আগামী ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। গতকাল ৮ জানুয়ারি থেকে নগরজুড়ে শুরু হয়েছে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম। দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আসন্ন এ নির্বাচনকে উৎসবমুখর করা জরুরি বলে দৈনিক আজাদীর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন এ রাজনীতিবিদ।
আজাদী : চট্টগ্রাম নগরীর উন্নয়নে কী কী করা যায় বলে আপনি মনে করেন? ডা. শাহাদাত হোসেন : ভৌগোলিকভাবে চট্টগ্রাম এমন এক অবস্থানে আছে যে এটি দিয়ে পুরো দেশের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব বলে আমি মনে করি সেইভাবে যদি চট্টগ্রামকে আমরা চালনা করতে পারি। আমাদের এখানে বন্দর, ইপিজেড, অর্থনৈতিক জোন সবই আছে কিন্তু আমরা কৃষিখাত, জনশক্তি, পোশাক শিল্পের বাইরে আরো যে খাতটিকে কাজে লাগাতে পারি সেটি হলো পর্যটন খাত। আমরা যদি চট্টগ্রামকে বিশ্বমানের পর্যটন নগরীতে পরিণত করতে পারি তাহলে এ খাত আমাদের জিডিপি বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে। পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, নেপাল, ভূটান অনেক এগিয়ে গেছে; কিন্তু সেইদিক দিয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণ হলো আমরা আমাদের অঞ্চলটাকে সেভাবে তুলে ধরতে পারছি না। আমরা আমাদের অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা পর্যটকদের দিতে পারছি না। এজন্য বাইরের গণমাধ্যমে ইতিবাচক প্রচারণা চালাতে হবে। পর্যটকদের বাংলাদেশে আসার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য সেটা না করে একটা একটা জঙ্গি ধরে নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। এর ফলে সারাবিশ্বের মানুষ বাংলাদেশে আসতে ভয় পায়।
আমাদের চট্টগ্রামের উপর দিয়েই যেতে হয় বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কঙবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান কিংবা খাগড়াছড়ি। সুতরাং আমরা যদি আমাদের চট্টগ্রামকে যানজটমুক্ত, দুর্গন্ধমুক্ত করে একটি সুন্দর, নয়নাভিরাম নগরীতে পরিণত করতে পারি তাহলে আমরা অনেকটা এগিয়ে যেতে পারব।
আজাদী : ময়লা আবর্জনার ব্যাপারে আপনার উদ্যোগ কী হবে?
শাহাদাত : আগের মেয়র ময়লা ফেলার জন্য বিন দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি সেটা শেষ করতে পারেননি। আমার লক্ষ্য হলো প্রত্যেক ঘরে দু’টা বিন দেয়া-একটিতে নষ্ট খাবার ফেলার জন্য আর আরেকটিতে পচনশীল নয় এমন প্লাষ্টিক, কাঁচ দ্রব্য ফেলার জন্য। তাহলে পচনশীল দ্রব্য থেকে জৈব সার তৈরি করা যাবে। আর পচনশীল নয় এমন দ্রব্যগুলোকে রিসাইকেল করে তৈরি করা যাবে একই পদার্থের নতুন দ্রব্য। এর মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনের আয় বৃদ্ধি পাবে। এভাবেই সিটি কর্পোরেশনকে স্বাবলম্বী করতে আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নেব।
আজাদী : স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারে কী উদ্যোগ নেবেন?
শাহাদাত : সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে প্রতিটি ওয়ার্ডে যদি কমিউনিটি হেলথ সেন্টার করা যায় তাহলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চাপ কমবে। এসব হেলথ সেন্টারগুলোতে শিশু স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা, বয়স্কদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা থাকতে পারে। সাধারণ সর্দি-কাশি-জ্বরের জন্য চিকিৎসা সেবা থাকতে পারে এ কেন্দ্রগুলোতে। এখন দেখা যায় সাধারণ এ চিকিৎসা সেবাগুলো পেতে সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছে। ফলে তাদের গাড়িভাড়া খরচ হয়, সময় নষ্ট হয়। আমার মনে হয় এরকম কমিউনিটি হেলথ সেন্টারগুলো গড়ে তোলা গেলে সিটি কর্পোরেশন একটা আয়ও পাবে এগুলো থেকে। নগরীর কোনো কোনো ওয়ার্ডে লক্ষাধিক মানুষও বাস করে। তাদের জন্য এ স্বাস্থ্যসেবা খুবই জরুরি।
আজাদী : নগরীর পরিবেশ রক্ষায় আপনি কী করতে চান?
শাহাদাত : চট্টগ্রাম নগরীকে একটি স্মার্ট এবং হেলদি সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। রাস্তায় চলা গাড়িগুলো থেকে যে কার্বন-ডাই-অঙাইড গ্যাস নিঃসরিত হচ্ছে তা রোধ করতে হবে। কারণ এ গ্যাস শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাদের বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
আজাদী : জলাবদ্ধতা দূর করবেন কীভাবে?
শাহাদাত : জলাবদ্ধতার ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয় এখন ৬ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান যদিও আমরা এর ফল দেখতে পাচ্ছি না। এ প্রকল্পটিকে দৃশ্যমান করতে হবে। জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে নগরীর ৫৪টি খাল খননের পাশাপাশি আরো কী কী পরিকল্পনা করা যায় সেই ব্যাপারেও উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে শুধু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করলে হবে না। এ কাজের সাথে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, পর্যটন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে নিয়ে সমন্বয় করতে হবে। আমাদের নগরী খুবই সুন্দর কিন্তু পরিকল্পিত উন্নয়নের অভাব। সমস্ত সেবা সংস্থাকে একটি ছাতার নিচে আনা গেলে পরিকল্পিত উন্নয়ন করা সম্ভব।
আজাদী : মশার যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে কী উদ্যোগ নেবেন?
শাহাদাত : মশা শুধু চট্টগ্রাম নয় পুরো দেশ থেকে দূর করতে হলে ০.৫% ক্লোরিন সল্যুশন স্প্রে করতে হবে। এটা আমরা ২০১৮ সালে ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশা নিধনে করেছিলাম। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া সহ মশাবাহিত রোগগুলো থেকে বাঁচতে হলে রুটিনমাফিক এ সল্যুশন সব জায়গায় স্প্রে করতে হবে। আমি মেয়র হতে পারলে এ পরিকল্পনা হাতে নেব যাতে নগরবাসীকে মরণঘাতী ভাইরাসগুলো থেকে রক্ষা করতে পারি।
আজাদী : নির্বাচন নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কি?
শাহাদাত : আওয়ামী লীগ গত ১২ বছরের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনও করতে পারেনি। এটা তাদের রাজনৈতিক শূন্যতা বা দেউলিয়াত্ব। যেহেতু তাদের একটা শূন্যতা চলে এসেছে তাই আমি মনে করি এ প্রেক্ষাপটে কোনো নির্বাচন চট্টগ্রামে হোক কিংবা সারাদেশে হোক নির্বাচনগুলোকে গণমুখী করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কাজেই তাদের সংগঠনের স্বার্থে, রাজনীতির স্বার্থে নির্বাচনগুলোকে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা ছাড়া তাদের আর কোনো গত্যন্তর নেই বলে আমি মনে করি। তারপরও কিছু কথা থেকেই যায়। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি অর্থাৎ যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তারা আজ তাদের পেশাদারিত্বের জায়গায় নেই। তারা সম্পূর্ণভাবে দলের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। সেই কাঠামো থেকে তাদের বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রের যন্ত্রে ফিরে যেতে হবে। তাহলেই মানুষ একটি অংশগ্রহণমূলক, নিরাপদ, সুন্দর, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন পেতে পারে।
এ বছর আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হয়ত জাঁকজমকভাবে পালন করবে। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক দৈন্যের কারণে মন থেকে তারা কতটুকু সন্তুষ্ট সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ মানুষের যে সাংবিধানিক অধিকার সেটি যখন একটি দল বা সরকার দিতে ব্যর্থ হয় এর চাইতে দৈন্য আর কিছু থাকতে পারে না। কাজেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে যদি সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হয় তাহলে একটি সুন্দর, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, উৎসবমুখর নির্বাচন করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। এ প্রেক্ষাপটে সামনে আমরা হয়তোবা অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করতে পারি। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একটি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কিংবা উৎসবমুখর করা জরুরি। আর সেটা হতে পারে এ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে।
আমাদের দলের নেতাকর্মীরা মামলা, হামলা, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। মামলা, হামলা, আঘাত ছাড়া কিন্তু স্বাধীনতা আমরা পাইনি। আমাদের তরুণ সমাজ, নারী সমাজ যে ভোট দিতে যেতে পারছে না তাদের সবাইকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তাদের ভোটের অধিকার, গণতন্ত্রের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য লড়াইয়ে সবাইকে শরীক হতে হবে। সেজন্য তাদের যদি রক্তও দিতে হয় তাও দিতে হবে।
আজাদী : নির্বাচন কীভাবে উৎসবমুখর হবে বলে মনে করেন?
শাহাদাত : মানুষের মধ্যে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে অপপ্রচার করে ভীতি ছড়ানো হতে পারে। যেমন, ‘ভোট তো আগেই হয়ে গেছে’, ‘ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কী লাভ’ এমনটা। তাই পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। পুলিশ প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা এখন নেই কারণ তারা বিনা কারণে মানুষকে গ্রেফতার করেছে, হেনস্তা করেছে, ভীতির সঞ্চার করেছে। মানুষকে ভোটকেন্দ্রমুখী করতে তাদের ভূমিকা অবশ্যই দরকার। নির্বাচন কমিশনকে এখন থেকেই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রচারণার মাধ্যমে ভোটার যাতে কেন্দ্রে আসতে আগ্রহী হয় সেই উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে ‘ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আগে ভোট তো হয়ে যেতে পারে’ অথবা ‘আমার ভোট আরেকজন দিয়ে দিতে পারে’ আগের এই যে সংস্কৃতি সেটা দূর করা না গেলে বেশি ভোটার কেন্দ্রমুখী হবে না। তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, উৎসবমুখর যে ভোটের কথা আমরা বলছি সেটা নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্র। আমরা যারা প্রার্থী আছি তারা তো সাধারণ ভোটারের ঘরে ঘরে যাব, গণসংযোগ করব, তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করব কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের যদি এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা থাকে তাহলে ভোটাররা হয়ত ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে আরো আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
আজাদী : সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে আপনার পরামর্শ কী?
শাহাদাত : ভোট কারচুপি রোধে তিনটি বিষয়ে নজর রাখতে হবে। যেগুলো আমরা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি। একটি হলো এনআইডি কার্ড ছাড়া কেউ যেন ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না পারে। দ্বিতীয়টি হলো আমাদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করার সময় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। আর তৃতীয়টি হলো একজন ভোটার যখন ইভিএমে ভোট দিতে যান তখন তাকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে অপারেটিং প্যানেলে প্রবেশ করতে হয়। তারপর আসে ব্যালট প্যানেল। কিন্তু সেই ব্যালট প্যানেলে দুষ্কৃতকারীরা দাঁড়িয়ে থেকে তাদের পছন্দমতো বোতাম টিপে দেয়। এই ব্যালট প্যানেলকে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ও সরকারের। যদি এই তিনটি বিষয় ঠিক রাখা যায় তাহলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব।
আজাদী : মেয়র হওয়ার ব্যাপারে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
শাহাদাত : বিএনপি গণতন্ত্রকে সবসময় সম্মান করে। গণতন্ত্রের সর্বশেষ ধাপটি হলো ভোটের অধিকার। আমরা দেখাতে চাই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একটি গণতান্ত্রিক ও জনগণের দল। জনগণের যে সাংবিধানিক অধিকার সেই ভোটের অধিকারের জন্যই আমরা লড়াই করে যাচ্ছি। এটা দেখানোর জন্যই আমরা নির্বাচনে যাই। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর হয় তাহলে আমি মেয়র হওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।
সাক্ষাতকার গ্রহণে : প্রবীর বড়ুয়া