নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকার শিশুবাগ স্কুলের ভবন ভাঙা নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল দুপুরে ভবন ভাঙাকালীন দুই পক্ষকে মুখোমুখি অবস্থান নিতে দেখা যায়। পরে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্ট্রান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. রানা দাশগুপ্তসহ বিভিন্ন জনের হস্তক্ষেপে ভবন ভাঙা স্থগিত রাখা হয়। যদিও এর আগেই স্কুলের বেঞ্চ-টেবিলসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি বের করে ভবনের উপরের একাংশ বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়। দুপুরের পর থেকে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কোতোয়ালি থানার এসআই অমিতাভসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ সদস্য সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন। জেলাপ্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জানতে চাইলে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে এম. ফরিদ চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি তার দখল সত্ত্ব বুঝে নিতে সেখানে গেছেন বলে জানান কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন। তবে ভবন ভাঙ্গার কাজ শুরুর কিছুক্ষন পর বিভিন্নজনের হস্তক্ষেপে তা স্থগিত রাখতে নির্দেশনা আসে। নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ভবন ভাঙ্গা কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়- দুপুরের পর থেকে পুলিশের উপস্থিতিতেই বেশ কিছু যুবক সেখানে অবস্থান নেয়। পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। এসময় জড়ো হওয়া যুবকরা বিভিন্ন নামে স্লোগান দিচ্ছিলেন। এসময় জয়বাংলা বলতেও শোনা গেছে।
স্থানীয়দের দাবি- স্কুলটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি। যা ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহনও ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। তিনি কলকাতার মেয়রও হয়েছিলেন। ইংরেজ স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তাকে নিয়ে কিছু দিন ভবনটিতে ছিলেন তিনি। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় এই বাড়িতে এসেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীরাও এই বাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর হয়ে মামলা লড়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন। এতে ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়ে ১৯৩৩ সালে কারাগারে মৃত্যু হয়েছিল যতীন্দ্রমোহনের। এরপর নেলী সেনগুপ্তা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জের বাড়িটিতে ছিলেন। ১৯ গণ্ডা এক কড়া পরিমান জমিটি পরে শত্রু সম্পত্তি ঘোষিত হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি জমিটি লিজ বা ইজারা নিয়ে ‘বাংলা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে। পরে নাম বদলে সেই ভবনে ‘শিশুবাগ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইছহাকের সন্তানরা স্কুলটি পরিচালনা করছেন। প্লে থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত বর্তমানে প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী স্কুলটিতে অধ্যয়ন করছে বলে জানিয়েছেন শিশুবাগ স্কুলের পরিচালক আবু নাসের টিপু। কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ২০ জন বলেও জানান তিনি।
এদিকে, হঠাৎ স্কুল ভবন ভাঙ্গার খবরে অভিভাবকদের মাঝেও উৎকন্ঠা ভর করেছে। গত বৃহস্পতিবারই বেতন-ফি জমা দিয়ে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন কাজী নাজনীন সুলতানা। আর গতকাল সোমবার সকালে স্কুলে গিয়ে নতুন বইও নিয়ে আসেন। কিন্তু দুপুরে স্কুল ভবন ভেঙ্গে ফেলার খবর পেয়ে চরম উৎকন্ঠিত এই অভিভাবক বলেন- এই সময়ে এসে মেয়েকে নিয়ে আবার কোথায় যাবো। এ নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় আছি।
স্থানীয়রাও ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এই ভবন ভাঙ্গার বিষয়টি মানতে পারছেন না। এ নিয়ে অনেকেই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ ঘটনায় গতকাল দুপুরেই ঘটনাস্থলে মানববন্ধন সমাবেশের আয়োজন করে চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র। এডভোকেট রানা দাশগুপ্তসহ অন্যান্যরা সেখানে বক্তব্য রাখেন। একই ঘটনায় মঙ্গলবার (আজ) বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনেরও আয়োজন করেছে সংগঠনটি। সাংবাদিক সম্মেলনে সমাজ বিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন, কবি ও প্রাবন্ধিক সাংবাদিক আবুল মোমেন ও এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত প্রমূখ উপস্থিত থাকবেন বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি জাদুঘর হিসাবে গড়ে তুলুন : রানা দাশগুপ্ত
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার নেতা এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এই বাড়িটিকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতি রক্ষার্থে জাদুঘর হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। গতকাল বাড়িটি জবরদখল ও ভাংচুরের অপচেষ্টার প্রতিবাদে বাড়ির সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি এই আহ্বান জানান।
সমাবেশে তিনি বলেন, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত তৎকালীন সময়ে রেল শ্রমিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁদের অনেক স্কুল কলেজ রয়েছে। এছাড়া মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহেরু, নেতাজি সুভাষ বসু, মৌলানা মুহাম্মদ আলী ও মৌলানা শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয়সহ অনেক নেতৃবৃন্দ এই বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। এছাড়া মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে তৎকালীন সময়ে যেসমস্ত আইনজীবী মাস্টারদার পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন তাঁরাও এই বাড়িতে ছিলেন। সমাবেশ শেষে যুব ঐক্য পরিষদ তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
প্রতিবাদ ও নিন্দা
দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও নেলি সেনগুপ্তার ঐতিহাসিক বাড়ি দখলের অপচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগর শাখা ও চট্টগ্রাম মহানগর পূজা পরিষদ নেতৃবৃন্দ। পৃথক পৃথক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের শীর্ষ মহলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।