[ভূমিকা : ক্রাউন পাবলিশিং থেকে সমপ্রতি প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার লেখা স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘আ প্রমিজ্ড্ল্যান্ড’। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ের এক পর্বে তিনি লিখেছেন তার জীবনে প্রভাববিস্তারী অন্যতম নারী, তার নানিকে নিয়ে; যাকে ওবামা ডাকতেন টুট। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগের দিন তিনি মারা গিয়েছিলেন। ওবামার সেই স্মৃতির অংশটুকু অনুবাদ করেছেন ফারহানা আনন্দময়ী।]
অক্টোবরের এক্কেবারে শেষের দিনগুলোতে নির্বাচনী প্রচারণার সংবাদের বাইরে একটি খবর খুব বিষাদী করে তুলেছিল আমাকে। মায়া ফোন করে আমাকে বললো, ডাক্তাররা বলেছেন টুট বোধহয় আর বেশিদিন বাঁচবেন না, এমন কী আগামী সপ্তাহটা-ও তিনি কাটাতে পারবেন কিনা, এই নিয়ে ডাক্তাররা সংশয়ে আছেন। নিজের বাসাতে লিভিংরুমেই হাসপাতালের বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেখানে তিনি এখন আছেন। একজন প্রশিক্ষিত সেবিকা ওকে দিনরাত দেখাশোনা করছেন, ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে টুটকে খানিকটা ভালো রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। মায়া এটাও বললো, গতসন্ধ্যায় যদিও বা হঠাৎই তিনি একটু জ্ঞানে ফিরেছিলেন। মায়ার কাছে ওয়াইন আর সিগারেট চেয়েছেন আর আমার নির্বাচনের খবর জানতে চেয়েছিলেন। এরপর আবার কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন, চেতনা হারিয়েছেন।
নির্বাচনের বারোদিন আগে অনির্ধারিতভাবে ছত্রিশ ঘন্টার জন্য আমি হনলুলুতে যাবার জন্য মনস্থির করলাম। টুটকে বিদায় জানাতেই যাওয়া আমার। টুট-এর ঘরে পৌঁছে আমি দেখলাম মায়া অপেক্ষা করছে আমার জন্য। একটা সোফায় ও বসে ছিল, সামনে কতগুলো জুতোর বাঙ সাজানো; তার মধ্যে আমাদের ছোটবেলার অনেকগুলো ছবি, চিঠিপত্তর রাখা। “আমার মনে হলো, তুমি হয়তো কিছু স্মৃতি তোমার নিজের কাছে রাখতে চাইতে পারো। দ্যাখো, বেছে নাও তুমি”। মায়া বললো আমাকে। সেখান থেকে কয়েকটা ছবি আমি নিলাম। ইয়েসোমাইটের কোনো এক সবুজ ঘাসের মাঠে টুট আর গ্রাম্পস-এর সাথে আমার আট-বছর বয়সী মা, হাসছেন। আরেকটা ছবিতে চার-পাঁচ বছরের আমি, গ্রাম্পস-এর ঘাড়ে চড়ে বসে আছি, জলের ঢেউয়ের ছাঁট এসে আমাদেরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। টুট, গ্রাম্পস, আমি আর মায়া, মায়া তখন ছোট্ট মেয়েটি, আমরা চারজনই খুব হাসছি একটা ক্রিসমাস গাছের সামনে দাঁড়িয়ে… এই ছবিটাও নিলাম আমি সাথে। মায়া আমার সৎ-বোন, কিন্তু আমাদের শৈশবের স্মৃতিগুলো তো বড্ড আপন।
এবার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলাম টুট-এর বিছানার কাছে। আমার মুঠোর মধ্যে ভরে নিলাম টুটের শীর্ণ হাতটি। তার শরীর ভেঙে গেছে, শরীর গুটিয়ে গেছে, কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার শ্বাস নিতে। ছোট্ট একটা শ্বাস নিতে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে। ঘড়ঘড় করে আওয়াজ হচ্ছে টুটের প্রতিটা কাশিতে, গ্রাইন্ডার মেশিনের মতো। প্রতিবারই ওর শরীর কেঁপেকেঁপে উঠছে কাশির দমকে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল টুট, দুর্বল চেষ্টা, ফিসফিস আওয়াজ বেরোচ্ছে শুধু মুখ দিয়ে। তার কথার কোনোটাই আমি বুঝতে পারলাম না।
এরকম সময়গুলোতে টুট কি কোনো স্বপ্ন দেখতে পারে? কিংবা স্মৃতিপথে ফিরে অতীতের কোনো সুখময় মুহূর্ত মনে করতে পারে, যা তাকে কোনো একদিন গভীর আনন্দ দিয়েছিল? আমিই বরং ভাবতে শুরু করলাম, টুট হয়তো তার প্রথম প্রেমিকের মুখটা মনে করছে কিংবা তার তারুণ্যের কোনো এক সুর্যালোকিত সকালকে! যে সকাল তাকে দিয়েছিল এক নতুন দিনের দিশা, পথ দেখিয়েছিল ভালোবাসাময় এক অঙ্গীকারের দিকে। স্মৃতি হাতড়ে আমি মনে করার চেষ্টা করলাম, টুটের সাথে আমার সেই কথোপকথনটা। তখন আমি হাইস্কুলে পড়তাম, টুট পিঠের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলো, দীর্ঘক্ষণ হাঁটার সময়ে ব্যথায় কেমন নুয়ে পড়তো।
একদিন আমাকে টুট বলেছিল, “বার, বয়স বেড়ে যাবার যন্ত্রণাটা কী, তুমি জানো? তোমার শরীরের অঙ্গগুলো বীভৎস এক অকেজো কলকব্জায় রূপ নেবে, কিন্তু তুমি ভেতরে সেই আগের একই মানুষ রয়ে যাবে”। স্পষ্ট মনে আছে আমার, তার কথা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছি কিনা এটা বুঝতে ওর বাইফোকাল চশমার পুরু কাচের ভেতর থেকে আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। “তখনও ভেতরে তুমি সেই একই মানুষ রয়ে যাবে। তুমি কি বুঝতে পারলে আমার কথাটা?”
টুট, এত বছর পরে এসে আজ বোধহয় খানিকটা বুঝলাম।
সেই বিকেলে কয়েকটা ঘন্টা আমি টুটের হাতটা ধরেই বসে রইলাম। টুটের শুকনো, হাড্ডিসার হাতের উপরে হাত বুলোতে বুলোতে মায়ার সাথে কথা বলছিলাম। ওর কাজের কথা, ওর পরিবারের কথা। টুটের হাতের স্পর্শ আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, হাজারো স্মৃতি। মায়ের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া যাবার আগে আমার সম্পূর্ণ শৈশব, কৈশোরই তো কেটেছে টুট আর গ্রাম্পস-এর সাথে। সেই মুহূর্তে পুরো ঘরটা যেন সেই সমস্ত দিনের স্মৃতিতে ভরে যেতে থাকলো, ঘরের আলোতে, বাতাসে অজস্র স্মৃতিরা দোল খেতে লাগলো, মিশে যেতে লাগলো। একে অপরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আবার ছিটকে যেতে থাকলো টুকরো টুকরো হয়ে। কালাইডোস্কোপে যেমন দেখা যায়, অনেকটা তেমনই। মায়াকে বললাম, আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসতে চাই। গিব্স এবং আমার নিরাপত্তা প্রহরীদের সাথে আলোচনা করে এলিভেটর ধরে সোজা বেজমেন্টে নেমে গেলাম। নিচে অপেক্ষারত সাংবাদিকরা যেন এই খবর না পায়, সেটা ওরা নিশ্চিত করবে বললো। গারাজের পাশ দিয়ে বেরিয়ে আমার নানা-নানীর অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটা পেছনে রেখে, সরু রাস্তাটা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম আমি।
এই রাস্তা আমার অনেকদিনের খুব চেনা। তবে আজ পয়ত্রিশ বছর পরে এসে অনেকটাই অচেনা লাগছে। এগুতে থাকলাম সেই ছোট্ট শিন্টো মন্দিরটা পেছনে রেখে, কমিউনিটি সেন্টারটা পাশে ফেলে। দু’ধার দিয়ে অনেকগুলো ছোট ছোট কাঠের বাড়ি ছিল। সেসব ভেঙেচুরে এখন দু-তিনতলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন উঠেছে। দশ বছর বয়স যখন আমার, বাবা একটা বাস্কেটবল দিয়েছিল আমাকে। বাবার সাথে খুব অল্প কিছু স্মৃতির মধ্যে সেটিও একটি। এই রাস্তা দিয়ে আমি এলেমেন্টারি স্কুলে যেতাম, বাস্কেটবল মাঠে যেতাম। আমার মনে আছে, অসমান এই রাস্তার দিয়ে আসা-যাওয়ার পুরোটা সময়ে সেই বলটা আমি বাউন্স করতাম। টুট ঠিকই বুঝতে পারতো আমি কখন ঘরে ফিরছি। টুট আমাকে বলতো, তোমার পুরনো এই বলটা বাউন্স করার ধপধপ আওয়াজ আমি দশতলার উপর থেকেও শুনতে পাই। এই রাস্তা ধরেই তো আমি দৌড়ে যেতাম সুপার-মার্কেটে। টুটের সিগারেট কিনতে পাঠাতো আমাকে, আর বলে দিতো, আমি যদি দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসতে পারি ঘরে, তাহলে বাকি খুচরো পয়সা দিয়ে ক্যান্ডি কিনতে পারবো আমার জন্য। কত স্মৃতি আমার, এই রাস্তাটায়। পনেরো বছরের আমি প্রথম নিজে আয় করার একটা কাজ পেয়েছিলাম। এই রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে বাসকিন-রবিন্সনের আইসক্রিম বিক্রি করার কাজ। সপ্তাহশেষে আমার পে-চেকটা হাতে নিয়ে আমি যখন মন খারাপ করতাম, খুব হাসতো টুট, আমাকে দেখে। মমতামাখা সেই হাসি!
সে ছিল এক অন্য সময়। অন্য এক জীবন আমার। বাকি পৃথিবীর কিছুই যেত-আসতো না, আমি কী করছি তা নিয়ে। পৃথিবীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই তখন। শুধু টুটের এই ভালোবাসাটুকুর কাছেই আমার এক বিশেষ জায়গা ছিল। টুট পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে যেতে সাথে করে নিয়ে যাবে আমার শৈশবের আমিকে। টুট ছাড়া আর কারো স্মৃতিতে তো সেই আমিটা নেই। কে আর স্মরণ করবে আমার শৈশব!
চারটা ব্লক ঘুরে ফিরতে ফিরতে বুঝতে পারলাম, সংবাদকর্মীরা খবর পেয়ে গেছেন আমার এই অনির্ধারিত এবং অনেকটা লুকিয়ে বাইরে বেরনোর বিষয়ে। তারা রাস্তার দু’ধারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন, মাইক্রোফোন, ক্যামেরা এসব গোছগাছ করছিলেন চালু করবার আশায়। তবে ভাগ্য ভালো বলতে হবে আমার! ভবনের নিচে অপেক্ষমান সাংবাদিকরাও খুব পরিশীলিত আচরণ করলেন সেই সন্ধ্যায়। তারা কিচ্ছুটি জিজ্ঞেস করেননি আমাকে। তাদেরকে হাত নেড়ে আবার আমি গারাজে ফিরে গেলাম। সেখানে আবার যাবার কোনো অর্থ হয় না আমি জানি, তবু গেলাম। অনুভব করছিলাম আমি, যা ফিরে পেতে আমি সেখানে গেলাম, তা আর নেই সেখানে!
পরদিন হাওয়াই ছেড়ে ফিরে গেলাম নিজের কাজে। ঠিক আটদিন পর, নির্বাচনের আগের সন্ধ্যায় মায়া জানালো, টুট আমাদেরকে ছেড়ে যাত্রা করেছেন অনন্তলোকে। এটাই ছিল আমাদের প্রচারণার শেষদিন। নির্বাচনী বক্তৃতা দেবার জন্য নর্থ ক্যারোলাইনাতে ছিলাম সেদিন আমরা। এরপর যাবার কথা ভার্জিনিয়া, শেষ ইভেন্ট সেখানে। অনুষ্ঠানস্থলে যাবার আগে অ্যাঙ খুব শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলো আমাকে, “বক্তৃতার প্রথমে তুমি কি বিশেষ কোনো কথা যোগ করতে চাও তোমার মাতামহীর মৃত্যু নিয়ে? বললে আমরা লিখে নিতে পারি”। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, “না। আমি জানি আমি কী বলতে চাই”।
হালকা বৃষ্টি হচ্ছিলো সেই সন্ধ্যায়, মিষ্টি শীতল বাতাস চারপাশ জুড়ে। সমবেত সমর্থকদের গান-বাজনা, হর্ষধ্বনি ধীরে ধীরে থেমে এলো একসময়। বাইরের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি আমি, নিজেকে প্রস্তুত করছি, অপেক্ষমান সবাইকে কিছু বলবো। বলবো আমার টুটের কথা। গ্রাম্পস যখন যুদ্ধে গেছেন, ভীষণ অবসাদের কাল তখন চলছে পুরো আমেরিকা জুড়ে। সেই সময়ে টুট পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে শক্ত হয়ে পরিবারের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কী কঠিন পরিশ্রম করতো কারখানার কাজে! আমি আজ বলবো সেইসব কথা, আমাদের পরিবারের কাছে টুট কতটা মূল্যবান এবং অর্থপূর্ণ।
বলতে শুরু করলাম আমি, “তিনি হলেন নীরব একজন বীর। এরকম অনেক বীর আমেরিকা জুড়ে আছেন। তারা কেউ বিখ্যাত নন। সংবাদপত্রের শিরোনামে তাদের নাম ছাপা হয় না। কিন্তু প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত তারা পরিশ্রম করে চলেছেন নিজ পরিবারের জন্য। তাদের পরিশ্রম, তাদের এই ত্যাগ, তাদের সন্তান আর নাতি-নাতনিদেরকে ভালো রাখার জন্য। তাদেরকে নিয়ে মানুষ হইচই করুক, তারা তা চান না। তারা শুধু নিঃশব্দে নিজের কাজটা করে যান। সঠিক কাজটা করে চলেছেন নিজের মতো ক’রে”।
“আজ এখানে যারা সমবেত হয়েছেন, এদের মধ্যেও রয়েছে অজগ্র নীরব যোদ্ধা, নীরব বীর। রয়েছেন অসংখ্য মা-বাবা, তাদের মা-বাবা… যারা সারাজীবন এক লড়াই লড়ে চলেছেন। এক মুহূর্তের বিরাম নেই তাদের। তাদের সন্তান, সন্তানদের সন্তানরা সকলেই একটা উজ্জ্বল, আনন্দময় জীবন যাপন করছেন… এটা দেখতেই তাদের তৃপ্তি। এটাই হলো আমাদের আমেরিকা। এবং এরকম একটা আমেরিকাকে রেখে যাওয়ার জন্যই আমাদের আজকের এই লড়াই”।
বক্তৃতাটা শেষ করার পরে মনে হয়েছিল আমার, নির্বাচনী প্রচারণার সর্বশেষ বক্তৃতাটা ঠিক এরকমই হওয়া উচিত। শেষটা এর চেয়ে অর্থপূর্ণ আর কী-ই বা হতে পারতো।
ফারহানা আনন্দময়ী : কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক