শহরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্ধারিত ৭৭৭টি স্পট আছে। যেখানে রাত-দিনের বেশিরভাগ সময় ময়লা-আর্বজনা পড়ে থাকে। যা দূষিত করছে আশেপাশের পরিবেশ। স্পটগুলোর মধ্যে ২৬৩টি জায়গায় কংক্রিটের তৈরি খোলা ডাস্টবিন আছে। বাকি ৫১৪টি স্পটে কোনো ডাস্টবিন নেই। সেখানে উন্মুক্ত স্থানেই ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। এর বাইরে আরো ১০৫টি স্পটে প্লাস্টিক ও কন্টেনারের অস্থায়ী ডাস্টবিন আছে, সেখানেও ময়লা-আবর্জনা জমে থাকে। অথচ ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে ভোর ছয়টার মধ্যে ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করার নতুন সময়সূচী নির্ধারণ করেছিল চসিক। ২০১৭ সালে ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্প শুরু করে চসিক। ওই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তিন ধাপে কার্যকর হওয়া প্রকল্পটির আওতায় বিকেল ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত প্রতিটি বাসাবাড়ি থেকে সরাসরি ময়লা সংগ্রহ করার কথা। এজন্য ৯ লক্ষ ছোট বিন ও ৩ হাজার ৪৩০টি বড় বিন বাসা বাড়ি, শিক্ষা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করে। বর্তমানে প্রকল্পটির কার্যক্রম গতি হারিয়েছে। এছাড়া গত চার বছরে শহরের প্রতিটি এলাকা প্রকল্পের আওতায় আসেনি। চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের হিসাবে জালালাবাদ, পশ্চিম ষোলশহর, মোহরা ও পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকাসহ শহরের ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ বাসাবাড়ি ডোর টু ডোর প্রকল্পের আওতায় আসেনি। সেখানে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বর্জ্য সংগ্রহ করে। তবে চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলছেন, এখনো ৫০ শতাংশ এলাকায় ডোর টু ডোর কার্যক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
এদিকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর সিএমপি থেকে চসিক প্রশাসককে দেয়া একটি চিঠিতে রাত ১১ টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শেষ করার অনুরোধ করা হয়। এছাড়া সিটি কর্পোরেশনের ভাসমান ডাস্টবিন, স্তুপাকারে থাকা ময়লা ও আর্বজনা ভর্তি কন্টেনারের কারণে যান চলাচলে ব্যাঘাতসহ ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয় বলে উল্লেখ করা হয়।
‘ডোর টু ডোর’ কার্যক্রমে ধীরগতি এবং যত্রতত্র রাত-দিন ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকায় ক্ষোভ আছে নগরবাসীর। সাইফুল আলম নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, সিটি কর্পোরেশনের প্রধান কাজগুলোর অন্যতম বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। কিন্তু এ খাতে কোনো সময় শতভাগ বা কাছাকাছি সাফল্য দেখাতে পারেননি অতীতের কোনো মেয়র বা প্রশাসক। অবশ্য নিজেদের মত করে তারা চেষ্টা করেছেন।
এ অবস্থায় ঘনিয়ে আসছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। নগরবাসীর প্রত্যাশা পরিচ্ছন্ন শহর গড়ার জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন নতুন মেয়র। যদিও বিষয়টি হবে তার জন্য চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত আগামীর মেয়র? সেই প্রশ্নও আছে নগরবাসীর।
যদিও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে আইনি বাধ্যবাধ্যকতা আছে মেয়রের ওপর। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ এর তৃতীয় তফসীল এর ১ দশমিক ৪ থেকে ১ দশামক ৭ পর্যন্ত অনুচ্ছেদে আর্বজনা অপসারণ, সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া আছে। এতে উল্লেখ আছে, ‘কর্পোরেশন তার নিয়ন্ত্রণাধীন সকল জনপথ, সাধারণ পায়খানা, প্রস্রাবখানা, নর্দমা, ইমারত ও জায়গা থেকে আবর্জনা সংগ্রহ ও অপসারণ করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কর্পোরেশন নগরবাসীর জন্য নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলার ব্যবস্থা করবে এবং সাধারণ নোটিশের মাধ্যমে ওখানে ময়লা ফেলার জন্য নির্দেশ দিতে পারবে’। এছাড়া আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, নগরে দৈনিক গড়ে ১৮শ থেকে সাড়ে ১৮ শ টন বর্জ্য অপসারণ করে চসিক। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি এক হাজার ৮৪১ টন অপসারণ করা হয়। এর আগে ৮ জানুয়ারি ১ হাজার ৮৩৫ এবং ৩০ ডিসেম্বর ১৮ শ টন অপসারণ করা হয়েছিল।
মেয়র প্রার্থীরা কি বলছেন :
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এম রেজাউলি করিম চৌধুরী বলেন, ময়লা-আবর্জনা দূর করার জন্য যে ডোর টু ডোর কার্যক্রম এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে এটিতে অব্যবস্থাপনাও রয়েছে। এ কার্যক্রমে প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণ জনবল থাকলেও অর্থের অপচয় হচ্ছে এবং জনগণ প্রকৃত সেবা পাচ্ছে না। তবে এটাও সত্য যে শহরের বিভিন্ন জায়গায় আগে যে আবর্জনার স্তূপগুলো দেখা যেত এখন সেটা অনেক কমে গেছে, কিন্তু অলিগলিতে এখনও রয়ে গেছে। তাই মানুষ দুর্গন্ধে একটা অসহনীয় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আমার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা আছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমি আধুনিকায়নের পক্ষে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ভ্যাকুয়াম স্যুইপার মেশিন দিয়ে আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনে এ মেশিনটি সরবরাহ করেছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গতি সঞ্চার করতে এটি কার্যকর। চসিকের পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়োজিতদের সকল অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা দূর করে সুষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে এ সেবাটি আমি নিশ্চিত করতে চাই। আমাদের সেবক কাজে যারা নিয়োজিত তাদের জীবনমান উন্নত করতে হবে। তাদের বাসস্থান, সন্তানদের শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থসেবা উন্নত করতে হবে। তাহলেই তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করা সম্ভব।
তিনি বলেন, আবর্জনা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন সম্ভব। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে কোন প্রতিষ্ঠান যদি আবর্জনা পরিষ্কার করতে চায় তাও কার্যকর করার বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতামতের মাধ্যমে বিবেচনা করা যায় কিনা সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তবে শহর পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে নগরবাসীরও কিছু ভূমিকা আছে। যত্রতত্র ময়লা ফেলা ও সৌন্দর্যহানিকর কাজ করা থেকে আমাদেরকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে এই শহর আমাদের সবার। আমি পরিচ্ছন্ন ও নান্দনিক সৌন্দর্যে এই মহানগর গড়ে তুলতে চাই।
বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমার পরিকল্পনা আছে। যেমন প্রত্যেক ঘরে দুটো বিন দেয়া-একটিতে নষ্ট খাবার ফেলার জন্য আর আরেকটিতে অপচনশীল প্লাস্টিক, কাঁচ ইত্যাদি দ্রব্য ফেলার জন্য। তাহলে পচনশীল দ্রব্য থেকে জৈব সার তৈরি করা যাবে। আর পচনশীল নয় এমন দ্রব্যগুলোকে রিসাইকেল করে তৈরি করা যাবে একই পদার্থের নতুন দ্রব্য। এর মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনের আয় বৃদ্ধি পাবে। এভাবেই সিটি কর্পোরেশনকে স্বাবলম্বী করতে আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নেব।
এ মেয়র প্রার্থী বলেন, অনেক উন্নত দেশের আদলে প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে রিসাইক্লিং করার জন্য মেশিন বসানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বেসরকারি কোনো সংস্থাকে নিয়োগ দিলে তারাই করবে। তারা যা আয় করবে তার একটি অংশ সিটি কর্পোরেশকে পরিশোধ করবে। তাহলে আর্থিকভাবে কর্পোরেশন লাভবান হবে সাথে শৃঙ্খলা আসবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চেষ্টা দীর্ঘদিনের :
দাতা সংস্থা ‘জাইকা’র পরামর্শে চসিকের প্রকৌশল, পরিকল্পনা ও পরিচ্ছন্ন বিভাগের সমন্বয়ে ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ১২ সদস্যের ‘ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সেল’ গঠন করে চসিক। যদিও গত প্রায় আড়াই বছরে ওই সেলের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। এছাড়া ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে জলবল কাঠামোয় ‘বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’ নামে একটি বিভাগ চালুর প্রস্তাব করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। সেটিও অনুমোদন হয়নি।
কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে রাতের বেলা ময়লা-আর্বজনা অপসারণ করা হতো। তবে আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের সময় দুপুর ২টা থেকে ময়লা-আর্বজনা অপসারণ শুরু হয়। পরবর্তীতে শুধুমাত্র ১০টি ওয়ার্ড থেকে পুনরায় রাতের বেলা অপসারণ কার্যক্রম শুরু হয়। তবে তাও বন্ধ হয়ে যায় সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের আমলে। এরপর আ.জ.ম নাছির উদ্দীন মেয়র থাকাকালে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দুই শিফটে এ কার্যক্রম চালাতো কর্পোরেশন। পরবর্তীতে তিনি রাত দশটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টায় সময় নির্ধারণ করে দেন এবং তার উদ্যোগেই চালু হয় ডোর টু ডোর প্রকল্প। যা শুরুতে প্রশংসা পায়। বর্তমানে সকাল সাতটা থেকে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম কার্যক্রম শুরু হয়।
সামগ্রিক কার্যক্রম প্রসঙ্গে চসিক প্রশসক খোরশেদ আলম সুজন আজাদীকে বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে নির্বাচিত মেয়রকে। শহরের সম্পদ খাল, সেগুলো কন্ট্রোল করতে হবে। ডোর টু ডোর পরিপূর্ণভাবে হচ্ছে না। এটাই আমি অসন্তুষ্ট। কাগজে-কলমে শতভাগ বলা হলেও ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ সাফল্য আছে। অনেক এলাকায় সোসাইটির সমিতি করে থাকে। এক্ষেত্রে আউটসোর্সিং করে প্রাাইভেট কোম্পানিকে দেয়া যায়। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করে। পরবর্তী মেয়রদের অবহেলায় সেটা ধ্বংস হয়ে যায়। নির্বাচিত মেয়রের উচিত হবে সবাইকে নিয়ে বসে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়া। সেক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশের প্রধান শহরগুলোতে কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেটা দেখা যেতে পারে।