সরকার প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফলে এখন থেকে এ নদীতে কেউ আর মাছ এবং জলজ প্রাণী শিকার করতে পারবে না। মুজিববর্ষের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২২ ডিসেম্বর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
মিঠা পানির মাছের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে চট্টগ্রামের হালদা নদী বিশ্বেই অনন্য। কিন্তু দখল-দূষণ ও বাঁধের জন্য নদী তার বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছিল। মাছের দেশে যেখানে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ কমে যাচ্ছে, সেখানে হালদা নদীকে দেশীয় মাছের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে রক্ষা করা খুবই জরুরি ছিল। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা নদীটির মাছগুলোকে রক্ষার একটা পদক্ষেপ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় ও মানিকছড়ি উপজেলা, চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি, রাউজান, হাটহাজারী উপজেলা এবং পাঁচলাইশ থানার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদী এবং নদী তীরবর্তী ৯৩ হাজার ৬১২টি দাগের ২৩ হাজার ৪২২ একর জমিকে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করে।
সরকারের গেজেট অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ এলাকায় ১২টি শর্ত কার্যকর হবে। শর্তগুলো হলো- ১. এ নদী থেকে কোনো প্রকার মাছ ও জলজ প্রাণী ধরা বা শিকার করা যাবে না। তবে মৎস্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে প্রতিবছর প্রজনন মৌসুমে নির্দিষ্ট সময়ে মাছের নিষিক্ত ডিম আহরণ করা যাবে। ২. প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী কোনো প্রকার কার্যকলাপ করা যাবে না। ৩. ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট/ পরিবর্তন করতে পারে, এমন সব কাজ করা যাবে না। ৪. মৎস্য ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর কোনো প্রকার কার্যাবলী করা যাবে না। ৫. নদীর চারপাশের বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়ঃপ্রণালী সৃষ্ট বর্জ্য ও তরল বর্জ্য নির্গমন করা যাবে না। ৬. কোনো অবস্থাতেই নদীর বাঁক কেটে সোজা করা যাবে না। ৭. হালদা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১৭টি খালে প্রজনন মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই) মৎস্য আহরণ করা যাবে না। ৮. হালদা নদী এবং এর সংযোগ খালের ওপর নতুন করে কোনো রাবার ড্যাম এবং কংক্রিট ড্যাম নির্মাণ করা যাবে না। ৯. বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ তদারকি কমিটির অনুমতি ব্যতিরেকে হালদা নদীতে নতুন পানি শোধনাগার, সেচ প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা যাবে না। ১০. পানি ও মৎস্যসহ জলজ প্রাণীর গবেষণার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ তদারকি কমিটির অনুমতিক্রমে হালদা নদী ব্যবহার করা যাবে। ১১. মাছের প্রাক প্রজনন পরিভ্রমণ সচল রাখার স্বার্থে হালদা নদী এবং সংযোগ খালের পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। ১২. রুই জাতীয় মাছের প্রাক প্রজনন এবং প্রজনন মৌসুমে (মার্চ- জুলাই) ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল করতে পারবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোট-বড় অনেক নদীর মধ্যে খুব ছোট একটি নদীর নাম ‘হালদা’। পাহাড়, সাগর ও নদীবেষ্টিত চট্টগ্রাম আরও সমৃদ্ধ হয়েছে হালদা নদীর অনন্য বৈশিষ্ট্যের গুণে। হালদা নদী রুই-জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিগনি) মাছের অন্যতম প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। এটি পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে সরাসরি রুই-জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। এ কারণে হালদা নদী বাংলাদেশের জন্য একটি বৈশ্বিক আশীর্বাদও বটে। অথচ দেশের নদী সম্পর্কিত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল কিংবা ইতিহাসে এ নদীর নাম প্রায় অনুল্লেখিত ছিল। মৎস্য, কৃষি ও পানি সম্পদের প্রাচুর্যে হালদা নদীর অর্থনৈতিক অবদান জাতীয় পর্যায়ে ৮০০ কোটি টাকা, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৬ শতাংশ। তাই দেশের সাদা সোনার খনি নামেও এ নদীর পরিচিতি আছে। এক গবেষণায় দেখা যায়, একটি মা মাছ প্রতি বছর ৪ ধাপে মৎস্য উৎপাদন ও জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে। হালদা একমাত্র নদী যেখান থেকে আহরিত মাছের ডিম স্মরণাতীত কাল থেকে স্থানীয় জ্ঞানের মাধ্যমে প্রাচীন পদ্ধতিতে নদীর পাড়ে খননকৃত মাটির গর্তে (কুয়ায়) ফোটানো হয় এবং চারদিন লালন করে রেণু পোনা তৈরি করা হয়। এ নদীর রুই-জাতীয় মাছের বৃদ্ধির হার অন্যান্য উৎসের মাছের তুলনায় অনেক বেশি। এর ফলে মৎস্যচাষী ও হ্যাচারি মালিকরা হালদা নদীর রুই-জাতীয় মাছের চাষ কিংবা প্রজনন ঘটিয়ে বেশি লাভবান হতে পারে। ব্রিটিশ আমলে সারা দেশের দুই-তৃতীয়াংশ পুকুরে মৎস্য চাষ হালদার পোনা দিয়েই করা হতো। যা হোক, হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা মুজিববর্ষের প্রতিশ্রুতিরই বাস্তবায়ন। এ ঘোষণায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, হালদা অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক অনন্য সম্পদ।