মেলবোর্নের প্রথম দিনগুলোতে অনেক ভারতীয় রমণীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। বাংলাদেশি জেনেই ওরা হিন্দি বলা শুরু করে দিত। আমি হিন্দি জানি না শুনে অবাক। একই ভাবে যে’কজন পাকিস্তানির সঙ্গে দেখা ওরা অবাক হত উর্দু জানি না বলে। বাংলাদেশি মাত্রই বিদেশে গেলে বোধকরি এই সমস্যার মুখোমুখি হয়। আমাদের মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা থাকতে পারে, সংস্কৃতি ঐতিহ্য থাকতে পারে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশি ও প্রাক্তন শাসকগোষ্ঠীর উত্তরসূরিরা আজও তা মেনে নিতে পারেনি। সে-কারণে এই দুই দেশের মানুষদের সঙ্গে বিদেশের মাটিতে বন্ধুত্ব সচরাচর হয় না। হিন্দি বা উর্দু বলতে পারায় কিন্তু কোন অপরাধ নেই। ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় দক্ষতা থাকা গৌরবের বিষয় বৈকি। প্রসঙ্গক্রমে আরও বলে রাখি, অর্জিত শিক্ষা, জীবনদর্শন ও পারিবারিক মূল্যবোধ কোনরকম জাতিবিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেয় না, বরং সকল জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। জাত্যাভিমানে ভর করে রাজায় রাজায় যুদ্ধ বাঁধে, প্রাণ যায় মাটির মানুষদের- এইতো দেখে আসছে পৃথিবী জন্মলগ্ন থেকে। যদিও আমাদের মুক্তিসংগ্রামটা রাজায় রাজায় যুদ্ধ ছিল না। আজ সেদিকে যাচ্ছি না। কাঁটাতারের রাজনীতি, পুরনো হিসেব নিকেশের জটিলতাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে বিদেশ বিভূঁইয়ে দুই ভারতীয় নারী আমার প্রাণের বন্ধু হয়েছিল। সখ্যতা হয়েছিল এক পাকিস্তানি মহিলার সঙ্গেও। আজ তাদের একজনের কথা বলব।
দক্ষিণ ভারতের মেয়ে রামিয়া, তেলেগুভাষী। হিন্দি তো জানেই। তবে আমাদের প্রাথমিক আলাপের শুরু ইংরেজি দিয়ে । দুইজনের ভুলভাল ভাঙা ভাঙা ইংরেজি। একবারও জানতে চায়নি- আমি হিন্দি জানি কিনা। সে কারণেই খুব দ্রুত কাছে আসা। ওর ছেলে আমার মেয়ের চেয়ে বছরখানেকের ছোট। বসন্তের লম্বা বিকেলগুলো আমরা একসঙ্গে কাটাই। ছেলেমেয়েরা পার্কে খেলে বেড়ায়, আমরা সুখ-দুঃখের গল্প করি, ভুল ইংরেজিতে। বাড়ির কথা, বাবা-মা ভাইবোনের কথা, বিয়ের গল্প, শ্বশুরবাড়ির গল্প- ফুরোয় না কথা। খাবারের বাটি চালাচালি হয় মাঝে মধ্যে। আমাদের ঈদ, ওদের দিওয়ালি পালিত হয় ঘরোয়াভাবে। স্বামীপুত্র নিয়ে আমার ঘরে আসে রামিয়া, মেয়ে আর মেয়ের বাবাকে নিয়ে আমিও যাই ওর ঘরে। রামিয়ার হাতের পালং পনিরের স্বাদ যেন আজও লেগে আছে জিহ্বার ডগায়।
মাস তিন কি চারেকের মাথায় বেজে ওঠে বিচ্ছেদের সুর। রামিয়াদের চলে যেতে হবে। ওর বর তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তরের কোন এক প্রকল্পে কাজ করে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে হয় ওদেরকে কয়েক মাস পর-পর। মেলবোর্নে আসার আগে ইউরোপের নানা দেশ ঘুরে এসেছিল ওরা। এবার যাবে হংকং। যন্ত্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনা করেও ছেলে আর ঘর সামলাতে গিয়ে নিজের জন্য কোন কাজ করার কথা চিন্তা করারও সুযোগ পায়নি রামিয়া। চলে যায় ওদের দেশ-বিদেশ ঘুরে-ঘুরে।
বিদায়ের কথায় আমাদের দুই সখির চোখের পানি কে দেখে! ওর রান্নাঘরের হাঁড়ি-কুঁড়ি, খুন্তিকড়াই থেকে শুরু করে সব আমায় দিয়ে দেয় হাতখুলে। বিদায়ের দিন পরম যত্ন করে নিয়ে আসে ছোট্ট একটা পুঁটলি। পুঁটলির ভেতরে ছোট্ট কাপড়ে পেঁচানো একটা বিগ্রহ; ওর ঈশ্বর। সঙ্গে আরও কিছু পূজার সামগ্রী। আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বলে- পার্কের কাছের লেকের পানিতে ভাসিয়ে দিতে। কিছুতেই যেন মাটিতে না পড়ে- তাহলে অমর্যাদা হবে ভগবানের। সঙ্গে নিয়ে যেতে পারছে না, এতো লম্বা ভ্রমণে সম্মানের সঙ্গে যদি নিতে না পারে। বিদেশ বিভূঁইয়ে এনেছিল কেমন করে তা অবশ্য জানা হয়নি।
আমি পাঁচ বেলা নামাজ পড়া সাধারণ মুসলমান। নিজেকে ধার্মিক দাবি করার সাহস রাখি না, তবে ধর্মপালনে স্বস্তি ও শান্তি খুঁজে পাই। পৃথিবীর যেখানেই যাই না কেন, বারো মাস বাংলাদেশের অতি সাধারণ একজন মুসলমান মেয়ের চিহ্ন বয়ে বেড়াই। রামিয়ার ভগবানকে জড়ানো পুটলিটা হাতে নিয়ে সারা শরীরে কাঁপুনি অনুভব করছিলাম। আমি কি পারব ওর বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে! ওইবা কোন বিশ্বাসে আমাকে এই ভার দিয়ে যাচ্ছে!
চোখের জলে বিদায় জানাই রামিয়ার পরিবারকে। ছেলেমেয়েরাও কাঁদে মায়েদের দেখাদেখি। সেই সন্ধ্যায় চলেই যায় রামিয়া। সেই শেষ দেখা। এক যুগই পার হয়ে গেল দেখতে দেখতে। আজও চিঠি (ই-মেইল) পাই রামিয়ার হঠাৎ কালেভদ্রে। আমিও লিখি। এখন ওরা আমেরিকায়। হংকং- এ থাকার সময় ওর একটা মেয়ে হয়েছিল। আমার বোন গিয়েছিল হংকং এ পড়তে। ওদের দেখা হল। আমার ছোট বোনকে পেয়ে সে কি খুশি রামিয়ার! অনেক আদর যত্ন করল।
রামিয়া মেলবোর্ন থেকে বিদায় নেবার পর এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনের বিকেলে মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেই পার্কটায়। রামিয়া আর ওর ছেলে রিগগোর কথা ভেবে মনটা খুব খারাপ হল। আমার মেয়ে মাঝে মাঝে রিগগোর কথা বলে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল। সবেতো তিন শেষ হল। বিরহব্যথা পলকেই মুছে যায়। কিন্তু আমি যে বন্ধুবিরহে কাতর। মনে হয় এই বুঝি এসে পড়ল- মিষ্টি করে ডাকল- হাই সালমা। আমার হাতে ধরা রামিয়ার গচ্ছিত ধন; মোড়কে লুকানো ভগবান। আমি সন্তর্পণে লেকের ওপর বানানো ছোট্ট পুলটার ওপর গিয়ে দাঁড়াই, পুটলিটা খুলে আস্তে করে পানিতে ভাসিয়ে দিই রামিয়ার ভগবানকে আর পুজার সামগ্রীকে, ঠিক যেমন করে সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ প্রতি আশ্বিনে ওদের দেবীমাতা দশভূজা দুর্গতিনাশিনীকে বিসর্জন দিয়ে থাকেন। ঠিক তখনই মনের ভার কেটে যায়, হালকা লাগে। মনে হল দায়মুক্ত হলাম। বন্ধুর বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে পারলাম। তবে একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম- হঠাৎ কোন নিরাপত্তা প্রহরী এসে জিজ্ঞেস না করে বসে, লেকের টলটলে পানিতে কি ফেললে।
কথায়-কথায় চেনাজানাদেরকে বলা হয় রামিয়া আর আমার তিন চার মাসের বন্ধুত্বের গল্প, আর ওর ভগবানকে ভাসিয়ে দেবার গল্পও। অবাক হলাম সবচেয়ে আধুনিক দেখতে প্রগতিশীলরাই, কথায়-কথায় যারা ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে ফেলেন, মাতৃভূমি ধর্মান্ধতায় ছেয়ে গেছে বলে আওয়াজ তোলেন, ছেলেবেলা থেকে লব্ধ বলিউডি জ্ঞানের সুবাদে ভারতীয় ও পাকিস্তাানিদের সঙ্গে সগর্বে হিন্দি-উর্দুতে বাৎচিত করেন, আবার জন্মভূমির সকল জাতীয় দিবসে বিশেষ রঙের পোশাক পরিধান করে আনন্দ-উল্লাসে সামিল হলেও ঈদ পার্বণে যাদের পছন্দের তালিকায় থাকে ভারতীয় লেহেঙ্গা, গহনা কিংবা পাকিস্তানি ‘থ্রি-পিস’, তাদের কেউ কেউ বলেই ফেললেন, এত ঝামেলা করতে গেলেন কেন? গারবেজ বিনে (ময়লার বাক্স) ফেলে দিলেই তো হত!