ইসলাম ধর্মের সাধন-মার্গের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অধ্যায় সুফিতাত্ত্বিক সাধনা তথা সুফিবাদ। এই সুফি সাধনারই একটি বিশেষ ধারা ‘মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকা’। “গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারী (ক.) [১৮২৬-১৯০৬] প্রবর্তিত ও প্রতিষ্ঠিত এই ত্বরিকার আধুনিক রূপকার ছিলেন তাঁরই রক্ত আদর্শ এবং বেলায়তের উত্তরাধিকারী বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)। তৎ জমানার তাপসকুলের শিরোমনি এই মহান সাধকের ৯২তম পবিত্র খোশরোজ শরিফ উপলক্ষে কিঞ্চিৎ স্মৃতিচারণ।
পবিত্র নাম মোবারক : বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)।
পিতা : অছিয়ে গাউসুল আযম খাদেমুল ফোকারা হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.) [১৮৯৩-১৯৮২]।
মাতা : গাউসুল আযম বিল বিরাসত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ গোলাম রহমান মাইজভাণ্ডারী প্রকাশ: হযরত বাবা ভাণ্ডারী (ক.)’র [১৮৬৫-১৯৩৭] দ্বিতীয় শাহ্জাদী ‘উম্মুল আশেকীন সৈয়দা সাজেদা খাতুন (র.)’ [-১৯৬৮]।
পিতামহ : প্রথম মোন্তাজেম-এ-দরবার, বেলায়তে মা’আব শাহ্জাদা হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ ফয়জুল হক ফানা-ই ওয়াসেল মাইজভাণ্ডারী (ক.) [১৮৬৫-১৯০২]
প্র-পিতামত : বাংলার মাটিতে প্রবর্তিত একমাত্র ত্বরিকা, বিশ্বসমাদৃত ‘ত্বরিকা-ই-মাইজভাণ্ডারীয়া’র প্রবর্তক গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহ্সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারী (ক.) [১৮২৬-১৯০৬]।
শিক্ষা জীবন : জীবন ও জগতকে জানার প্রয়োজনে শিক্ষার ভূমিকা অপরিহার্য। হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (ক.)’র দোয়ার মেহেরাব নামীয় হুজরা শরিফে মহান অলিয়ে কামেল পিতার মুখে মুখেই প্রথম ‘রাব্বী যিদনি ইলমা’ বলে শিক্ষা জীবনে যাত্রা শুরু করেন। গৃহ শিক্ষক মাওলানা মোজাম্মেল হক সাহেবের নিকট আরবি ও মাইজভাণ্ডার আহমদিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় পিতার তত্ত্বাবধানে তৃতীয় শ্রেণি পাস করার পর ১৯৪১ সালে মাওলানা মোজাহেরুল হক (বিএবিটি) সাহেবের সাথে তারই তত্ত্বাবধানে ফটিকছড়ি করোনেশন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়স্থ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। অনূর্ধ্ব ১ বছর অতিক্রমান্তে ঐ শিক্ষক বিএবিটি সাহেবের আকস্মিক মৃত্যুতে আবার বাড়ি ফিরে পার্শ্ববর্তী নানুপুর আবু সোবাহান উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ঐ স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে কৃতিত্ব রাখেন। উল্লেখ্য যে, তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পিতার আগ্রহে আরো উচ্চ শিক্ষার জন্য চট্টগ্রাম কলেজিয়েট হাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি ও ১৯৪৭ সালে যুদ্ধকালীন প্রতিকুলতা সত্ত্বেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান দৈনিক পঞ্জাজন্য পত্রিকায় ১৯৪৮ সালের ৩১ আগস্ট এস এস সি পরীক্ষায় কৃতিত্বের ফলাফল প্রকাশিত হয়। পরে চট্টগ্রাম গভর্নমেন্ট কলেজ হতে ১৯৫১ সালে আই এ পাস করেন। ১৯৫৩ সালে বি এ পরীক্ষার তৃতীয় দিনে পৈত্রিক সূত্রে আধ্যাত্মিক প্রভাব প্রকাশ পেয়ে গেলে সাদা খাতা জমা দিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে খোদায়ী পরীক্ষায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৫৩ সালে বাড়ি ফেরার কিছুদিন পর তিনি আহার নিদ্রা একেবারেই ত্যাগ করেন। আধ্যাত্মিক বিভোরতাক্রমশঃ এতই বৃদ্ধি পেতে লাগলো যে, সামনে যাকে পান তাকে মারধর করতে লাগলেন। “নামায-কালাম না পড়ে কিশের এতো নাচানাচি” ইত্যাদি বকাঝকা করে মানুষকে সামনে থেকে তাড়াতে লাগলেন। এমতবস্থায় পিতার কাছে অভিযোগ গেলে পিতা কারণ জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে তিনি কিছু একান্ত প্রশ্ন করার অনুরোধ করেন। পিতা অনুমতি দিলে হুজরা শরিফের দরজা বন্ধ করে পিতার কাছে প্রশ্ন করলেন। ‘‘হযরত কেবলা কে? বাবাজান কেবলা কে’? পিতা জবাব দেন, ‘‘আল্লাহ্র অলি-দু’য়ে মিলে এক’’। পুত্র আবার প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনি কে? তিনি উত্তর দেন, ‘আমি হযরতের অছি’ এবং বাবাজান কেবলার ফয়েজপ্রাপ্ত। তাঁরা আমার মধ্যে আছেন’’। পুনঃ কি যেন প্রশ্ন করলেন (অশ্রুত)। এতে পিতা উচৈস্বরে (রাগত) বলেন, ‘‘আমাকে এখনো চিন নাই? আমি কে তা কি দেখবে’’? তারপর অনেকক্ষণ নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ।
দরোজা খুলে দিলে বাইরে অবস্থানরত লোকেরা দেখে পিতার মুখমন্ডল রক্তিম লালিমাময়। পুত্র দু’হাতে ভর দিয়ে মুখ নীচু করে বসে আছেন, ভীত-বিহ্বল, মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। পিতা খাদেমদের নির্দেশ দিলেন, ‘‘ওকে অন্দর বাড়িতে নিয়ে যাও’’। ধরাধরি করে তাঁকে মায়ের বিছানায় নিয়ে শোয়ানো হলো। ছেলের অবস্থায় মা রুদ্ধবাক্। সেবিকারা মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। বহুক্ষণ পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেন। কিন্তু রাতে ঘুম হয় না। এ ঘর ও-ঘর ছোটাছুটি করেন। বাবার হুজরায় গিয়ে বারবার ডাকতে থাকেন। পিতার স্নেহভরা কণ্ঠ, ‘ঘুমুতে যাও’।
বায়াত ও খেলাফত : বুযুর্গ পিতার ব্যবস্থাপনায় তৎকালীন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিবে আযম আল্লামা সফিরুর রাহমান হাশেমী (র.) সাহেবের উপস্থিতিতে মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকার প্রবর্তকের দোয়ার মেহরাবে (গদি শরিফে) ত্বরিকার নীতি অনুসারে “সবক” পাঠান্তে আপন পিতার হাতে বায়াত হন। ১৯৬৬ সালে ২২ জানুয়ারি ৯ মাঘ, ১৩৭৩ বাংলা হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর উরস শরিফের পূর্বদিন দেশ-বিদেশ থেকে আগত মেহমানগণের উপস্থিতিতে আধ্যাত্মিক পিতা ও জাগতিক হযরত অছিয়ে গাউসুল আযম সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.) তদ্বীয় মুর্শিদ ও ‘ত্বরিকা-ই-মাইজভাণ্ডারীয়া’র প্রবর্তক গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহ্সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারী (ক.) এর স্বপ্নাদেশ “জিয়াউল হক মিঞার আমানত তাঁকে অর্পণ করুন” পালনার্থে হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর গদি শরিফে বসিয়ে খেলাফতের এ মহান খোদায়ী গুরুভার গ্রহণ করেন।
সংসার জীবন : ১৪ মাঘ, ১৩৬২ বাংলা, ৮ জানুয়ারি ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ মঙ্গলবার, নিজ পিতার সনামধন্য মুরিদ চট্টগ্রাম ফটিকছড়ির প্রখ্যাত জমিদার জনাব বদরুজ্জামান সিকদার সাহেবের কনিষ্ঠা কন্যা মোমাম্মৎ মুনওয়ারা বেগম এর সঙ্গে এ মহান সাধকের জীবন পরিণয় সূত্র ঘটে।
রিয়াজত-সাধনা : বাংলাদেশের পাহাড়, পর্বত, শহর নগরের সর্বত্র তিনি ঘুরেছেন। ১৯৫৪ সাল হতে ওফাতপূর্ব পর্যন্ত এক রাত ঘুমিয়ে কাটাতে প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ দেখেন নি। এমন কঠোর রিয়াজত-সাধনার মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামিনের এতই নৈকট্য হাসিল করেছেন যে, নিজ জবানে তা এভাবে প্রকাশ করেন “হে বিশ্ববাসী! আমার দিকে তাকাও। আমাকে বুঝতে হলে কোরআন দেখ”, “আকাশের উপরে বসে আমি মানুষের কাজকর্ম দেখি আর উপরের দিকে আল্লাহ্র সাথে কথা বলি”, “রহমাতুল্লিল আলামীন রাসূলের রহমতের সীমা জুড়ে আমার বেলায়তী কর্ম-ক্ষমতা”। নিজের অবস্থা এবং অবস্থানকে স্পষ্ট করতে গিয়ে তিনি আরো ঘোষণা করেন “আমার দরবার আন্তর্জাতিক প্রশাসন অফিস, সেখান থেকে এ বিশ্ব পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়”, “আমার ত্বরিকা দুই পয়সার ত্বরিকা নয়, আমার ত্বরিকা কোটি কোটি গুণ বড়”।
কারামত : তাঁর জীবনী গ্রন্থে প্রায় ১৩৪টির বেশি কারামত উল্লেখ থাকলেও তেল ছাড়া গাড়ি চালানোর কথা এবং তাৎক্ষণিক মানুষের হাযত মকসুদ পূরণে অকাতরে দান দক্ষিণা সহযুক্ত মানবতার কথা বেশ উল্লেখযোগ্য।
ওয়ারিশান / ওফাত : তিনি ৫ কন্যা সন্তান ও একমাত্র (বর্তমান মাইজভাণ্ডার শরিফ গাউসিয়া হক মন্জিলের সাজ্জাদানশীন) পুত্র সন্তানের কাছে এই সু-বিশাল দরবারে পাকের গুরু দায়িত্বভার অর্পণ করে এ মহান অলি ওফাত লাভ করেছেন ১৩ অক্টোবর ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ, ২৬ আশ্বিন ১৩৯৫ বাংলা, ১ রবিউল আউয়াল ১৪০৯ হিজরি, বুধবার। পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণের সময় তাঁর বিছানা ছিল জিকিরের বিছানা। যেমনভাবে তাঁর পুরো জীবন ছিল জিকিরের জীবন। তিনি ওফাত লাভ করেছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালে। ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। চট্টগ্রামের বহুল প্রচারিত ‘আজাদী’ ও ‘পূর্বকোণ’সহ বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকার ভাষ্যমতে এটি ছিল দেশের দরবার শরিফসমূহের মধ্যে স্মরণকালের বৃহত্তম নামাযে জানাযা। মাইজভাণ্ডার শরিফ গাউসিয়া হক মন্জিলের উদ্যোগে প্রতি বছর ২৬ আশ্বিন, ১১ অক্টোবর মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে তাঁর বার্ষিক উরস মোবারক অনুষ্ঠিত হয়।
লেখক : সুফিবাদী লেখক ও গবেষক