বাংলাভাষা ও সাহিত্যের চিন্তাশীল লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ড. রশীদ আল ফারুকী ছিলেন সাহিত্য- সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক ক্ষণজন্মা পুরুষ। এই মহান মানুষটি ছিলেন আপন চিন্তা ও কর্মে মননশীলতায় ঋদ্ধ, সমাজমনস্ক মানবিকতাবাদী এবং প্রকৃত অসামপ্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
১৯৪০ সালের ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার গুপ্তাখালী গ্রামের এক বিশিষ্ট আলেম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম খায়ের উল বশর। তবে ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন সর্বত্রই তিনি রশীদ আল ফারুকী নামেই পরিচিত।
সাহিত্যচর্চার শুরুতে তিনি প্রথমে খায়ের উল বশর নামেই সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর স্বল্পকালীন রাজনৈতিক জীবনেও পীরজাদা খায়ের উল বশর নামে ছিল তার পরিচিতি। কিন্তু লেখালেখির গণ্ডীতে রাজনৈতিক পরিচয় এসে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এই আশংকায় পরবর্তীতে লেখক হিসেবে তিনি রশীদ আল ফারুকী নামটা গ্রহণ করেন।
পারিবারিকভাবে নির্ধারিত মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা দিয়েই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৬০ সালে ‘সীতাকুণ্ড টেরিয়াল হাইস্কুল’ থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও ১৯৬৫ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক থাকাকালীন উচ্চতর গবেষণার জন্য ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং ১৯৮১ সালে সেখান থেকে সাফল্যের সাথে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
রশীদ আল ফারুকী ছিলেন বিশাল এক বৈচিত্র্যময় চরিত্রের অধিকারী। শিক্ষকতা, রাজনীতি, সাহিত্যচর্চা, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডসহ বিপুল কর্মযজ্ঞে নিজেকে সর্বদা ব্যাপৃত রাখতেন তিনি। তরুণ বয়সে সমমনাদের নিয়ে ‘সুন্দরম্’ নামক এক পত্রিকা বের করেছিলেন তিনি। সেখানে তিনি জানান দিয়েছিলেন যে, ‘শিল্পসাহিত্য শুধু মানবজীবনের এবং ব্যক্তিমানসে বাহ্যিকশক্তির প্রতিক্রিয়ার প্রতিচ্ছবি নয়। অর্থনৈতিক চাপের ফলে জীবনের সম্ভাবনা ব্যাহত হতে থাকলে ব্যক্তির মনে যে প্রতিক্রিয়া সূচিত হয়, তাই যেন আজ সাহিত্যে বড় হয়ে দেখা দিতে চাইছে। তাই সমস্যাকে শুধু তুলে ধরা নয়, সমাধানের প্রতি ইংগিতও আমরা করবো বাংলাসাহিত্যে।’ বৃহত্তর গণজীবনের এই দায় থেকেই আমৃত্যু কাজ করে গেছেন তিনি।
ড. রশীদ আল ফারুকী ছিলেন সত্যিকারের একজন কর্মবীর পুরুষ। তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যিক শিক্ষা ও সামাজিক পরিবেশ সাহিত্যরচনার ক্ষেত্রে মোটেও অনুকূল ছিল না। কিন্তু জীবনযাত্রার এক বৈরী পরিবেশের মাঝে বেড়ে উঠেও একমাত্র আপন একাগ্র সাধনায় বিচিত্র ও বহুমুখীচর্চায় নিয়োজিত রেখে কিভাবে নিজেকে একজন মহান চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বে পরিণত করা যায় তার জ্বাজল্য প্রমাণ হলেন ড. রশীদ আল ফারুকী।
অত্যন্ত গোঁড়া এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও চিন্তার প্রসারতা আর অসামপ্রদায়িকতাই ছিল তাঁর জীবনের সার্বিক শিক্ষা, চিন্তাচেতনা ও সাহিত্য রচনার মূল স্তম্ভ। যুক্তিবাদিতা, বিজ্ঞানমনস্কতা আর মানবিক চেতনাই ছিল তাঁর সাহিত্যচেতনার নির্যাস। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য রচনাপঞ্জির মধ্যে রয়েছে, ‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’, ‘বাংলার জাগরণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ ‘বাংলা উপন্যাসে মুসলমান লেখকদের অবদান’, ‘রুচি ও প্রগতি’, ‘হারকিউলিসের দুঃসাহসিক অভিযান’ প্রমুখ।
রাজনৈতিকভাবেও তিনি একসময়ে খুব সক্রিয় ছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই ‘আয়ুব বিরোধী আন্দোলন’ ও ঢাকায় ‘শিক্ষা আন্দোলনে যুক্ত থাকায় দুই দফায় কারাবাস করতে হয়েছিল তাঁকে। কর্মজীবনে পরবর্তীতে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসলেও আদর্শগতভাবে আজীবন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারাতেই উজ্জীবিত ছিলেন তিনি। ধর্মভিত্তিক শিক্ষা এবং রাজনীতির যে ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি সেটা তাঁর বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে পরিলক্ষিত হয়।
১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামের রাউজান কলেজে প্রভাষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবনের শুরু। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু তিনি এই পদেই দায়িত্ব পালন করেছেন।
কর্মময় জীবনে তিনি ছিলেন ‘বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটি’র আজীবন সদস্য, ‘বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষদ’ এর সভাপতি। এছাড়াও ‘উদীচী’ সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। বর্ণাঢ্য হলেও অত্যন্ত স্বল্পায়ু জীবন ছিল রশীদ আল ফারুকীর। তাঁর জীবনকাল ছিল মাত্র ৪৮ বছর।
এত অল্পসময়ে যেখানে সাহিত্যসৃষ্টির প্রস্তুতিতেই কেটে যায় অনেকের, সেখানে তাঁর সৃষ্টিশীলতা যেন সময়কেও হারিয়ে দিয়েছে। এই স্বল্পকালস্থায়ী জীবনেও সামাজিক পরিবর্তন ও রূপান্তরকে তিনি তাঁর চিন্তাচেতনার কেন্দ্রে স্থান দিয়ে প্রচুর সাহিত্য-সংস্কৃতিধর্মী ও সৃজনশীল কাজ করে গেছেন আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবহনকারী এই ব্যক্তিত্ব।
রশীদ আল ফারুকী ছিলেন একই সময়ে অনেকগুলো কাজ সম্পাদন করা অফুরান প্রাণশক্তিপূর্ণ এক মানুষ। এত স্বল্প আয়ুষ্কালেও তাঁর ছিল এক সমৃদ্ধ রচনাসম্ভার। জীবিত অবস্থায় তাঁর ১৭টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে ১০টি প্রবন্ধগ্রন্থ, ৪টি সম্পাদিত গ্রন্থ, ১টি জীবনীগ্রন্থ, ১টি কিশোরগ্রন্থ ও ১টি অনুবাদগ্রন্থ।
অধ্যাপনা, লেখালেখি আর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড প্রভৃতি নিয়ে সারাজীবন এতই ব্যস্ত ছিলেন যে, নিজের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার কোন অবকাশই পাননি এই নিবেদিতপ্রাণ মানুষটি। ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে হঠাৎ করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ১৯৮৭ সালের ১৯ডিসেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন এই মহান ব্যক্তিত্ব।
লেখক : প্রাবন্ধিক