কিমকে আবিষ্কার করেছিলাম আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে। সেই অনুভূতি এখনো সতেজ। সেদিন আমার মনের দুয়ার খুলে গিয়েছিলো। ইন্টারনেটের দুনিয়াটা সবেমাত্র উন্মক্ত হচ্ছিল সর্বসাধারণের জন্য। নিত্যই নতুন-নতুন নির্মাতাদের আবিষ্কার করার নেশা যেন পেয়ে বসেছিল। আমার মতো যারা একসময় সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখতো তাদের চোখ খুলে দেয়ার জন্য তখনো কোন প্রতিষ্ঠান ছিলো না। তার উপর ভালো সিনেমা খুব কমই হয়। হল্েও সেটিকে ভালো প্রতিষ্ঠিত করতে বিস্তর লেখালেখি আলোচনা- সমালোচনার প্রয়োজন হয়। তত্ত্ব আলোচনা হওয়া অবশ্যই ভালো তবে এখনকার দর্শক তত্ত্ব আলোচনার বাইরে থেকেও যথেষ্ট বোধসম্পন্ন। তখন ছিলাম সিনেমার একেবারে নতুন দর্শক, তার উপর বিদেশি ভাষা! সাবটাইটেল দেখতে দেখতে সিনেমাটাই হারিয়ে ফেলতাম। তবুও কোনও তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন পড়েনি। কিমের স্প্রিং, সামার,ফল,উইন্টার…এন্ড স্প্রিং সিনেমাটার কথাই বলি। শিল্প যখন সার্থক হয় তখন ভাষা- দেশকাল সীমানার গণ্ডি পার হয়ে যায়। রাতে সিনেমাটা দেখে যখন সকালে ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলাম রিকসায় বারবার একটা দৃশ্য মনে পড়ছিলো। যেখানে লেকের কিনারায় একটা দরজা খুলে যায় আর নতুন একটা ঋতুতে প্রবেশ করে। মনে হচ্ছিলো আমার ভেতরেই যেন একটা দরজা খুলে যাচ্ছে, আমি প্রবেশ করছি নতুন একটা ঋতুতে। যে ঋতু এর আগে আমি কখনো অনুভব করিনি। এই অনুভূতি এত জোরালো ছিলো যে দীর্ঘদিন অন্য কোন পরিচালকের সিনেমা দেখিনি। সিনেমা দেখার প্রভাববিস্তারী রুচি তৈরি করে দিয়েছিল কিম।
আমাদের সিনেমা দেখার একটা গ্রুপই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কেউ কুবরিক, কেউ টারান্টিনো, নোলান, ওংকার ওয়াই বা বেলা তারের ভক্ত ছিলাম। কিন্তু দিন শেষে আমরা সবাই কিমের ভক্ত ছিলাম। আবার এমনও না যে তাকে নিয়ে আমরা নেট ঘেঁটে বিস্তর পড়াশোনা করেছি। আমাদের গাইড বইয়ের প্রয়োজন পড়েনি আমরা তার মূল সিনেমা দেখেই তাঁকে আমাদের মতো পড়ে নিয়েছি। গল্প-আড্ডায় তাকে নিত্যই আবিষ্কার করেছি।
কিমের সিনেমায় শুধু গল্প বা নির্মাণ কৌশল দেখেছি তা নয়; আমরা ডুবে গেছি তাঁর দর্শনে। কিম মনে করতো সাদা এবং কালো ভিন্ন নয়, একই।
মানুষের প্রবৃত্তিগুলো শুধু ভালো কিংবা মন্দ নয়। কিম বলেন ‘আমি জগতের কোন বিষয়কে নির্দিষ্ট একটি অর্থে ব্যাখ্যা করিনা।’ কিম সিনেমা দিয়ে প্রশ্ন তুলতো, আমরা উত্তর খুঁজতাম, ক্ষিপ্ত হতাম, আবার একাত্মবোধও করতাম। আমাদের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাকে খাদে ফেলে দিয়ে আবার খাদ থেকে তুলে আনতো চূড়ায়। ‘বেড গাই’ সিনেমার সেই খারপ লোকটা যে রাস্তায় অপরিচিত এক মেয়ের প্রেমে পড়ে তাকে জোর করে চুমু খায়! কি খারাপ কাজটাই না সে করছে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি পেরছি তাকে ঘৃণা করতে ? কি এক অদ্ভুত মানবিকতাই না যুক্ত করছিল তার মাঝে। কিংবা ‘পিয়েতা’ র সেই খুনিটা যে কখনো মায়ের ভালোবাসাই পায়নি সেকিনা তারই হাতে খুন হওয়া একজনের মায়ের ভালোবাসা পেয়ে হয়ে উঠছিলো কোমল শিশুর মতো। স্বেচ্ছাচারী যৌনতার কি করুণ কিংবা বিভৎস রূপই না তৈরি করেছে ‘মোবিয়াস’ সিনেমায়। তার সিনেমার কোন চরিত্রই যেন নিখাঁদ ভালো মানুষ নয় যেমনটা নয় নিকৃষ্ট। এ যেন আমাদের ভেতরকার দ্বৈত সত্তা।
কিমের সিনেমায় ডায়লগ থাকতো কম। আসলে চরিত্রগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলতো না তা নয়। কিম তুলে নিয়ে আসতো তাদের নিঃশব্দ মুহূর্তগুলো। কিম বলতো ‘আমি মনে করি না মুখে উচ্চারিত শব্দমালা সবকিছুই বলতে পারে।’ সিনেমা যে থিয়েটারের ডায়লগ নয়, কাব্যের ঝনঝনানি নয়, গল্পের উপমা নয়। সিনেমা শুধু দেখার এবং দেখার। শুধু দেখেই এর তৃপ্তি। কিম শুধু সিনেমার দার্শনিক ছিলেন তা নয়। তিনি ছিলেন নির্মাণেরও দার্শনিক। আমাদের দেশে এখনো শোনা যায়, ডিরেক্টর যদি হাত কাটা লোক খুঁজে প্রয়োজনে আর্ট ডিরেক্টর সুস্থ লোকের হাত কেটে নিয়ে আসতে বাধ্য। কিম স্প্রিং সিনেমায় একটা মাছ, একটা ব্যাং, একটা সাপ এবং একটা শিশুকে পিঠে পাথর বেঁধে দিয়েছিলেন। ব্যাপারটা একটা মহৎ উদ্দেশ্যে করেছেন এই অজুহাতে শেষ করেননি বরং সিনেমার শেষ অংশে তিনি নিজে অভিনয় করেছেন এবং পিঠে পাথরের মূর্তি বেঁধে পাহাড়ের চুড়ায় উঠে তার প্রায়শ্চিত্ত করেছেন।
সিনেমা একটি সম্মিলিত শিল্প এ-ধারণা ভেঙ্গে দিয়ে কিম নির্মাণ করলো আরিরাং, আমেনের মতো সিনেমা যেখানে নির্মাণ কারিগর শুধুই কিম। কিমের এই প্রয়াস আগামীদিনের নির্মাতাদের জন্য উদ্ভুদ্ধ করবে নিশ্চয়ই।
একটা দুঃখজনক স্মৃতি দিয়ে শেষ করছি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছোট ভাইয়ের চিকিৎসার সাহায্যার্থে সিনেমা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলাম। সেখানে কিমের ‘টাইম’ সিনেমাটি প্রদর্শন করেছিলাম। আমার কাছে এই সিনেমাটি সেরা প্রেমের সিনেমার একটি। ভেবেছিলাম সিনেমাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ভাইবোনদের আকৃষ্ট করবে। এবং প্রেমের সত্যিকারের সৌন্দর্য উপলব্ধি করবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক একটি অনলাইন পোর্টাল নিউজ করেছিলো যে সিনেমা প্রদর্শনীর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে সফ্ট পর্ন দেখানো হচ্ছে। এতে অবাক হয়েছিলাম সত্যি, তবে জানতাম তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের দৌরাত্ম শেষ হয়নি। অনেকে বলে থাকেন কিমের সিনেমা সহিংস এবং বিভৎস। আসলে সত্যিকারের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে হলে এসব এড়িয়ে নয় বরং পার হয়ে তবেই উপলব্ধি করতে হয়।