জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘ফোটে যে ফুল আঁধার রাতে/ঝরে ধুলায় ভোর বেলাতে/আমায় তারা ডাকে সাথে- আয় রে আয়।/সজল করুণ নয়ন তোলো, দাও বিদায়…।’ সকল বিদায়ের সঙ্গেই লুকিয়ে থাকে বেদনার কথকতা, থাকে আনন্দকাব্য। ২০২০ সাল বিদায় নিলো। এই বছরটিকে বরণ করার সময় কেউ ভাবেনি যে, বছরটি মানব জাতির জন্য এতটা বিষময় হবে। আনন্দ উচ্ছ্বাসে বরণ করা হয়েছিলো ২০২০ কে। কিন্তু কাটলো আতঙ্ক, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে। প্রায় সারা বছরই থাকলো আপনজন হারানোর বেদনা, থাকলো করোনাভাইরাসের মরণ-ভীতি। আগের বছরের একেবারে শেষ দিকে চীনের উহান শহরে যে ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়েছিল, তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে খুব সময় লাগেনি। ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন ভাইরাসটির নাম দেয় কোভিড-১৯।
খ্রিস্টাব্দ নতুন বর্ষের হাতছানি বিশ্বের ঘরে ঘরে। বিশ সালের বিষময় যন্ত্রণা কাটাতে নতুন বর্ষ ২০২১-কে বরণ করতে প্রস্তুত সবাই। আমরা বাঙালি। কিন্তু আমাদের জীবনের সব কর্মকাণ্ড খ্রিষ্টীয় সালের গণনায় হয়, তাই খ্রিষ্টীয় বছর বিশেষ গুরুত্ববাহী। সেই বিবেচনায় বিদায়ী বছরটা কেমন গেল তার হিসাব কষতে যখন ব্যস্ত হবেন, তখন সবাই এককথায় বেদনায় ব্যথিত থাকবেন। এ বছর ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি। আনন্দের চেয়ে বেদনা বেশি। ভেসে ভেসে আসবে কষ্টের স্মৃতিগুলো। পুরো ২০২০ সালে ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, সহিংসতা, নৃশংসতা, নির্মমতা ও রক্তাক্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে। নানা ঘটন-অঘটন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, চড়াই-উতরাই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও বেদনার সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেল এই ২০২০। তবে মানুষ একইভাবে জীবনের সব ধরনের নেতিবাচক বিষয়গুলোকে দূরে ঠেলে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় নতুন করে পথচলার প্রত্যয় ব্যক্ত করবেন।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ করোনা আক্রান্ত হয়ে একজন মারা যান। সরকারি হিসাবে ২০২০ সালে সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। আমরা হারিয়েছি দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের খ্যাতিমান বেশ কিছু মানুষকে। করোনার শুরুর দিকে বাংলাদেশেও লকডাউন ছিল। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে পৃথিবীর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো বাংলাদেশের মানুষও নতুন করে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এখন মৃত্যুকে সঙ্গী করেই চলছেন তারা।
করোনা প্রত্যেকটি খাতকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমন কোনো জায়াগা নেই যেখানে করোনার প্রভাব পড়েনি। কর্মহীন হয়েছেন দেশের অনেক মানুষ। অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে অনেকে বাধ্য হয়ে বড় বড় শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। করোনায় বড় ক্ষতি হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। পুরোটা বছরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। গুরুত্বপূর্ণ এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হয়নি। নিচের ক্লাসেও পরীক্ষা ছাড়াই অটো প্রমোশনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তবে এই করোনাকালেও আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আমাদের আশান্বিত করে। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল ২০২১’ নামের এই রিপোর্টটি শুক্রবার প্রকাশ করা হয়। ২৯ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এই রিপোর্ট অনুযায়ী আর ৭ বছর পর চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০৩০ সালে ভারত হবে তৃতীয়। আর ২০৩৫ সাল নাগাদ ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বহু ধাপ উপরে উঠে যাবে ২৫ নম্বরে। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সিইবিআর বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক উলট-পালট ঘটে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকার বেশিরভাগ বড় অর্থনীতির দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বিপরীতে চীন কৌশলে করোনা দ্রুত এবং কঠোরভাবে মোকাবেলার কারণে সামনের বছরগুলোতে পৌঁছে যাবে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে।
তবে দেশের মানুষ এখন একটাই প্রত্যাশা করেন-কখন এই করোনা বিদায় হবে। তাঁরা চান সবাই আগের মতো হাসি-খুশি থাকবেন, চলবেন উদ্বেগহীন। আমাদের বিশ্বাস, করোনাকাল নিশ্চয়ই চিরস্থায়ী হবে না। করোনাভীতি কাটিয়ে উঠে হয়তো আমরা অচিরেই নতুন সূর্যের মুখোমুখি হবো- সেই প্রত্যাশায় আমরা। সবাইকে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।