কবি দেখেন, যা অন্যের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। কবি ভাবেন অন্তরাত্মার গভীরে পৌঁছে, জীবনকে অনুসন্ধান করেন আবেগকে বুদ্ধি দ্বারা পরিশোধনের মাধ্যমে। কবি পোড়েন কবিতার তুষাগ্নিতে। পুড়তে পুড়তে উপস্থাপিত হন ইন্দ্রিয়গত প্রক্রিয়ার নির্ভেজাল উদ্যানে। এমন উদ্যানে আমরা আবিষ্কার করি নাসির আহমেদকে। শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে তিনি কবিতার পূজারী হয়েছেন। শুরু ছোট গল্প দিয়ে, ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যান ছড়ার হাত ধরে, প্রচুর লিখেছেন ছোটদের জন্যে, লিখেছেন গান ও গল্প। অবশেষে অন্তর্লীন হয়েছেন কবিতায়। এ পথের যাত্রী তিনি যখন থেকেই হোন, তাঁর কপালে তিলক চিহ্ন এঁকেছে সত্তর দশক।
শব্দ ব্যবহারের মুনশিয়ানা, রূপকল্প, চিত্রময়তা তাঁর কবিতাকে হৃদয়গ্রাহী করেছে। ঐতিহ্যচেতনা তাঁর কবিতায় নতুন মাত্রা লাভ করে। তাঁর কবিতা স্নাত হয়েছে প্রকৃতির নিটোল আলো-হাওয়ায়। তিনি এঁকেছেন সবুজের সৌম্যমূর্তি। তিনি কবিতার ওষ্ঠাধারে তুলে ধরেছেন সমাজ, দেশ ও দেশের মানুষের হৃদয়নিঃসৃত কথামালা। তাঁর অধিকাংশ কবিতা অন্তর্গত ছন্দের দোলায় পাঠকমনকে নাচিয়ে তোলে। তাঁর কাব্য রচনার পটভূমিতে রয়েছে প্রেমের অনুষঙ্গ। মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের পরিপার্শ্ব, সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশ তাঁকে বিদ্ধ করেছে আর এর থেকে উৎসারিত হয়েছে কবিতা।
কবি কখনো তলিয়ে যেতে চেয়েছেন নিঃসঙ্গতার অন্ধ-গহ্বরে, কখনো চেয়েছেন আলোর ঝর্ণায় অবগাহন করতে কিন্তু ক্ষণস্থায়ী ইন্দ্রিয়সুখ তাঁকে পরিতৃপ্তি দিতে পারেনি। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন তাঁকে কবিতার পথে তীর্থযাত্রা করে তুলেছে, ডুবিয়ে দিয়েছে শব্দের স্নিগ্ধতায়।
এ পর্যন্ত আমাদের হাতে এসেছে তাঁর এগারটি কাব্যগ্রন্থ। এগুলো হচ্ছে আকুলতা শুভ্রতার জন্যে (১৯৮৫), পাথরগুলো দুঃখগুলো (১৯৮৬), তোমাকেই আশালতা (১৯৮৭), আমি স্বপ্ন তুমি রাত্রি (১৯৯৫), বৃক্ষমঙ্গল (১৯৯১), ভালোবাসার এই পথে (১৯৯১), তোমার জন্যে অনিন্দিতা (১৯৯৮), বিধ্বস্ত শহর ছেড়ে যেতে যেতে (১৯৯৯), কবিতা সংগ্রহ (১৯৯৯), একাত্তরের পদাবলী (২০০০), ঝরাপাতার নৃত্যকলা (২০০০), গোপন তোমার সঙ্গে (২০০০), নির্বাচিত প্রেমের কবিতা (২০০১।
‘আকুলতা শুভ্রতার জন্যে’ থেকে ‘ঝরাপাতার নৃত্যকলা’ পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন ছত্রে কবির বাঁক পরিবর্তন লক্ষণীয়। তাঁর চিন্তা-চেতনা ও অভিজ্ঞতা ক্রমশ গাঢ়তর হয়েছে। তাঁর প্রথমদিকের কবিতা আবেগসিক্ত, নান্দনিকতা ও অলঙ্কারের ঐশ্বর্যের ইঙ্গিতবাহী। ক্রমান্বয়ে তিনি অনিকেত হৃদয়াবেগ অতিক্রম করে জীবনবিশ্বাসের অন্বেষণে ব্যাপৃত হন। হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অনুসন্ধানের সাফল্যে পৌঁছানোর দীপ্তি তাঁর মধ্যে পাখা ঝাপটাতে থাকে।
আধুনিক যুগের টানাপোড়েন ও ঝড়ঝঞ্ঝার ব্যক্তিসত্তা বিকাশজনিত ঘুর্ণাবর্ত মানবিক মূল্যবোধের সামগ্রিক বিকাশই নাসির আহমেদের কবি জীবনের মূলভিত্তি। তবে এ ভিত্তি তৈরিতে শব্দের খেলায় কোথাও যে তাঁর বিচ্যুতি ঘটেনি সে কথা প্রাণ খুলে বলা যাবে না।
তিনি মেধারঔজ্জ্বল্যে ‘ঝরাপাতার নৃত্যকলা’য় এসে প্রত্যক্ষ করেছেন বিধ্বস্ত ধূসর ক্লান্ত জীবনকে। বুঝতে পেরেছেন, কোনো কিছু অনিবার্য নয়, তাই কবি বলেন-
‘যদি তুমি ভাবো অনিবার্যকে ছুঁয়েছে তোমার নশ্বর অস্তিত্ব
তবে ভুল হবে, খুব ভুল হবে। জেনে রেখো কোন কিছু নয় অনিবার্য।’
(শুধু সেই কালো রহস্যময়)
কবির জীবন তবু হার মানে না। দুর্মর প্রাণের আবেগে নির্নিমেষ চোখ মেলে বলে যান-
‘এক অলৌকিক ক্যামেরায়
যে ছবিগুলি তুলেছি তোমার সঙ্গে
কয়েকটি নির্জন সকাল তার দুপুরের
ক্যানভাসে বসে, সেই যুগল স্মৃতির বাঁধানো
ফ্রেম থেকে একটি স্মৃতি
নিঃসঙ্গ শালিক হয়ে উড়ে এসে বসবে সেই
নির্মাণাধীন বাড়ির বাগানের আঙিনায়
বাসা বাঁধবে দুঃখের খড়কুটো দিয়ে।
(নির্মাণাধীন বাড়ি)
রোগশয্যায় মৃত্যুকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন নীল বর্শার মতো। কিন্তু চৈতন্যের সম্ভাবনা কাঁপিয়ে প্রত্যয়ের দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে বলেছেন-
‘খোলো অন্ধকার, খুললেই দেখতে পাবে এককাপ গরম কফির
তৃপ্তিমাখা টাটকা ভোর-হালকা কুয়াশার ধোঁয়া
ছড়িয়ে রৌদ্র হাসছে শিশুর সারল্যে।
(একবিংশের দরজা)
প্রাকৃতিকতা, আদি ও অন্তের দুর্লঙ্ঘ্য কৌতূহল কবিকে আন্দোলিত করে। মৃত্যুর অভিযাত্রা তাকে অকল্পনীয়ের মুখোমুখি দাঁড় করায়। তিনি উজ্জীবনী খরতায় তামস নির্জনতা ভেদ করে আমাদের উপহার দেন ‘একাকীত্বের খেয়া পার হতে হতে’ কবিতা। বলেন-
‘ভাড়াটে বাড়িকে নিজের বাড়ি ভেবে বহুকাল পরে একদা পথে নেমে এসে দুই চোখ মেঘলা হয়েছে, সেই মেঘ জমা করো একদিন ধোয়া যাবে স্বরচিত ক্লেদের কালিমা ধোয়া যাবে সেই ভুল রাত্রিকেও- যার মেহেদী রাঙানো হাত ছোঁয়ার আগেই চার বেহারার কাঁধে উঠে গেছে মেঠোপথে স্বপ্নের প্রতিমা।’ (একাকীত্বের খেয়া পার হতে হতে)।
মৃত্যু কল্পনার অপর পিঠে রয়েছে উজ্জীবন, তাতে কবি উদ্দীপ্ত হন, পাথর ভাঙার আকুতি জাগে মনে, যে আকাঙ্ক্ষা সর্বজনীন। তাঁর ভেতর কোলাহল করে অন্য এক উর্মিমালা-
‘যে মেঘে ভিজেছ তাকে বেঁধে দিই খরার আগুনে আজ
ফের বুনে যাব দুঃখতন্তু দিয়ে পুরাতন শিল্পের কাজ
একা একা আমি। আষাঢ় বাদল আমার ভেতর মেঘ গুরুগুরু
তোমার এবার ঝঞ্ঝাবিহীন দিন হোক শুরু
সাজানো শোকেসে আবার সাজাও থরে থরে সেই একান্ত সুখ
ফিরিয়ে নিচ্ছি আষাঢ়-শ্রাবণ স্বরচিত এই আশায় অ-সুখ।
(ফিরিয়ে নিচ্ছি আষাঢ়-শ্রাবণ)
জীবনের পরিপূর্ণতা আনে মৃত্যু, তা জীবনের উৎসও। এই উৎসকে জানার মধ্যেই সর্বস্বতা ধ্বনিময়। যা তাঁর কবিতায় প্রাণ পেয়েছে এভাবে- ‘পূর্ণতাকে আবাদ করো অন্ধকারে’। (কৃষ্ণপক্ষ শুক্লপক্ষ)
তাঁর মনে হয়েছে মৃত্যু- দিনের গল্প ফুরানোর মতো জীবনে ছেদ টেনে দেয়। তাই তিনি মৃত্যুর পথযাত্রী হয়ে লিখেছেন-
‘এইভাবে রাত্রি নেমে এলে ফুরায় দিনের গল্প
তুমি সেই নৈঃসঙ্গপীড়িত দিন
তোমার পৃথিবী এসে শেষাবধি মিশে যায়
গৃঢ়ার্থ রাত্রির অর্থহীন দ্বান্দ্বিক রেখায়।’
(অর্থহীন দ্বান্দ্বিক রেখায়)
শিল্পের তন্ময় ধ্যানে মগ্ন কবি বুঝতে পারেন না ‘গন্তব্য কোথায়’। তাই তিনি বলেন-
‘হে নিসর্গ! সে অসীম সৌরলোক
হে অজস্র আলোকবর্ষব্যাপী ছড়ানো সময়
সেই অন্ধকারের পরে কী রয়েছে
তোমরা কি জানো?
এই অজ্ঞতার দুঃখ নিয়ে
নিভে যেতে হয়!
নিভে যেতে হবে!
সাড়ে তিন হাত মাটি, আলোভুক্ত মাটি
চিরদিন অপেক্ষায় থাকে ঘোর অজ্ঞতায়:
গন্তব্য কোথায়?’
(গন্তব্য অজ্ঞাত)
তিনি সমস্ত চরাচরে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। নিরবচ্ছিন্নভাবে কেউ বলতে পারেন না সর্বশেষ অন্ধকারের পরে কী, তা কবিরও অজ্ঞাত। এই অজ্ঞাত গন্তব্যের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো তিনি আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। আবারও এঁকে যাচ্ছেন ছবি: নদী, চর, সবুজ প্রান্তর ইত্যাদি নানা চিত্রকল্প ও শব্দের সুষমা। আমরা পাচ্ছি ছন্দের অনন্য ধ্বনিময়তা।
তাই আমরা বলতে পারি কবি নাসির আহমেদ বাংলাদেশের কবিতায় বহুল আলোচিত নাম। কবিতার সাম্রাজ্যে তাঁর বিচরণ ও মগ্নতা প্রায় চার দশক ধরে। এ দীর্ঘ সময়ে সাধনার ধারায় কবিতাকে তিনি বৈচিত্রময় করে তুলেছেন। তাঁর এ যাত্রা অব্যাহত থাকবে এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।