দেশের সরকারি বড় বড় মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এসব প্রকল্পের কারণে বিগত কয়েক বছরে দেশে আমদানিকৃত পাথরের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। আবার শিল্প কারখানায় বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লার আমদানিও বেড়েছে। ফলে কর্ণফুলী নদী কেন্দ্রিক ঘাটগুলোতে বেড়েছে এসব পণ্যের খালাস। পাথর ও কয়লা খালাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সুযোগে কর্ণফুলী নদীর ঘাটগুলোতে বাধ্যতামূলক বকশিসের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে সরকারি প্রকল্পগুলোতে প্রকল্প ব্যয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মত প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। জানা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পদ্মা সেতু, মীরসরাই ইকোনোমিক জোন, কর্ণফুলী টানেল, মহেশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র, রিং রোড, ওয়াসার ভাণ্ডালজুড়ি প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প, পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল, সীমান্ত সড়ক, মেট্রোরেলসহ বেশ কয়েকটি উড়াল সেতু নির্মিত হচ্ছে। এসব প্রকল্পের বড় উপকরণ হচ্ছে পাথর। দুবাই, আফ্রিকা, ওমান বাদেও ভারতের গুজরাট থেকে আমদানি হচ্ছে বেশিরভাগ পাথর। বাল্কবাহী মাদারভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ জাহাজে অনেক সময় প্রকল্পস্থানে চলে গেলেও একটি বড় অংশ সড়ক পথে পরিবহন করতে হয়। যে কারণে কর্ণফুলী নদীর ১৫টি ঘাটে লাইটার থেকে ট্রাকে খালাস হয় পাথর। আবার আমদানিকৃত কয়লাও একইভাবে খালাস হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নগরীর বাংলাবাজার, স্ট্যাণ্ড রোড, মাঝিরঘাট, সদরঘাটকেন্দ্রীয় একে খান ঘাট, আসামবেঙ্গল ঘাট, বাংলা ঘাট, জুটর্যালি ঘাট-১, জুটর্যালি ঘাট-২, গ্যাস র্যালি ঘাট, এভারগ্রিন ঘাট, আদম ঘাট, আরগ ঘাট, কনফিডেন্স ঘাট, হোমল্যাণ্ড ঘাট, ডিএসপি ঘাট, আঁরাচান ঘাট, সদরঘাটসহ কর্ণফুলী নদীর ১৮-১৯টি ঘাটে পাথর, কয়লা স্ক্র্যাপ, সিমেন্ট ক্লিংকার, সার, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন পণ্য খালাস হয়। কমপক্ষে ১০টি ঘাটে পাথর ও কয়লা খালাস হয়। ঘাটগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৭০ ট্রাক হিসেবে দিনে কমপক্ষে ৫০০ ট্রাক পাথর ও কয়লা লোড হয়। বেশিরভাগ পাথর ও কয়লা খালাস হয় সরাসরি ক্রেনের সাহায্যে। তবে ক্রেনে লোড দিলে লাইটারেজের সলিন লোড দেয়ার জন্য অল্প কয়েকজন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ক্রেনে লাইটারেজ থেকে পাথর খালাসের জন্য আমদানিকারক প্রতিটনে ২২০-২৪০ টাকা ঘাট খরচ দিয়ে থাকে। এসবের মধ্যে প্রতিটন পাথর লোড-আনলোডের জন্য লেবার চার্জ (শ্রমিকের মজুরি) ৯৫ টাকা, ক্রেন চার্জ ৬০ টাকা, ঘাট মালিক ৪০-৫০ টাকা, লেবার ঠিকাদার পেয়ে থাকেন ১৫-২০ টাকা। প্রতিটি ডাম্প ট্রাকে ৩০ টন পাথর লোড হয়। আমদানিকারকদের কাছ থেকে সরবরাহকারী ব্যবসায়ীরা কিনে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে সরবরাহ দেয়। এক্ষেত্রে প্রতি ট্রাকে এক হাজার টাকা করে লেবার বকশিস দিতে হয় সরবরাহকারী ব্যবসায়ীকেই। অনেক সময় সরবরাহকারীর পক্ষে আমদানিকারককেও এ বকশিস পরিশোধ করতে হয়। আবার খোলা ট্রাকে কয়লা লোডে বকশিস দিতে হয় ১৬-১৮শ টাকা।
শনিবার দুপুরে সরেজমিন মাঝিরঘাটের এভারগ্রিন ঘাটে দেখা যায়, ঘাটের লাইটারেজ থেকে ক্রেনের মাধ্যমে সরাসরি ট্রাকে পাথর লোড দেয়া হচ্ছে। এসময় কথা হলে ঘাট পরিচালনাকারী ঠিকাদারের অপারেশন কো-অর্ডিনেটর মো. সাগর আলী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ট্রাক লোডের জন্য লেবার চার্জ আমরা দিয়ে থাকি। এসব লেবার চার্জ আমরা আমদানিকারক কিংবা লাইটার মালিকদের কাছ থেকে আদায় করি। আবার পাথর সরবরাহকারীদের কাছ থেকে প্রতি ট্রাকে এক হাজার টাকা বকশিস হিসেবে নেয় লেবাররা। এগুলো বাধ্যতামূলক।’
এরপর কথা হয় ঘাটের লেবার মাঝি শাহজাহান হাওলাদারের সাথে। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ট্রাক লোড করতে ঘাট ঠিকাদাররা টন প্রতি লেবার চার্জ দিয়ে থাকে। বর্তমানে ট্রাক লোড দিলে প্রতি টনে ৯৫ টাকা লেবার চার্জ পাওয়া যায়। বকশিসটাও শ্রমিকরা নেয়। এটি শ্রম মন্ত্রণালয় ও চেম্বার থেকে পাস হয়ে এসেছে। বকশিসটা লিখিত নেই, মৌখিকভাবে শ্রমিকরা নেয়। কর্ণফুলীতে যে ১৮-১৯টি ঘাট আছে সবগুলোতেই এই বকশিস প্রচলন রয়েছে। এসব লেবাররাই (শ্রমিক) ভাগ করে নেয়।’
পরে স্ট্যান্ডরোডের জুটর্যালি-১ ঘাটে কথা হয় ঘাট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান কন্টিনেন্টাল এজেন্সির ম্যানেজার আবদুল আজিজের সাথে। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমি ১৯ বছর ধরে এসব কাজে জড়িত। আমি এই ঘাট পরিচালনা করি। পাথর লোডে প্রতি ট্রাকে এক হাজার টাকা লেবার বকশিস দিতে হয়। আবার কয়লার ক্ষেত্রে আরো বেশি। খোলা ট্রাকে কয়লা লোডের ক্ষেত্রে প্রতি ট্রাকে ১৬-১৮শ টাকা বকশিস দিতে হয়। এখানে হাতে ট্রাক লোড দেয়া হয় না, সবই হয় ক্রেনে। কিন্তু বকশিস নেয় শ্রমিকরা। আমার ঘাটে দিনেরাতে গড়ে ৭০ ট্রাক লোড হয়। গ্যাস র্যালি ঘাটেও একই পরিমাণ লোড হয়। সবগুলো ঘাটে দিনে প্রায় ৫শ ট্রাকের মতো লোড হয়।’ তিনি বলেন, পাথর ও কয়লা লোডে বকশিসগুলো এক্কেবারে ভুয়া। ক্রেনে ৫-৬টা সলিনে একটি ট্রাক লোড হয়ে যায়। এক সলিনে ৫টন মাল (পণ্য) উঠে। এতে প্রতি ট্রাকে এক হাজার টাকা বকশিসকে তিনি জুলুম বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘লোকাল ও সারের ট্রাক আলাদা। এসব ট্রাক লোডে টনপ্রতি বকশিস নেয়। তাছাড়া এসব বকশিস শ্রমিকরা পেলেও শ্রমিক সংগঠনগুলো আবার ঘাট কন্ট্রাকটর থেকে মাল (পণ্য) হিসেব করে আলাদা কমিশন নিয়ে যায়। অনেক সময় নগদে, অনেক সময় চেকে তারা এসব কমিশন নিয়ে থাকে।’
নয়ন বড়ুয়া নামের এক পাথর সরবরাহকারী শনিবার দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পাথর হচ্ছে এখন সরকারি সব উন্নয়ন প্রকল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ। এটির কস্টিং বেড়ে গেলে উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। মাঝিরঘাট, সদরঘাট, বাংলাবাজার এলাকার বেশিরভাগ ঘাটে ক্রেনের সাহায্যে ট্রাক লোড করা হলেও শ্রমিকের বকশিস হিসেবে প্রতি ট্রাকে বাধ্যতামূলক এক হাজার টাকা দিতে হয়। বকশিসের নামে এ ধরণের চাঁদাবাজি বন্ধ হলে ছোট সরবরাহকারী হিসেবে আমরা উপকৃত হতাম।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আমদানিকারক দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০ ট্রাকে ১৫ হাজার টন পাথর লোড হয়। এসব ট্রাকে বকশিসের নামে এক হাজার টাকা করে দৈনিক ৫ লক্ষ টাকা চাঁদাবাজি হয়। এতে মাসে দেড় কোটি টাকা। এসব ব্যয় সরকারি প্রকল্পের উপর বর্তাচ্ছে। এতে সরকারি প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ছে। কর্ণফুলী ঘাটের এসব চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা বিগত সময়ে বড় বড় নেতাদের সাথে বেশ কয়েকবার বৈঠকও করেছি। নেতাদের ইন্ধনে এখানে চাঁদাবাজি হচ্ছে।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘কেউ খুশি হয়ে বকশিস দিতে পারে। তবে কোন সরবরাহকারী কিংবা আমদানিকারক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বকশিসের নামে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করা হলে অবশ্যই চট্টগ্রাম চেম্বারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
ঘাট ও গুদাম শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন আখন দৈনিক আজাদীকে বলেন, বকশিস নিয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারে শ্রমিক, ঘাট মালিক, আমদানিকারকসহ চেম্বার নেতৃবৃন্দের সাথে উভয়পক্ষের বৈঠকের সিদ্ধান্ত আছে। আগে প্রতিটনে ঘাট খরচ ২৫০-২৬০ টাকা দিতো। এখন কম দিচ্ছে। প্রতিটনে ২২০ টাকা দিচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকরা মানছে না। এজন্য শ্রমিকরা বকশিস নিচ্ছে।’ তবে শ্রমিক সংগঠনগুলো আলাদা কমিশন নেয়ার বিষয়টি সত্য নয়।
সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এম এম মেহেদী হাসান শনিবার দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর ঘাটগুলোতে শ্রমিকদের চাঁদাবাজি বিষয়ে আমরা অবগত নই। বিষয়টি আমাদের নজরে ছিল না। এখন যেহেতু শুনেছি সে বিষয়ে খোঁজ নিব। তারপরও কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসে তাহলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’