চালের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি একাধিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষকরা বলেন, চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। কেননা, গরিব মানুষের মোট আয়ের শতকরা ৮০ শতাংশ ব্যয় হয় চাল কিনতে। চালের দাম কমলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আবার দারিদ্র্যসীমার ওপরে যাবে। এ কথা সত্যি, দারিদ্র্যসীমার বিষয়টি কোনো সময়েই স্থিতিশীল নয়। নানা কারণে এ সীমার হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। যেখানে চাল দৈনন্দিন খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে প্রধান উপাদান, সেখানে এর মূল্য বৃদ্ধি হওয়া মানেই দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি, যা আশঙ্কাজনক।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর অধিকাংশ মানুষের জীবনেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, নিম্ন আয়ের অনেকেই জীবিকা হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছেন। যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের অনেকের আবার আয় কমেছে। এমনকি মধ্য আয়ের অনেকেও একই পরিণতি বরণ করেছেন। এর মধ্যে খাঁড়ার ঘা হিসেবে বন্যার প্রকোপ যুক্ত হয়ে দেশের বড় একটা অঞ্চলের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এমতাবস্থায় আয় কমার সঙ্গে যদি জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায় তাহলে সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস কী পর্যায়ে ওঠে তা সহজেই বোধগম্য।
প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ। আর মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন খাদ্য। বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বাধীনতা-উত্তর ৪৭ বছরে যে হারে মানুষ বেড়েছে, সে হারে খাদ্য উৎপাদনও বেড়েছে। তা না হলে ১৬ কোটি মানুষের মুখের আহার যোগান দেওয়া সম্ভব হতো না। এর পরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- অতিবৃষ্টি, আগাম বন্যার কারণে ফলন বিপর্যয় হলে খাদ্য ঘাটতি হয়ে থাকে। আর খাদ্য ঘাটতি হলে বিদেশ থেকে সরকারি-বেসরকারিভাবে খাদ্যশস্য আমদানি করে তা সামাল দেওয়া হয়।
চলতি মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হলেও এবং চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়ছে চালের দাম। হঠাৎ করে চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনটি কারণকে দায়ী করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বাজার-সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, চাল রপ্তানির অনুমোদন, মিলমালিক ও পেঁয়াজের দাম বাড়ার ছায়াপ্রভাব।
গবেষকদের মতে, চাল এমন একটি পণ্য, এর দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে শ্রমজীবী ও গরিব মানুষ। অতএব, চালের দাম যাতে কোনোভাবে না বাড়ে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আমদানি নয়, বরং খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে এবং সরকারি গুদামে প্রয়োজনীয় ধান-চাল মজুত করেই বাজার স্থিতিশীল রাখার ওপর জোর দিতে হবে। খোলাবাজারে কম দামে পর্যাপ্ত চাল বিক্রিও পরিস্থিতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
আমরাও মনে করি, চালের বাজারদর যে কোনো মূল্যেই স্থিতিশীল রাখতে হবে। কারণ দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। চালের বাজার বৃদ্ধি হলে সাধারণ ভোক্তার কষ্ট বাড়ে। এ-ও যেমন সত্য, তেমনি দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, সক্ষমতাও বেড়েছে, আবার রুচিবোধেরও পরিবর্তন হয়েছে। ফলে এখন মানসম্মত চকচকে মরাদানা, ভাঙাদানামুক্ত চিকন চালের চাহিদা বেড়েছে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে চিকন চালের কদর এখন অনেক বেশি। যেমন- মিনিকেট, কাটারি, নাজিরশাইলজাতীয় চালের চাহিদা বেশি। কিন্তু চিকন চাল প্রস্তুত করতে হলে চিকন ধানের প্রয়োজন হয়।
যে কোনো পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে, এটাই স্বাভাবিক। পরিবহন সংকটে চাল সরবরাহ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ফলে চালের বাজারমূল্য কিছুটা বেড়েছে। অবশ্য এ জন্য অনেকেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অতি মুনাফালোভীদের দায়ী করছেন। আবার সরকারের পক্ষেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যেন কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কেউ মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে। অতিমুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে সাধারণ ভোক্তার গলাকাটার অভিযোগকে যেমন উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, তেমনি মূল্য বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে প্রতিকারে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে ভোক্তার কষ্টও লাঘব হবে না।
অন্যদিকে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা যাতে পূরণ হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। চালের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করার সুফলটি যাতে সাধারণ ভোক্তা পান, সে জন্য আমদানিকারকদের ওপরও নজরদারি বাড়াতে হবে।