পৃথিবীর বুকে আমার প্রথম পরিচয় আমি একজন মানুষ। তাই আজ ‘ধর্ম যারযার রাষ্ট্র সবার’ এই স্লোগানে মুখর সমগ্র দেশ। পৃথিবীতে কালে কালে যুগে যুগে বারবার ধ্বনিত হয়েছে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নেই” কবি চন্ডীদাসের মত বহু ধর্ম প্রবক্তাসহ জ্ঞানী, গুণী, কবি, সাহিত্যিক, পণ্ডিত, বিজ্ঞ মনীষীগণ সকলেই একযোগে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন, ধারণ করেছেন এবং প্রচার করেছেন। মহাকারুনিক গৌতম বুদ্ধ খ্রিষ্ট পূর্ব ২৫৬৪ অব্দে যখন ব্রাহ্মণ- ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শুদ্র চার শ্রেণির মানুষের চরম জাতিপ্রথার বৈষম্য বিরাজ করছিলো তখনই তিনি সকল ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে তাঁর সাম্যবাদ প্রচার করেছেন, “মানব জন্ম লাভ অতি দুর্লভ ,”জন্মের ধারা কেউ ব্রাহ্মণ হয় না কর্মের দ্বারা ব্রাহ্মণ হয়”। তিনি সর্বতো কামনা করতেন জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। ঠিক তদ্রুপ কোরানে বর্ণিত আছে, ” আশরাফুল মাখলুকাত” অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্ট সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হল মানুষ। তাঁর সৃষ্টি প্রথম মানব হযরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করে তাঁকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় তিনি মানুষকে কতটা উচ্চস্থানে আসীন করেছেন। যদিও ধর্ম মানবজাতিকে শিক্ষা দেয় মানুষে মানুষে শান্তি, সৌহার্দ্য, সমপ্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ, মমত্ববোধ, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সহমর্মিতার, অপরের সুখে সুখী হওয়া এবং অপরের দুঃখে দুখী হওয়ার কিন্তু আমরা তা না করে পৃথিবীর সকল মানবজাতি নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ, হীনমন্যতা, দাম্ভিকতা, অহংকারী, উগ্রতা ও হিংস্র হয়ে নানাভাবে একে ,অন্যের ক্ষতি করে চলেছি। এভাবে মানুষে মানুষে, সমাজে সমাজে, জাতিতে জাতিতে এবং দেশে দেশে মনোকষ্ট, অসন্তোষ, ঝগড়া বিবাদ এমনকি যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছে। “ধর্ম” অর্থ দৃঢ়ভাবে বা দৃঢ়ভক্তিতে ধারণ করা। মানবের সামাজিক, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নৈতিকতার জীবনাচরণের শিক্ষা দিয়ে থাকে ধর্ম। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ধর্ম মানুষকে পূর্ণতা ও পবিত্রতা দান করে। ধর্মচর্চা, অনুশীলন ও অধ্যয়ন মানবজাতির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম ও ধর্মের প্রতিটি বিষয়াদি সর্বক্ষেত্রে সভ্যতার আইন ও নৈতিক বিষয়াদি, সামাজিক কাঠামো, পেশায়, শিল্প ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। এক কথায়, ধর্ম মানুষকে স্থির, প্রজ্ঞাময়, শান্ত, সুখী ও আর্দশিক মানুষ হবার শিক্ষা দান করে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত দার্শনিক জ্যাসপার্সের মতে, ‘মানবতার আধ্যাত্মিক ভিত্তি স্বাধীনভাবে এবং এক সঙ্গে গড়ে উঠে– এই ভিত্তি মানবতার মাঝে এখনও বিদ্যমান রয়েছে’।
অসামপ্রদায়িকতা হলো একটি আদর্শিক মতবাদ যেখানে সকল মানুষে মানুষে পারস্পরিক নৈতিকতা, ভ্রাতৃত্ববোধ সর্বোপরি একাত্মতা রক্ষা করে। সে ব্যক্তি অসামপ্রদায়িক ধারণাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে, নিরপেক্ষভাবে নিজের উদারতা ও সাম্যতা প্রকাশ করে তাকে একজন অসামপ্রদায়িক বা ইংরেজিতে Cosmopolitan বলা হয়। একটি অসামপ্রদায়িক সমপ্রদায় বা সমাজব্যবস্থা সর্বজনীন নৈতিকতা, বিনিময়মূলক অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে রাজনৈতিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। একটি অসামপ্রদায়িক ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্থান বা দেশ থেকে আগমনকারী ব্যক্তিগণ পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরি করেন। যেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে আগমনকারী ব্যক্তিগণ তাদের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মূলনীতি থাকা সত্ত্বেও পারস্পরিক শ্রদ্ধার একটি সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে।
মানুষ ধর্ম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। পরিবেশ, স্থানভেদে যে যেখানে জন্ম গ্রহণ করে সেই স্থানের পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করে। তাই কবির ভাষার ” ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে”। পৃথিবীর সকল শিশুরা পবিত্র ও ফেরেশতাদের মতো এবং তাদের মধ্যে কোন বিভাজন নেই। আমরা বড়রা যা শিখায় তাই তারা শিখে। আমরা বিভিন্ন হিংসাত্মক শব্দের সাথে তাদের পরিচয় করে দিয়ে তাদের ভবিষ্যতকে বিপথগামী করে তুলছি। ওরা হিন্দু, ওরা বৌদ্ধ, এটা হিন্দুদেশ, ওটা মুসলিমদেশ, আস্তিক, নাস্তিক, কাপের বা মালাউন এমন জঘন্যতম শব্দ আর ভেদাভেদ শিশু মন থেকে শুনতে শুনতে তা অন্তরে ধারণ করে।এক সময় এই শিশুরা বড় হয়ে নানা অপকর্ম করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। মন্দির ভাঙা, বৌদ্ধ বিহার পুড়ানো, মসজিদে বোমা ফাটায়, একযোগে পুরো দেশে সিরিজ বোমা ফাটানো, পেট্রোল বোমায় মানুষ খুন করা, আজানের সময় উলুধ্বনি বন্ধ ও ধর্মীয় কথার সময় ভিন্ন ধর্মীদের গালমন্দ করা আরো কত কি!
পৃথিবী নানারঙে বৈচিত্র্যময়। এ বৈচিত্র্যতার মাধ্যমে মানবসভ্যতা সর্বোচ্চ উন্নতির শিখরে উন্নীত হয়েছে। নানা বিশ্বাস, সমপ্রীতি ও সৌহার্দ্যের মাধ্যমে সমপ্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন হয়েছে। সকল মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার নিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। পেশীশক্তি দিয়ে ধনীরা বা বড়রা ছোটদের দাবিয়ে রাখার প্রক্রিয়া পুরো বিশ্বে বিরাজমান। উন্নত বিশ্বেও এরূপ বর্ণপ্রথা ও জাতিগত বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করছে। তা আজও একবিংশ শতাব্দীতে সকলের কাছে দৃশ্যমান। যদিও ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় সামপ্রদায়িকতা ব্রিটিশদের হাতে সৃষ্টি। তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আমাদেরকে একে অন্যের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক চরিত্র তৈরী করে দিয়েছেন তা আজো বহন করে চলেছি। জানিনা আদৌ এর শেষ হবে কবে। এ প্রসঙ্গে লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিল, “হিন্দু-মুসলমানদের ভেতর ঐক্যের গ্রন্থি ছিল একটাই, সেটা হলো ব্রিটিশদের প্রতি ঘৃণা। ঐ ঘৃণাই তাদের পরস্পরকে ঘৃণা করা থেকে নিবৃত্ত করেছে। আমরা চলে যাচ্ছি। এখন থেকে একে অপরকে ঘৃণা করা ছাড়াতো তাদের আর কিছুই করার থাকে না”। সেই কথা এখনো আমাদের চরিত্রে বিদ্যমান। ধর্মের বাণী প্রচার করা, হত্যা করে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা এক কথা নয়। ভারতের সংবিধান অসামপ্রদায়িক চেতনার। সেখানে সব জাতির প্রতি সমান দৃষ্টি রাখার করা বলা হয়েছে। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তার স্বাধীনতা, জাতীয়তা ও সামপ্রদায়িকতা প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ভারত বর্ষ কার – এ প্রশ্নের উত্তরে বহু আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ বিস্মৃত হয়ে যে ভারতবর্ষের সেবা করে ভারতবর্ষ তার, কারণ সেবার দ্বারাই সে তাতে আপন করে তার অভিভাবক হয়ে দাঁড়ায়’। ভারতে মুসলিমবিরোধী অসংখ্য দাঙ্গা চলছে ৬০-৭০ বছর ধরে। বিশেষ করে গুজরাটের দাঙ্গায় কয়েক হাজার মুসলমান হিন্দুদের হাতে নিহত এবং নারীরা ধর্ষিত হয়। ক্ষমতাধর শাসক গোষ্ঠীর তো চিরকালই শোষকের ভূমিকা পালন করে, কখনো সেবক হতে পারেনি। তাই সামপ্রদায়িকতা তাদের কাছে এক শক্ত হাতিয়ার তা ব্যবহার করে আসছে যুগে যুগে কালে কালে।
আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশে বর্ণবাদ একটি চরম বৈষম্য তৈরী করেছে। যা এমন একটি নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি মানবজাতিকে উঁচুনিচু, প্রভু-দাসত্ব শ্রেণিতে বিভাজন করা হয়। কখনো গায়ের রং, কখনো পেশা, গোত্র, অঞ্চল ও ভাষা ইত্যাদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদের মতো জঘন্য প্রথার চর্চা করা হতো। আমেরিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকা এ বর্ণবাদ প্রথার মূল কারণ গায়ের রং। সত্যি কথা, কালো চামড়ার মানুষের উপর সাদা চামড়ার মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও শোষণ। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকান ৪৬ বৎসর বয়স্ক জর্জ ফ্লয়েডকে গ্রেপ্তার করার পর একজন সাদা পুলিশ অফিসার হাঁটু দিয়ে গলা চেপে ধরলে ঐ ব্যক্তির মৃত্যু হলে সংখ্যালঘু বর্ণ সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধে পুলিশের নৃশংসতা প্রমাণ করে। এখানে উল্লেখ যে, লোকটি বারবার “আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না”- বললেও শ্বেতাঙ্গ পুলিশের মন গলেনি। এই মৃত্যুকে ঘিরে কৃষ্ণাঙ্গরা # Black – Lives- Matter নামে আন্দোলন করলে পুলিশের নির্মমতা ও ছিল ভয়াবহ। দেশটিতে পুলিশি নির্মমতার প্রতিক্রিয়ায় ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠা Black Lives Matter অর্থ কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন ও মূল্যবান নামের আন্দোলন। আবার দেখা যায়, ৬ই জানুয়ারি ২০২১ সালে আমেরিকান গণতন্ত্রের সূতিকাগার, আইনসভা কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটাল হিলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের আক্রমণে ২০০০ পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও তাদের তেমন কোন তৎপরতা বা এ্যাকশন চোখে পড়েনি। ২৩০ বৎসরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ক্ষমতায় ঠিকে থাকায় অস্ত্র আর পেশীশক্তির অপব্যবহার দেখলো সারা পৃথিবী যা মার্কিনীদের লজ্জিত করেছে। যদি এ আন্দোলনে কোনও কালো মানুষ থাকতো তাহলে ঘটনাটা অন্যরকম হতো বলে সকল বুদ্ধিজীবীর অভিমত। কালো আর সাদার যে বৈষম্যমূলক আচরণ তা রাষ্ট্র কতৃর্ক স্বীকৃত এতে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি আজ বড় প্রশ্নবোধক হয়ে ধরা দিয়েছে। আমেরিকায় বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ সালে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১০১৪ জন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই কালো চামড়ার কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান আমেরিকান।
মানবতাবাদী প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ভুপেন হাজারিকার কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলি, ‘আমায় একজন সাদা মানুষ দাও যার রক্ত সাদা/ আমায় একজন কালো মানুষ দাও যার রক্ত কালো’।
“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”। আমাদের গৌরব ও চেতনার মূল আদর্শ ছিলো অসামপ্রদায়িক চেতনা। পূর্ব বাংলায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মৃত্যু হবে জেনেও ধর্ম-বর্ন-নির্বিশেষে দেশ মাতৃকাকে বাঁচানোর জন্য নিঃস্বার্থভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার প্রতিটি আবালবৃদ্ধরমণী। তখন ধর্ম বর্ণ কেউ চিন্তা করেনি। তখন জননী জন্মভূমিকে রক্ষা করার জন্য মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ‘লাল-সবুজ’ পতাকার জয় চিনিয়ে এনেছিল। সব মানুষের আত্মত্যাগ আর অসামপ্রদায়িক চেতনার সূত্র ধরে অর্জিত হয়েছে সোনার বাংলার ‘লাল-সবুজ’ পতাকা। কোন ভেদাভেদ নয় – সর্ব ধর্মের মানুষের ভালোবাসার নাম — বাংলাদেশ। সেই মানবপ্রেমিক লালনফকির বলেন, “আসবার কালে কি জাত ছিলে, এসে তুমি কি জাত নিলে / কি জাত হবে যাবার কালে, সে কথা ভেবে বলো না’।
সামপ্রতিক সময়ে চলমান ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যে আঘাত নিশ্চয় জাতি হিসাবে লজ্জার। সামপ্রদায়িকতার আড়ালে একটি গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে বাংলাদেশের মূল চেতনা অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশের সমপ্রীতির ভাবমূর্তি নষ্ট করার পাঁয়তারা করছে। যা অতীতেও বারবার করে আসছে। ২০১২ সালে কঙবাজার রামুতে বৌদ্ধদের বাড়িঘর ও বৌদ্ধ বিহারে হামলার ঘটনা পুরো দেশের ভাবমূর্তি বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে তদ্রূপ ২০১৬ সালের ১লা জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলা ও নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালের ৩০শে অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে রামুর মতো হামলাটি হয় তবে এখানে আক্রান্ত হয় হিন্দু সমপ্রদায়ের মানুষ। প্রায় তিনশো বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। নাসির নগরে এক বছর পর ২০১৭ সালের ১০ই নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়াতে ফেসবুক থেকে ছড়ানো গুজবের জের এক জনের মৃত্যু হয়। অভিযোগ হিন্দু তরুণের ফেসবুক থেকে নবীকে অবমাননা। ২০১৯ সালের জুনে সিলেটের ওসমানী নগরে ঈদের নামাজের পর হিন্দু সমপ্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটে যাচ্ছে অসংখ্য অসংখ্য তথ্য দেওয়া যাবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন থেকে আর চট্টগ্রামে বৌদ্ধ নির্যাতনই হোক দুটোর অমানবিক এবং মানব সভ্যতার পরাজয়। রোহিঙ্গাদের জন্য যদি আমরা মানবিক হতে পারি তাহলে আমাদেরই বাংলাদেশের বৌদ্ধদের জন্য কেন হতে পারিনা? আমরা তো সবাই একই রঙের রক্তের মানুষ। এখানে উল্লেখ করতে চাই, সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর মানুষ কবিতায় সাম্যের জয়গান করেছেন এভাবে : “গাহি সাম্যের গান / মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান/ নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি/ সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি”।
গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের ৪৯ বছর পূর্তিতে আমাদের প্রাণপ্রিয় জননেত্রী গণতন্ত্রের মানসকন্যা, আদর্শের প্রতীক ও বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার দ্ব্যর্থ কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন, ‘অসামপ্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রেখে এই দেশের সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার। কারণ সব ধর্মের মানুষ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে। এ দেশের মাটিতে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই একসঙ্গে বাস করবে। আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অবহেলার চোখে দেখা হবে না। সবাই সমানভাবে ধর্ম পালন করবে’। এমন মানবতাবাদী গুণসম্পন্ন নেতাই পারবে অসামপ্রদায়িক চেতনার সমপ্রীতির বাংলাদেশ উপহার দিতে। জয় হোক এমন জননেতার এই কামনা করি।
হাজার বছর ধরে বাংলার আবহমান কালে সমপ্রীতির ইতিহাস গৌরবের। কারণে অকারণে এর ছন্দপতন হলেও যারা সংখ্যার বেশী তাদের উপরেই দায়িত্ব বর্তাই অন্যরা যারা সংখ্যাই কম তাদের নিরাপত্তা, সাম্য, সুখী সমাজ গড়ার জন্য সমপ্রীতি আর আত্মোপলব্ধি দিয়ে বাংলার শ্যামল মাটিতে প্রত্যেকে সাম্যবোধ, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্ম নিরপেক্ষতা দৃষ্টিভঙ্গি আর চিন্তা-চেতনা-মননে একাত্মতা পোষণ করতে পারলেই – আমাদের ‘লাল-সবুজ’ বিশ্বের কাছে বরাবরের মতো মাথা উঁচু করে আত্মসম্মান নিয়ে অসামপ্রদায়িকতার বাংলাদেশের গৌরব অর্জন করেছে এবং করবে ভবিষ্যতে। অশুভ সামপ্রদায়িক শক্তি নিপাত যাক। নিপাত যাক সামপ্রদায়িক উগ্রতা। অসামপ্রদায়িকতার বাংলাদেশের জয় হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী











