সকালে ঘুম থেকে উঠে কর্মস্থলে যাবার পথে পাশের বাড়ির যে ছেলে দুটোকে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেতে দেখতাম তাঁদের দুভাই এর মধ্যে একজন বাবার সবজি বিক্রির ভ্যানের পিছনে ও বড়জন অটো টেম্পোর হেল্পারের কাজে ব্যস্ত। করোনা মহামারীর বিপর্যয়ে বাবা যখন বেসরকারি অফিসের চাকরি হারিয়ে আয় রোজগারের পথ বন্ধ তখন ছেলেমেয়েসহ সাতজনের সংসার চালাতে অন্য কোন উপায় ছিল না তাঁর। কারণ যে সংসারে তেল আনতে নুন ফুরায় সে সংসারে শিক্ষার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। ঠিক তেমনি হাজার হাজার শিশুকে যখন রাস্তার পাশে ইট ভাঙার কাজে, হোটেল রেস্তোরাঁয়, বাসা বাড়ি, অফিস, গাড়ির ওয়ার্কশপের গ্রিল বানানোর মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে দেখি তখন মনে হয় না এদেশের আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ আছে। অথচ বাংলাদেশের শ্রম আইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে চৌদ্দ বছরের নিচে কোন শিশুকে কাজে নিয়োগ করা নিষেধ।
অন্যদিকে করোনা মহামারীর প্রকোপ একদিন না একদিন নিয়ন্ত্রণে আসবে, বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলবে এটা সত্য। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেলেও হয়তো দেখা যাবে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর আর কখনো স্কুলে ফেরা হবে না। এর একমাত্র কারণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের যেখানে খাবার যোগানো মুশকিল সেখানে কিভাবে স্কুলের পাঠদানে রত রাখবেন! আবার বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় বছরশেষে বার্ষিক বেতন, টিউশন ফি, পরীক্ষা রেজিস্ট্রেশন ফি পরিশোধ করে নতুন ক্লাসে যেতে হলে সব মিলিয়ে দুই তিন হাজার টাকা একসাথে পরিশোধ করা অনেক পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই স্কুলের পড়াশোনার পরিবর্তে পরিবারের আর্থিক সংকট মোকাবেলায় অনেক শিক্ষার্থীকে নিষিদ্ধ শিশু আইনের বহির্ভূত বিভিন্ন ঝুকিপূর্ণ কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে।
অথচ, এদের দেখলে সবার মনে এক ধরনের মায়া জন্মে। এসমস্ত নিষ্পাপ শিশুদের মুখের অমলিন হাসি দেখে জগতের যে কারোর হতাশা ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু তাঁরাই আজ অবহেলিত। শ্রমের পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিকভাবে এরা নিয়ত হচ্ছে পর্যুদস্ত। আমরা সভ্যতার জৌলুশ নিয়ে যতই গর্ব করিনা কেন শিশুশ্রম ও অধিকার দিন দিন যে পদদলিত হচ্ছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আমরা জানি, জাতিসংঘের শিশু সনদ অনুসারে এই দেশের প্রত্যেক শিশুদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান ও প্রয়োজনীয় সেবা প্রাপ্তির অধিকার নিহিত আছে। আর এসব নিশ্চয়তার দৃষ্টি সরকারকেই রাখতে হবে। অন্যথা, শিশুশ্রম দিন দিন বাড়তেই থাকবে।