর ধর্মেই তো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। চাকরি বাকরি থেকে শুরু করে, যেসব জায়গায় কোন ব্যাক্তির ব্যক্তিগত পরিচয় লিপিবদ্ধ করতে হয়, সেই সব ফরমেও এই কিছুদিন আগেও তো স্ত্রী আর পুরুষ, এই দুই লিঙ্গ বাদে অন্য কোন অপশন ছিল না টিক চিহ্ন দেবার জন্য। এই যখন অবস্থা ধর্মে সমাজে, জাজ্বল্যমান একটি মানুষের শুধু তৃতীয় লিঙ্গ হওয়ার কারণে, সে জায়গায় ফ্যাশন বিপণন কারীদের বানানো এই ইউনিসেঙ যেটিকে নাকি তৃতীয়লিঙ্গ মনে হয় আমার, সে নামের ফ্যাশন সামগ্রীর কেন আছে এমন রমরমা ভালো বাজার? বিপননকারীরা রঙয়ের যেমন লিঙ্গ নির্ধারণ করেছেন অনেক আগেই তেমনি ইদানীং তা করছেন ডিজাইনেও! ভাবছি যখন এমন ঠিক তখনই ঢালাটির নীচ থেকে বের হয়ে দুজনেই প্রকাশিত হতেই বুঝলাম তাঁরা দুজন যুগল কপোত কপোতী না হলেও, একজন নির্ঘাত স্ত্রী আরেকজন পুং লিঙ্গেরই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক