তিনি সুদূরের পিয়াসী। স্বপ্ন দেখেই শুধু ক্ষান্ত হন না, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে একের পর এক বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে আজ তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এমন একটি স্থানে, যেখানে পৌঁছানোর কথা অনেকে শুধু কল্পনাই করে থাকেন। নিজেই শুধু যান নি, সাথে নিয়ে গেছেন লাল সবুজের পতাকা, এ দেশের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস। মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, জন্মসূত্রে তাঁর দেশ বংলাদেশ, কিন্তু তিনি পৃথিবীর সন্তান। বিশ্ব জয় করে চলা এ বাঙালির নাম নাজমুন নাহার। বাধার সব দেয়াল ভেঙে এ পর্যন্ত ১৪৪ টি দেশ ভ্রমণ করেছেন নাজমুন নাহার। এ বছরের মধ্যে তিনি বিশ্বের ২০০টি দেশে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা পৌঁছে দিতে চান। বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্বজয়ী এই নারীকে বিশ্ব ভ্রমণের কোনো বাধাই থামিয়ে রাখতে পারেনি। বাংলার পতাকা হাতে সাহারার তপ্ত মরু থেকে শুরু করে সমুদ্রের তলদেশ, সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, শহর-বন্দর, আফ্রিকার দুর্গম জঙ্গল সব জায়গায় যার পদচিহ্ন পড়েছে। গতকাল শুক্রবার বছরের প্রথম দিনে ‘পতাকা কন্যা’ খ্যাত এ পরিব্রাজককে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারি হলে সংবর্ধনা দিয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বপ্নযাত্রী। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম, বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি সাংবাদিক এজাজ ইউসুফী, লক্ষ্মীপুর জেলা সমিতির সভাপতি সাবেক কাউন্সিলর মো. এম এ কাশেম, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক নাট্যজন সাইফুল আলম বাবু। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি আলী প্রয়াস।
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে নাজমুন নাহার তুলে ধরেছেন, গত ২০ বছর ধরে বিশ্বের ১৪৪ টি দেশে তাঁর ভ্রমণের কাহিনী। এসব দেশে ভ্রমণ করতে গিয়ে তিনি পাঁচবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। প্রতিকূলতার মাঝেও বিশ্ব জয়ে নাজমুন নাহার মৃত্যু ভয়ে পিছিয়ে যাননি। হিংস্র বন্যপ্রাণী ভরা জঙ্গলে রাত কাটিয়েছেন, দুর্যোগের কালে বেঁচে থাকার তাগিদে কাঁচা মাংস খেয়েও থাকতে হয়েছে। নাজমুন নাহার বলেন, আমার বয়স যখন ৮/৯ বছর, তখন একবার চট্টগ্রাম এসেছিলাম। মা বাবার সাথে সীতাকুন্ডের পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। কারো সাহায্য না নিয়েই সে পাহাড়ে উঠেছিলাম আমি। ভ্রমণের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠার জন্যে নাজমুন নাহার তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেন – বই, বাবা ও তাঁর দাদা। তিনি জানান, শৈশবে বই পড়তে পড়তেই তার ভ্রমণের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। ভ্রমণ কাহিনীসহ নানা বই পড়ার সময় তাঁর মনে হতো তিনি যেন সেখানে চলে গেছেন। ওই গল্পের ভেতরে হারিয়ে যেতেন নিজেও। বাবার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বাবা মারা গেছেন দশ বছর হতে চললো। সারা বিশ্বকে দেখার ব্যাপারে বাবা আমাকে উৎসাহিত করতেন। বাবা বলতেন, ‘আসবে পথে আঁধার নেমে, তাই বলে কি রইবি থেমে’? আর আমার দাদা উনিশ শতকের শুরুর দিকে বিভিন্ন আরব দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই দুজন মানুষকে দেখে আমি নিজেও ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
২০০০ সালে বিশ্ব ভ্রমণের প্রথম যাত্রায় ভারতের পাচামরিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রাম’- এ অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের ৮০টি দেশ থেকে আসা ছেলেমেয়েদের সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এটিই তার জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। সেই থেকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে তাঁর বিশ্ব যাত্রার শুরু। নাজমুন নাহার বলেন, বিশ্বের সব দেশ দেখা তার একটি স্বপ্ন এবং এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি ধীরে ধীরে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এজন্য তাকে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।
নাজমুন নাহার তাঁর মাকে নিয়েও ঘুরেছেন ইউরোপ ও আমেরিকার ১৪টি দেশ। মাকে নিয়ে পৃথিবী ঘোরার ইচ্ছে প্রসঙ্গে নাজমুন নাহার বলেন, আমি পৃথিবীর অনেক জায়গা ঘুরেছি। ভ্রমণের সময় কোথাও কোনো বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখলে তাদের মাঝে মায়ের মুখের ছাপ খুঁজে পেতাম। তার দিকে তাকিয়ে মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে বেড়াতাম। মনে মনে ভাবতাম, যে মা আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, সেই মাকে আমি পৃথিবীর কিছুই দেখাতে পারব না, তা হতে পারে না।
মৃত্যুকে দেখা ভয়ংকর স্মৃতির কথা স্মরণ করে নাজমুন নাহার বলেন, দেশের পতাকা উড়াচ্ছিলাম আইভরিকোস্টের আবিদজান সমুদ্র সৈকতে। সৈকতের পানির দূরত্ব থেকে একটু দূরেই অবস্থান করছিলাম। সমুদ্রের পাড় দিয়ে হাঁটছিলাম। ছোট ছোট ঢেউ আসছিল। হঠাৎ আছড়ে পড়ল একটা বড় ভয়ঙ্কর ঢেউ আমার দিকে। আমি ভেসে উঠলাম পানির সঙ্গে। ভয়ঙ্কর ঢেউয়ের তোড়ে কিছুটা সময় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ফিরে এসেছিলাম পাড়ে।
নাজমুন নাহার বলেন, বাংলাদেশের কোটি প্রাণের লাল-সবুজের পতাকাকে পৌঁছে দিয়েছি ১৪৪ টি দেশে। আমার শরীরে ১৪৪ দেশের খাবার, ১৪৪ দেশের তাপমাত্রা, ১৪৪ দেশের মানুষকে কাছে থেকে জানার অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্কুলে গেছি, সেখানে শিক্ষার্থীদের কাছে আমার দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য তুলে ধরেছি। দেশে দেশে যুদ্ধ নয়, শান্তির বানী প্রচার করেছি, বার্য বিয়ে বন্ধের কথা বলেছি।
এ পরিব্রাজক বলেন, আমি নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে দেশ ভ্রমণ করি। ঘুরতে খুব সামান্য টাকাই লাগে। আসল প্রয়োজন হচ্ছে ইচ্ছা, ধ্যান, প্রার্থনা আর সাধনা। বেশির ভাগ দেশে আমি সড়ক পথে ভ্রমণ করেছি। কম খরচে ভ্রমণ করার জন্য বিভিন্ন দেশের স্থানীয় মানুষদের পরিবারের সঙ্গেই থাকার চেষ্টা করি। পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণ না করলে আমার দেখা হতো না মানুষের বেঁচে থাকার কঠিন বাস্তবতা। নাজমুন নাহার এক দেশ থেকে আরেক দেশে হাজার হাজার মাইল সড়ক পথে একা ভ্রমণ করেছেন দেশের পতাকা হাতে। দিন রাতের অন্ধকারকে একাকার করে পর্বতে, সমুদ্রের তলদেশে, দুর্গম জঙ্গলে, বন্যপ্রাণীর পাহাড়ে, অজানা আদিবাসীদের এলাকা কোথাও যেতে ভয় পাননি নাজমুন নাহার।