‘মাস্টারদা, আপনি কি হাতঘড়ি পরতেন কখনো?
এই প্রশ্ন আমাকে ঠোকর মেরেছে
অনেকবার। মাস্টারদা, আপনার বিষয়ে
অনেক কিছুই জানা আছে আমার।’- শামসুর রাহমান
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার চট্টগ্রামের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন কিংবদন্তি পুরুষ জে.এম. সেন-এর বাড়ি দখলের খবরে চট্টগ্রাম সিটি কপোরেশনের প্রশাসক জনাব খোরশেদ আলম সুজন বলেছেন, ‘ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা যাত্রা মোহন সেনগুপ্তের দেড়’শ বছরের পুরনো বাড়িটি শুধু আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষার স্থান না। এটি বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের সাহসী তরুণের সাহসী ঠিকানা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা জে এম সেনের বাড়ি দখলের চেষ্টা জাতিসত্তার ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র’। উদ্বেগজনক এই প্রতিক্রিয়া পাঠ করে মনে পড়ে, নিকট কিংবা দূর অতীতের নানান সব ষড়যন্ত্রের কথা। এই ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করছে প্রতিনিয়ত। তারা ইতিহাসের দ্বার উদঘাটন করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে। এভাবেই পালাবদল আর পদাঙ্ক অনুসরণের ইতিহাস রচিত হচ্ছে। ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে নিয়মিত। আজকের দিনেও ষড়যন্ত্রকারীদের এমন আস্ফালন দেখে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসির দিবসে (১২ জানুয়ারি) ভয়ার্ত কন্ঠে উচ্চারণ করতে বাধ্য হই,মাস্টারদা সূর্যসেনকে যেন ভুলে না যাই।
গত শতকের তৃতীয় দশকে বিশাল সাম্রাজ্যের নৃপতি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিপ্লবী সূর্যসেনের নেতৃত্বে মাত্র ৬৩ জন তরুণ সমগ্র চট্টগ্রামকে তিনদিনের জন্য ব্রিটিশ রাজশক্তির নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মহানায়ক সূর্যসেন এবং ত্যাগী সাথীদের সেই গৌরবোজ্জ্বল বীরগাথা আজ আর আমাদের ইতিহাসে নেই।
১৮৯৩ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রাম জেলার নোয়াপাড়া গ্রামে যুব বিদ্রোহের প্রাণপুরুষ সূর্যসেন জন্মগ্রহণ করেন। সূর্যসেন ছেলেবেলা থেকেই লেখাপড়ায় খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময়ে তিনি বিপ্লবী দলের খবরাখবর রাখতেন। গোপনে ব্রিটিশ সরকারের বেআইনী ঘোষিত রাজনৈতিক বই পড়তেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯১৬-১৭ সালে তিনি প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবী দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
সূর্যসেন অম্বিকা চক্রবর্তীর সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানজী পুকুর পাড়ে ‘শান্তি আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করে এখানেই থাকতেন। প্রথম দিকে ওটাই ছিল তাঁর ঠিকানা। এ সময় এখানে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা নিয়মিত আসতেন। কোলকাতায় পত্রিকা সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বিপ্লবীরা অনুশীলন আর যুগান্তর দলে বিভক্ত হয়ে পড়লে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা কোনো পক্ষে না গিয়ে স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অচিরেই বিপ্লবী চারু দত্ত ভিন্নমত পোষণ করে চট্টগ্রামে অনুশীলন দলের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা ঘোষণা করেন। এতে বিক্ষুব্ধ অপর বিপ্লবীরা সূর্যসেনকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। সূর্যসেন চারুদত্তকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদিন পর অবশ্য অন্যদের নিয়ে যুগান্তর দলে যোগদান করেন। অনুশীলন ও যুগান্তর দলের এই বিভক্তি ছিল অনেকাংশে ব্যক্তিত্বের সংঘাত। আদর্শ এখানে তেমন কোনো মুখ্য বিষয় ছিল না। আর এই বিভক্তিকে কেন্দ্র করে ঐ সময় দুপক্ষের মধ্যে অনেক সংঘর্ষও হয়। চট্টগ্রামেও এর প্রভাব পড়ে। দুপক্ষের সংঘর্ষে এক বিপ্লবীর মৃত্যুও ঘটে।
সশস্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ রাজশক্তিকে পরাজিত করার প্রত্যয়ে সূর্যসেন আন্দোলন সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। তিনি এই সশস্র আন্দোলনের সূচনা হিসাবে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামির কাছে নাগর পাহাড়ে প্রথমবারের মতো পুলিশের সঙ্গে খণ্ড যুদ্ধে অংশ নেন। নাগর পাহাড়ের খুব কাছাকাছি জালালাবাদ পাহাড়ে এর সাতবছর পর মাস্টারদা সূর্যসেন আর চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তাই নাগর পাহাড়ের এই খণ্ড যুদ্ধকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের (জালালাবাদ যুদ্ধ) মহড়া হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।
নাগর পাহাড়ের এই খণ্ড যুদ্ধে সূর্যসেন অম্বিকা চক্রবর্তীসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সেবার তাঁদের বেশিদিন জেল ঝবিন ভোগ করতে হয়নি। লব্ধ প্রতিষ্ঠিত ব্যারিস্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের সূক্ষ্ম আইন জ্ঞান ও তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তায় পরিচালিত মামলায় সূর্যসেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী নিঃশর্ত মুক্তি লাভ করেন।
মাস্টারদা সূর্যসেন তৎকালীন সময়ে ভারতীয় কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও গান্ধী ঘোষিত অহিংস রাজনীতির ভাবধারার বিরোধী ছিলেন। সে ক্ষেত্রে নেতাজী সুভাস বসুর অনুসৃত নীতির প্রতি তাঁর অকুন্ঠ সমর্থন ছিল। যুগান্তর ও অনুশীলন দলকে কেন্দ্র করে অচিরেই বাংলার কংগ্রেস চরমপন্থী ও নরমপন্থী গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যুগান্তর সমর্থন চরমপন্থী দলের নেতৃত্বে ছিলেন সুভাস বসু এবং দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেন নরমপন্থী দলের নেতৃত্বে ছিলেন।
১৯৩০ সালে ১৮ এপ্রিল শুক্রবার গুড ফ্রাইডে। এদিন চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা মাস্টারদার নেতৃত্বে দেশমাতৃকাকে সাম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করতে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। ১৮ এপ্রিল সকালে জেলা কংগ্রেস অফিসে বিপ্লবীরা ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে সর্বাধিনায়ক সূর্যসেনের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। মাস্টারদা জানালেন, রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে আক্রমণ শুরু হবে। এখানেই ঠিক হলো অনন্ত সিংহ আর গনেশ ঘোষের নেতৃত্বে গনেশ ঘোষের বাসা থেকেই পুলিশ আর্মারি আক্রমণ করবে। রেলওয়ে আর্মারি নির্মল সেন আর লোকনাথ বলের নেতৃত্বে লোকনাথ বলের বাসা থেকে মোটর যোগে যাত্রা করবেন। সফল আক্রমণ শেষে গভীর রাতে বিজয়ীরা ফিরে আসলে স্বাধীন চট্টগ্রামের জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়। লোকনাথ বলের নেতৃত্বে দলের সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এসসময় সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা একটি সামরিক বিবৃতি পাঠ করেন।
এরপর নানান ঘটনার প্রেক্ষিতে বিপ্লবীরা একের পর এক স্থান ত্যাগ করে অবশেষে জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। আসে ঐতিহাসিক ২২ এপ্রিল। এদিন মাস্টারদার নির্দেশে বিপ্লবী লোকনাথ বলের অধিনায়কত্বে ইংরেজদের সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় বিপ্লবী বাহিনী। সারদিনের তুমুল লড়াই শেষে ব্রিটিশ বাহিনীকে সেদিন পিছু হটতে হয়েছে। এ যুদ্ধে ১৩ জন বিপ্লবী শহীদ হন। এঁরা হলেন : হরিগোপাল বল (টেগরা), প্রভাস বল, মতি কানুনগো, শশাঙ্ক দত্ত, নির্মল লালা, জীতেন্দ্র দাশগুপ্ত,মধু দত্ত, পুলিন ঘোষ, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন, বিধু ভট্টাচার্য্য ও অর্ধেন্দু দস্তিদার (তিনি গুরুতর আহত হলে পরের দিন ২৩ এপ্রিল মারা যান)। আত্মসমর্পণের পরিবর্তে অমরেন্দ্র নন্দী আত্মহননের পথ বেছে নেন ২৪ এপ্রিল। এই সময় বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী এবং বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী গুরুতর আহত হন। এরপর আবার শুরু হলো মাস্টারদার পলাতক জীবন। এই পলাতক জীবন যাপনের সময়ে বিপ্লবীরা মাস্টারদা সূর্যসেনের নির্দেশে আরও একাধিক বার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এর মধ্যে অন্যতম হলো ৬ মে ১৯৩০ সালে কালারপোল যুদ্ধ-এতে শহীদ হন স্বদেশ রায়, রজত সেন, মনোরঞ্জন সেন ও দেব প্রসাদ গুপ্ত; ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে আত্মাহুতি প্রদান করেন।
১৯৩৩ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি গৈরলা যুদ্ধে মাস্টারদা ইংরেজ বাহিনীর হাতে বন্ধী হন। বিপ্লবী রঞ্জন সেনের বড় ভাই নেত্র সেন ব্রিটিশ ঘোষিত পনের হাজার টাকার লোভে পুলিশে খবর দেয়। বাংলার ইতিহাসকে আর একজন মীরজাফর সামান্য অর্থের লোভে কলঙ্কিত করল। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মাস্টারদা সূর্যসেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে হত্যা করে। ফাঁসিতে হত্যার পর দুজনের মৃতদেহ গোপনে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া হয়। মাস্টারদাকে যখন ফাঁসিতে ঝুলানো হয়, তখন চট্টগ্রাম কারাগারের সব বিপ্লবীরা ইনকিলাব জিন্দাবাদ, স্বাধীন ভারত কি জয়, মাস্টারদা জিন্দাবাদ- স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলে।
তখন মাস্টারদা দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন-‘বন্ধুগণ বিদায়, চিরবিদায়। বিপ্লবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে। বন্দে মাতরম, ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’ বিপ্লবীরাও তাঁর সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে তাঁকে বিদায় জানায় নিজ নিজ অন্ধ প্রকোষ্ঠ থেকে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এভাবে বিদায় জানানোর জন্য কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। কেউ জানত না সমস্বরে একই আওয়াজ বের হবে বন্ধীদের কন্ঠ থেকে। এমনকি এটা বন্দীরাও একে অপরকে আগে জানিয়ে রাখেনি। এর আগে লোকনাথ বল এবং অন্য বিপ্লবীদের বিচারে দীপান্তর সাজা হয়ে এদের বন্দী অবস্থায় আন্দামানে পাঠানো হয়। এভাবেই একটি সম্ভাবনাময় বিপ্লবের যবনিকাপাত ঘটল। সূর্যসেনের নেতৃত্বে নেতৃত্বে চট্টগ্রামের এই বিপ্লবী বাহিনী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দৃঢ়ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল বটে কিন্তু চট্টগ্রামের ঐ বিপ্লবী বাহিনী পরিপূর্ণ কোনো রাজনৈতিক অবয়ব পায়নি সাংগঠনিক শক্তির অভাবে। এই ব্যর্থতা তখনকার ভারতবর্ষের আপনকামী নেতৃত্বের আর অবিকশিত কমিউনিস্ট আন্দোলনের। তবু সূর্যসেনের নেতৃত্বের স্বাধীন চট্টগ্রাম ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তকে উজ্জীবিত করেছে স্বাধীনতার মন্ত্রে। যদিও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আপস ফর্মলা প্রসবিত ফসল। তবু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আলোচনার টেবিলে আনার জন্য বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
লেখক : গল্পকার প্রাবন্ধিক, গবেষক