চট্টগ্রাম কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেটে হাজারের অধিক মামলার জালে আটকা পড়ে আছে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। আইনগত দীর্ঘসূত্রতায় বছরের পর ধরে এসব বকেয়া রাজস্ব উদ্ধার করা যাচ্ছে না। এসবের মধ্যে ২০-২৫ বছরের অনেক পুরনো মামলাও রয়েছে বলে জানায় ভ্যাট কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, অনেক সময় ব্যবসায়ীরা আদালতের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে থাকেন। এতে সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব আদায় থেকে। প্রতি বছরই বাড়ছে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা। আবার এসব মামলা নিষ্পত্তিও হচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। ব্যবসায়ীরা আইনের সুযোগ নিয়ে কমিশনারের কোনো একটি আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। এতে বকেয়া আদায়ের প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হয়ে থাকে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোনো ব্যবসায়ী শখের বশে আদালতে যান না।
চট্টগ্রাম ভ্যাট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কাস্টমস ভ্যাট কমিশনারেট চট্টগ্রামে ২৪টি সার্কেলের অধীনে রাজস্ব আহরণ করে। এসব সার্কেলকে ৮টি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আগ্রাবাদ বিভাগ, চান্দগাঁও বিভাগ, চট্টলা বিভাগ, রাঙামাটি বিভাগ, পটিয়া বিভাগ, কঙবাজার বিভাগ, খাগড়াছড়ি বিভাগ এবং বান্দরবান বিভাগ। এসব বিভাগের বকেয়া ভ্যাট রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা রয়েছে ১ হাজার ২৩টি। এসব মামলায় জড়িত রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ৯৩৪ কোটি ৪৬ লাখ ৯৮ হাজার ২০০। এর মধ্যে আগ্রাবাদ বিভাগে আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আপিলকৃত ৩৬ মামলার বিপরীতে বকেয়ার রাজস্ব রয়েছে ৫৯ কোটি ৮৩ লাখ ১২ হাজার ৮১ টাকা। এছাড়া হাইকোর্টে দায়েরকৃত ২২২ রিট মামলার বিপরীতে বকেয়ার পরিমাণ ৫৯৪ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার ৬০৫ টাকা এবং সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন ১৪টি মামলায় বকেয়া রাজস্ব আছে ২৯ কোটি ৩৪ লাখ ৫২ হাজার ৫৪ টাকা। আগ্রাবাদ বিভাগে মোট ২৭২ মামলার বিপরীতে রাজস্ব বকেয়া রয়েছে ৬৮৪ কোটি ২২ হাজার ৯৫৫ টাকা। অন্যদিকে চাঁন্দগাও বিভাগে আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আপিলকৃত ৩১ মামলায় বকেয়া আছে ২১ কোটি ৫৩ লাখ ১৯ হাজার ৪৬৭ টাকা। এছাড়া হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা রয়েছে ১৪৭টি। এসব মামলার বিপরীতে বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ ৪৭২ কোটি ৬৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৮ টাকা এবং সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন ২৪ মামলার বিপরীতে ১১ কোটি ২৭ হাজার ৭৩ টাকা বকেয়া আছে। চান্দগাঁও বিভাগের সর্বমোট ২০২ বিপরীতে রাজস্ব বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০৫ কোটি ৪৭ লাখ ৭ হাজার ৫০৫ টাকা। অপরদিকে চট্টলা বিভাগে আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আপিল মামলা আছে ১৪টি। বিপরীতে রাজস্ব বকেয়া রয়েছে ১৬ কোটি ৮৪ লাখ ৩৪ হাজার ৬৮২ টাকা। এছাড়া হাইকোর্টে দায়ের করা ২৫৩টি রিট মামলার বিপরীতে বকেয়া রয়েছে ১৫৬ কোটি ২৭ লাখ ৬৮ হাজার ৯৪ টাকা এবং সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন ৯ মামলায় রাজস্ব জড়িত আছে ১৭ কোটি ৫ লাখ ৯১ হাজার ১০৩ টাকা। চট্টলা বিভাগে সর্বমোট ২৭৬ মামলায় রাজস্ব বকেয়া রয়েছে ১৯০ কোটি ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৯ টাকা। অন্যদিকে রাঙামাটি বিভাগে আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আপিলকৃত ৮ মামলায় বকেয়া আছে এক কোটি ৬৩ লাখ ৫ হাজার ১৩৯ টাকা। এছাড়া হাইকোর্টে দায়েরকৃত ২০ রিট মামলায় বকেয়া রয়েছে ৩২ কোটি ৮৪ লাখ ৮৬ হাজার ৯৮৯ টাকা এবং সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন এক মামলায় ৪২ লাখ ৪ হাজার ৪৩৯ টাকা বকেয়া আছে। রাঙামাটি বিভাগে মোট ২৯ মামলার বিপরীতে রাজস্ব বকেয়া আছে ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ৩৬ হাজার ৫১৮ টাকা। এছাড়া পটিয়া বিভাগে আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আপিলকৃত ৩০ মামলার বিপরীতে বকেয়া রয়েছে ১৭ কোটি ১৪ লাখ ৬১ হাজার ১৬৭ টাকা। হাইকোর্টে দায়ের করা ৫৯ রিট মামলায় ১৩৪ কোটি ১০ লাখ ৭৯ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে। তবে সুপ্রীম কোর্টে বিচারধীন কোনো মামলা নেই। পটিয়া বিভাগে সর্বমোট ৮৯ মামলার বিপরীতে বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫১ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ টাকা। অন্যদিকে কঙবাজার বিভাগে আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আপিলকৃত ১০ মামলার বিপরীতে বকেয়া রয়েছে ২ কোটি ৩২ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। এছাড়া হাইাকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা রয়েছে ২২টি। যার বিপরীতে বকেয়ার পরিমাণ ৪২ কোটি ৩ লাখ টাকা এবং সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন এক মামলায় বকেয়া রাজস্ব রয়েছে ১১ লাখ ১৯ হাজার টাকা। কঙবাজার বিভাগে মোট ৩৩ মামলার বিপরীতে বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা। অপরদিকে খাগড়াছড়ি বিভাগে আপলীত ট্রাইব্যুনালে আপিলকৃত ৪ মামলার বিপরীতে বকেয়া আছে ৪ কোটি ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা রয়েছে ১১০টি। বিপরীতে রাজস্ব বকেয়া রয়েছে ৩০৪ কোটি ৬৫ লাখ ৯৬ হাজার টাকা এবং সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন ৪ মামলায় রাজস্ব বকেয়া শূন্য। খাগড়াছড়ি বিভাগে মোট ১১৮ মামলায় রাজস্ব বকেয়া রয়েছে ৩০৯ কোটি ৯ লাখ ৮ হাজার টাকা। অপরদিকে বান্দরবান বিভাগে আপীলাত ট্রাইব্যুনালে কোনো মামলা নেই। তবে হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা রয়েছে ৪টি। যার বিপরীতে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ কোটি ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এছাড়া সুপ্রীম কোর্টেও বিচারাধীন কোনো মামলা নেই। এ বিভাগে মোট ৪টি মামলার বিপরীতে ১৫ কোটি ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে। সব মিলিয়ে ৮ বিভাগের মধ্যে আপীলাত ট্রাইব্যুনালে ১৩৩ মামলার বিপরীতে বকেয়া আছে ১২৩ কোটি ৭৪ লাখ ৮০ হাজার ২৬৫ টাকা, হাইকোর্টে রিটকৃত ৮৩৭ মামলার বিপরীতে বকেয়া আছে ১ হাজার ৭৫২ কোটি ৫০ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩ টাকা এবং সুপ্রীম কোর্টে বিচারাধীন ৫৩ মামলার বিপরীতে বকেয়া আছে ৫৮ কোটি ২১ লাখ ৮০ হাজার ৩৩ টাকা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস এঙাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেটের সহকারী কমিশনার অনুরূপা দেব দৈনিক আজাদীকে বলেন, ভ্যাটে ২০-২৫ বছর আগের মামলাও রয়েছে। দেখা যায়, কোনো একজন ব্যবসায়ী ভ্যাট কমিশনারের কোনো একটি আদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি উচ্চ আদালতে চলে যান। অথচ তারা কমিশনারের আদেশের বিরুদ্ধে প্রথমে আপীলাত ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন। কিন্তু তারা তা না করে সরাসরি হাইকোর্টে রিট মামলা করে দেন। মামলা বছরের পর ঝুলে থাকার কারণে সরকারও রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হয়। এছাড়া আমরা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) কার্যক্রমে আসার জন্যও অনেক ব্যবসায়ীকে চিঠি লিখেছি। কিন্তু তারা যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে এডিআরে আসতে চায় না। এডিআরে আমরা এখন পর্যন্ত মোট ১৬টি মামলা নিষ্পত্তি করেছি। কিন্তু ব্যবসায়ীদের এডিআরে অনাগ্রহের কারণে বকেয়া রাজস্ব আদায় সেভাবে হচ্ছে না।