বিখ্যাত পিরামিড, লাইট হাউজসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখার উদ্দেশ্যে কয়েক বছর আগে মিশর গিয়েছিলাম। বেশ কয়েকদিন ঘুরে ঘুরে দেখলাম আর অবাক হলাম প্রায় ছয় হাজার বছরের পুরানো নিদর্শন তারা কত সযতনে সংরক্ষণ করেছে। পর্যটকের জন্য ওখানে রয়েছে প্রশিক্ষিত গাইড। যাদের কাজ শুধু বিদেশি পর্যটকদের সাথে থেকে সব কিছু ঘুরে দেখানো ও পরিচিতি বর্ণনা করা, রয়েছে অনেক হোটেল। নীল নদে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় রয়েছে রিভার ক্রুজের ব্যবস্থা। যেখানে ওদের ঐতিহ্যবাহী সংগীত, যাদু ও বেইলি ড্যান্স প্রদর্শন করা হয়, যা সত্যি উপভোগ্য। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এই বেইলি ড্যান্সের জন্য ওদের আলাদা ইন্সটিটিউট আছে। অর্থাৎ শুধু পর্যটকদের জন্য ওখানে অনেক কিছু গড়ে উঠেছে। গাইডেরা প্রতিদিন বিভিন্ন স্পর্ট থেকে ফেরার সময় ওদের স্থানীয় বিভিন্ন পণ্যের কারখানায় ও মার্কেটে নিয়ে যেত, যেন কিছু কেনাকাটা করতে পারি। তাদের দেশপ্রেম ও নিষ্ঠা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই।
এবার আমাদের দেশের কথায় আসি। আমাদের দেশে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত। সুন্দরবনের মত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সিলেটের চা বাগান, তামাবিল, রাতারগুল, জাফলং। কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চল। রয়েছে বিশাল কাপ্তাই লেক। সোনারগাঁওয়ে মত ঐতিহাসিক নিদর্শন। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, কুমিল্লার লালমাই পাহাড়, সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপ। আরো রয়েছে পাহাড় সাগর নদী ঘেরা চট্টগ্রাম। আছে মনোহারী কঙবাজার সমুদ্র সৈকত। শত শত বছরের পুরাকীর্তি, যা সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অথচ এর পরেও যদি কোন পর্যটক আমাদের দেশে আসে তবে কি সে পুরো দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পাবে? উত্তর হলো না। অথচ শুধু পর্যটকদের জন্য সরকারের একটি সংস্থা রয়েছে ‘বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন’। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের দেশের স্থানীয় জনগণই জানে না ওর এলাকা বা জেলায় দর্শনীয় স্থানগুলো কী কী।
প্রশ্ন হলো, মানুষ কেন পর্যটনে আকৃষ্ট হয় বা পর্যটকেরা কী চান? তারা চান অবসর সময়টা নিরাপদে একান্তে নিজের মত করে কাটাতে। এক্ষেত্রে বিদেশি পর্যটকদের চাহিদা একটু বেশি। তারা চান ভাল মানসম্পন্ন হোটেল, বিভিন্ন পর্যটন স্পটে নির্বিঘ্নে যাতায়াতের ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, পছন্দনীয় পানীয়, প্রশিক্ষিত গাইড, পছন্দনীয় ভ্রমণ সঙ্গী, কেনাকাটার জন্য সুপরিসর ও আকর্ষণীয় মার্কেট ও আলাদা এক্সক্লুসিভ জোন। যদি আমরা ওদের আকৃষ্ট করতে চাই, তবে তাদের জন্য আলাদা জোনসহ এই সুবিধাগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোতে যাতায়াতের রাস্তার উন্নয়নসহ অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। নৈসর্গিক চট্টগ্রামের রয়েছে বিধাতা প্রদত্ত পাহাড়, ঝর্না, সাগর, লেক ও নদী। যা পর্যটক আকর্ষণের প্রধান উপাদান। যদি আমরা চট্টগ্রামকে পর্যটকদের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারি তাহলে চট্টগ্রাম হবে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র। কর্ণফুলী নদীতে প্রতিদিন আমরা রিভার ক্রুজ বা সাগরে সী ক্রুজের ব্যবস্থা করতে পারি। যেখানে লাঞ্চ ডিনার সহ দেশের ঐতিহ্যবাহী কালচারাল প্রোগ্রাম করতে পারি। এটা হতে পারে পর্যটক আকর্ষণের একটা বড় উপাদান। আবার কোন কোন পর্যটক যদি গভীর রাতে শহর দেখতে চায় বা কেনাকেটা করতে চায়, সেটার জন্য যদি আমরা আলাদা নিরাপদ জোন করতে পারি, তবে সেটাও একটা আকর্ষণের বিষয় হবে। এভাবে পর্যটক আকর্ষণের জন্য নতুন নতুন ক্রিয়েটিভ আইটেম চালুর ব্যবস্থা করলে সেটা একটা বড় কাজ হবে। অন্যদিকে পর্যটনের উন্নয়নের জন্য রয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। যার কাজ হলো পর্যটন বিষয়ের উপর কাজ করা। পর্যটকদের সুবিধা দেখা। কিন্তু এই সংস্থাটি কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে? যদি করে থাকে তবে দেশে পর্যটনের এতো বেহাল দশা হবে কেন? কেন পর্যটক আকর্ষণে বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। কেন পর্যটনের র্যাংকিং এ বিশ্বের ১৩৬ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ নম্বরে। এমনকি পাকিস্তানেরও নীচে। বাংলাদেশের এমন হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) “ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিযোগিতা সূচক ২০১৭” শীর্ষক প্রতিবেদনে। পর্যটক আকর্ষণে একটি দেশ কতটা নিরাপদ, আইন অবকাঠামো সুবিধা কেমন, বিমানবন্দর কতটা উন্নত, আবাসন ব্যবস্থার মান কেমন-এমন ১৪ টি বিষয়ের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিটি সূচকে সর্বোচ্চ নাম্বার ছিল ৭ ও সর্বনিম্ন নাম্বার ১।একেকটি সূচকের প্রাপ্ত নাম্বার গড় করে একটি দেশের সার্বিক নাম্বার নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি দুই বছর পর পর ডব্লিউইএফ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী পর্যটক আকর্ষণে বিশ্বের ১নং দেশ হলো স্পেন, স্কোর হলো ৫.৪৩। শীর্ষে থাকা অন্যদেশ গুলো হলো যথাক্রমে ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, ইউকে, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি ও কানাডা। বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫, স্কোর ২.৯। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভাল অবস্থানে আছে ভারত, তালিকায় ৪০ নাম্বারে। এ ছাড়া ভুটান ৭৮, নেপাল ১০৩ ও পাকিস্তান ১২৪ নাম্বারে। যে সূচকের ভিত্তিতে এই স্কোর তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বিমান বন্দর অবকাঠামো সুবিধায় ১১৩, অবকাঠামো সূচকে ১৩৩, আবাসন বা হোটেলের মান সূচকে ১৩৫, ভাড়া গাড়ির সেবায় ১২৯, পর্যটন শিল্পের প্রসারে ১২৭, সরকারের অগ্রাধিকার খাত সূচকে ১১১, পর্যটক আকর্ষণের প্রচার প্রচারণা,তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণ,ব্র্যান্ডিং এ ১৩০ এর মধ্যে ১২০ নাম্বারে। বাংলাদেশে পর্যটকদের নিরাপত্তার ঘাটতির বিষয়টিও ডব্লিউইএফ এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১১৭ নাম্বারে। অর্থাৎ পুলিশের সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে পর্যটকেরা আস্থাশীল নন।
সরকারি হিসাবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে এসেছে ৫ লাখ পর্যটক, নেপালে এসেছে ৭লাখ২৯ হাজার, আর ভারতে এসেছে ৯০ লাখ পর্যটক। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এই শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে। অথচ আমরা এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অনুযায়ী পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন করতে পারি নি। অথচ সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫%, তাইওয়ানের ৬৫%, হংকং এর ৫৫%, ফিলিপাইনের ৫০% ও থাইল্যান্ডের ৩০% পর্যটনের অবদান। আর মালদ্বীপের জাতীয় অর্থনীতির অধিকাংশ ও মালয়েশিয়ার জিডিপির ৭% পর্যটন শিল্পের অবদান।
পর্যটন খাতের আয়ের দিক দিয়েও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটন খাতের আয় ৭৬.১৯ মিলিয়ন ডলার,ভারতের আয় ১০,৭২৯ মিলিয়ন ডলার, মালদ্বীপের ৬০২ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কার ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার ও নেপালের ১৯৮ মিলিয়ন ডলার। তবুও ধারণা করা হচ্ছে,২০২৪ সালে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ১.৯% হবে পর্যটন শিল্পের অবদান। যদি এই সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পারি তবে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল। সেই প্রত্যাশায় থাকলাম।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক