নারী অধিকার আন্দোলনের নিরলস সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা আয়েশা খানমের নাম উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে একটা চিত্রই ভেসে উঠে, আটপৌরে শাড়ি পরিহিত নিরাভরণ এক নারী যার শিরদাঁড়াটা শক্ত, কণ্ঠ বলিষ্ঠ। সৌম্য ব্যক্তিত্বের আয়েশা খানম জীবনের পুরোটা সময় দিয়ে গেছেন মানবের কল্যাণে, নির্যাতিত নারীকে পথ দেখাতে, নারীমুক্তির পথ অন্বেষণে।
ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতির হাতেখড়ি হয় মহীয়সী আয়েশা খানমের। তখন হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের জন্য তীব্র আন্দোলন চলছে, ১৯৬২ সাল, প্রবল সে-আন্দোলনের সময়েই হয় তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। এরপর ছেষট্টির আন্দোলনে তিনি রাজনীতিতে হয়ে উঠেন পুরোপুরি সক্রিয়। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তুরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধের পথে সকল আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে আন্দোলন করেছেন তিনি। সবাইকে একাত্ব করতে অন্যান্য ছাত্র নেতাদের পাশাপাশি আয়েশা খানম সাংগঠনিক কাজে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সরগরম রাজনীতিতে আয়েশা খানম তখন পরিচিত এক নাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর আয়েশা খানম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর নির্বাচিত হন রোকেয়া হল সংসদ নির্বাচনে সহ-সভাপতি এবং সম্পাদক পদে। ছাত্রাবস্থায় ধীরস্থির, প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন আয়েশা খানম সাধারণ ছাত্রীদের মাঝে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। যে-কোন সমস্যায় তারা কাছে পেতেন আয়েশা খানমকে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি মেয়েদের সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ডামি রাইফেল হাতে নারীদের প্রশিক্ষণের বহুল আলোচিত ছবিতে প্রথম সারিতে দেখা যায় আয়েশা খানমকে। সে-সময়ে সকল ছাত্র সংগঠনের যৌথ সংগঠন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্ব নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরির কাজে অন্যান্য ছাত্র নেতাদের সাথে বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগের কাজ করেন আয়েশা খানম।
সাত-ই মার্চের পর ঢাকার অভ্যন্তরে সংগঠনের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা সহ অন্যান্য কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন আয়েশা খানম, কোনভাবেই নিজেকে অলস রাখেননি তিনি কখনই। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিলের শেষের দিকে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যান আগরতলা। সেখানে তিনি চিকিৎসা সেবার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বক্তৃতা রাখেন আয়েশা খানম।
মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে যাওয়ার আগে যে অরিয়েন্টেশন হতো সেই কাজে আয়েশা খানমকে যুক্ত করা হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেন যে যেহেতু তিনি আগে থেকেই সচেতনতা সৃষ্টির কাজে এবং বক্তৃতা ও কথা বলার ক্ষেত্রে জড়িত ছিলেন তাই তাঁকে তেমন কাজেই যুক্ত করা হয় বেশি। বলা যায় সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী এবং চলাকালিন সম্পূর্ণ সময়ে তিনি কাজ করে গেছেন নিরলস।
১৯৪৭ সালের ১৮ অক্টোবর নেত্রকোনার গাবড়াগাতি গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আয়েশা খানম ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, দক্ষ সংগঠক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, নারী অধিকার, মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী প্রথম সারির নেতা। মুক্তিযুদ্ধের পর নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনে নিজেকে নিয়োজিত করেন, অবিরাম কাজ করে যান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনেও। কখনই তিনি ভুলে যাননি মানুষ হিসেবে তাঁর দায়িত্ব।
ছাত্রাবস্থা শেষ হলে নিজেকে নিয়োজিত করেন নারী মুক্তির আন্দোলনে। যুক্ত হন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাথে। প্রথমে সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সম্পাদক পদে ছিলেন অনেকদিন। এ সময়ে নারীর অধিকার প্রশ্নে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি সহ বিভিন্ন আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সারা দেশে মহিলা পরিষদের একটা শক্ত প্লাটফর্ম দাঁড় করাতে সক্ষম হন তিনি। এ সময় অন্যান্য প্রগতিশীল নারীদের পাশাপাশি সুফিয়া কামালকে পান সহযাত্রী হিসেবে। ২০০৮ সালে সুফিয়া কামালের মৃত্যুর পর তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এই পদে থেকে নারীদের অধিকার প্রশ্নে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।
২০০২ সাল থেকে ৬৮টি সংগঠনের একটি যুক্ত প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সেক্রেটারিয়টের নেতৃত্ব দানকারী আয়েশা খানম নারী অধিকার আদায়ে বিশেষভাবে স্মরণীয়।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, আইন সংস্কার আন্দোলন, সিডও বাস্তবায়নসহ নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
বাংলাদেশের সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন প্রশ্নে তিনি শুরু থেকেই সোচ্চার ছিলেন। বৈশ্বিক নারী আন্দোলনেও ছিল তাঁর শক্ত অবস্থান। ১৯৯২ সালে ভিয়েনার মানবাধিকার সম্মেলন এবং ১৯৯৫ সালে বেইজিং এর বিশ্ব নারী সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের নারীদের প্রতিনিধিত্ব করেন। এছাড়া ২০১১ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত সিডও কমিটির এবং কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেন-এর বিভিন্ন অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছেন।
অতিমারির ছোবলে একের পর এক বিজ্ঞজনকে হারিয়ে সকলে যখন নির্বাক তখনই নতুন বছরের শুরুতেই আয়েশা খানমের মৃত্যু শোকাহত করে। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সাথে যারা যুক্ত, তাঁরা হারাল তাঁদের এক অকৃত্রিম বন্ধুকে। দুই জানুয়ারি, ২০২১ দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভোগার পর মারা যান আয়েশা খানম, রেখে যান তাঁর বিরাট কর্মযজ্ঞ, বিস্তৃত সাদামাটা এক জীবন যা ছিল মানুষের অধিকারের জন্য নিরলস কাজের ইতিহাসে পরিপূর্ণ। আয়েশা খানম বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজে, নারী অগ্রযাত্রার পদে-পদে।