মানুষ মাত্রই মরণশীল, একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে পরকালে-গহীন অরণ্যের দেশে। যেখানে থাকবে না পাখ-পাখালির আসর, সবুজের সমারোহ আর নদ-নদীর কলতান। মাটির আঁধার দেশে থাকবে না কোন বিনিদ্র আয়োজন, হইহুল্লোড় আর আনন্দের মিছিল। হিসাবে হিসাবে জর্জরিত হতে হবে কবরবাসীকে। জিন্দেগীর হিসেব-নিকেশ থাকবে চোখের সামনে আর এই কবর থেকেই শুরু হয়ে যাবে কবরবাসীর কেয়ামতের প্রথম অধ্যায়। এখান থেকেই নির্ধারিত হয়ে যাবে জান্নাত আর জাহান্নামের ফয়সালা। খাতেমুন নাবিয়্যিন, সায়্যিদুল মুরসালিন, মানবতার মহান মুক্তিদূত, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আদর্শ অনুসরণ এবং এত্তেবা না করার কারণে কঠিন আযাবের মুখোমুখি হতে হবে কবরবাসীকে আর মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় মহাগ্রন্থ আল্-কোরআনই হবে সেই কঠিন আঁধারের দিনে একমাত্র আলোকবর্তিকা। যারা জিন্দেগীভর পবিত্র কোরআনকে অতি আপন করে নিয়েছিলেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, কোরআনকে গাইড-লাইন হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে, যারা এই কোরআনের সহযোদ্ধা হয়েছে-তারাই কবরের কঠিন আযাব থেকে নিষ্কৃতি পাবে সেদিন। সৃষ্টিকূলের রব আল্লাহর সেই অমোঘ বিধানকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়িত না করার কারণে সেই কঠিন দিনে, কবরের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে পাহাড়সম আযাব সইতে হবে। মৃত্যু নামক অমোঘ বিধানকে অস্বীকার করার কোন ক্ষমতা আশরাফুল মাখলুকাতের নেই। প্রতিটি ধর্ম, প্রতিটি বর্ণ, প্রতিটি সম্প্রদায়, প্রতিটি গোষ্ঠীর মানুষকে মুখোমুখি হতে হবে আল্লাহতায়ালার সামনে। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ যেন মৃত্যুর সাইরেন, আর তা বেজে উঠলেই চলে যেতে হবে সীমাহীন সীমানায়, অনির্দিষ্ট ঠিকানায়-নিঃসীম নিবাসে আর মুু’মিন ব্যক্তিরা তার আগেই বিনিয়োগের পাল্লা ভারি করে রাখেন কবরের কঠিন আযাবের ভয়ে আর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব-আসমানের নীচে আর জমিনের উপর দ্বিতীয় কোন সত্য কিতাব নেই- এর প্রতিটি বর্ণের উপর ঈমান এনেছে যারা তারাই হবে সেই কঠিন দুর্যোগের মুহূর্তে সফলকাম, অনন্য রাহ্বার। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) কে এত্তেবা করতে হবে প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি ক্ষণে, শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণুর সাথে। তাইতো পবিত্র কালামে পাকের অন্তত ত্রিশের অধিক আয়াতে আমার রাসূল (সা) এর আনুগত্যকে ফরজ করা হয়েছে। সূরা আল ইমরানের ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী,) তুমি বলো, তোমরা যদি আল্লাহতায়ালাকে ভালোবাসো, তাহলে আমার কথা মেনে চলো, আল্লাহতায়ালাও তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তিনি তোমাদের গুনাহখাতা মাফ করে দেবেন; আল্লাহতায়ালা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াবান’। তুমি বলো, তোমরা আল্লাহতায়ালা ও (তাঁর) রাসূলের কথা মেনে চলো, তারা যদি (এ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয় (তাহলে জেনে রেখো), আল্লাহতায়ালা (তাঁর রাসূলের আনুগত্য) অস্বীকারকারীদের পছন্দ করেন না’। আমার রাসূল (সা.) কে আনুগত্য করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, সমাজ জীবনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে তাঁর আনুগত্যের ছায়া থাকা চাই। বিশ্বনবীকে ভালোবাসলেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিনকে ভালোবাসা বোঝা যায় আর এটাই তাঁর সত্য কিতাব গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থের অস্তিত্ব থাকবে না সেই কঠিন বিচারের দিনে-একটি গ্রন্থই সমুজ্জ্বল, অতি উজ্জ্বল আলোকিত ভাস্বর হয়ে দিগ্বিদিক আলোচ্ছটা ছড়াতে থাকবে সেই সত্য কিতাবটি আর তা হল, পবিত্র কোরআন আর আল্-কোরআন। দুনিয়ার জীবনে এ কিতাবকে আমরা মর্যাদার আসনে বসাতে পারিনি, পৃথিবীর সমস্ত কিতাবের উপর স্থান দিতে পারিনি, কোরআনের অবমাননায় কোন প্রতিবাদ করিনি- সেটা আমাদের সমস্ত বিশ্বাস আর আয়োজনকে কুরে কুরে খাবে কঠিন বিচারের মহাপ্রলয়ের দিনে। পৃথিবীর অপরাপর ধর্মগ্রন্থ, পাঠ্যপুস্তকের কিতাব যে অসাড়, নিঃসাড়, অন্তসারশূন্য-সেটাই কঠিন বিচারের ময়দানে উজ্জ্বলভাবে প্রমাণিত হবে। কোরআনকে আপন না ভাবার কারণে কঠিন আযাব পোহাতে হবে সেই মহাবিচারের দিনে-সেটি ভাববার এখনই উপযুক্ত সময়। বছর বছর পবিত্র কোরআনের উপর জুলুম করে চলছি আমরা, কোরআনকে অধ্যয়ন করি না, কোরআনকে বুঝি না, কোরআনের অর্থ সম্পর্কে কোন জ্ঞানই নেই আমাদের-প্রতিবছর রমজানের দিনে কোরআন খতম করি বটে, তারাবিহ্র সময় পুরো কোরআন খতম করা হয় বটে, ইছালে ছওয়াবের সময় তোতা পাখির মতন আমরা কোরআন পড়ি বটে কিন্তু কোরআনের মর্ম বুঝি না, কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা পড়ার চেষ্টাও করি না-এটা সেই কঠিন বিচারের দিনে কোরআন আমাদেরকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) কে আনুগত্যের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের আন্-নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদার মানুষেরা, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, আনুগত্য করো (তাঁর) রাসূলের এবং সেসব লোকদের যারা তোমাদের মাঝে দায়িত্বপ্রাপ্ত, অতপর কোনো ব্যাপারে তোমরা যদি একে অপরের সাথে মতবিরোধ করো, তাহলে সে বিষয়টি (ফয়সালার জন্যে) আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, যদি তোমরা আল্লাহর ওপর এবং শেষ বিচার দিনের ওপর ঈমান এনে থাকো! (তাহলে) এ (পদ্ধতিই) হচ্ছে (বিরোধ মীমাংসার) সর্বোৎকৃষ্ট উপায় এবং পরিণামের দিক থেকেও (এটি) হচ্ছে উত্তম পন্থা’। আল্লাহর রাসূল (সা.) কে প্রতিটি বিরোধ মীমাংসায় একমাত্র বিচারক মেনে নিতে হবে সর্বান্তকরণে আর এটাই মানব জীবনের জন্যে ফরজ করা হয়েছে সার্বিকভাবে। সূরা আন্-নিসার ৬৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা উল্লেখ করেছেন এভাবেই, ‘(হে নবী,) তোমার মালিকের শপথ, এরা কিছুতেই ঈমানদার হতে পারবে না, যতোক্ষণ না তারা তাদের যাবতীয় মতবিরোধের ফয়সালায় তোমাকে (শর্তহীন) বিচারক মেনে নেবে, অতপর তুমি যা ফয়সালা করবে সে ব্যাপারে তাদের মনে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না এবং তোমার সিদ্ধান্ত তারা সর্বান্তকরণে মেনে নেবে’। মহান আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিকূলের রব, পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতি-পাখিকূল, জলসম্পদ, বনজসম্পদ, প্রাণীসম্পদ, আকাশমালা, জমিন, মোদ্দাকথা আসমান-জমিনের একচ্ছত্র মালিকানা যেমন তাঁর তেমনি আমার রাসূল (সা) পৃথিবীতে এসেছেন রাহমাতুল্লিল আ’লামিন হিসাবে। তিনি কোন খন্ডিত মানবগোষ্ঠীর জন্য আসেননি, আসেননি কোন নির্দিষ্ট জনপদের জন্য। কেয়ামত অবধি যত মানবজাতির উদ্ভব ঘটবে সবাই তাঁর উম্মত হিসাবে পরিগণিত হবে আর সেটাই আল্লাহতায়ালা দেড় হাজার বছর আগেই তাঁর কিতাবে উপস্থাপন করেছেন এভাবেই, ‘(হে মোহাম্মদ,) তুমি বলো, হে মানুষ, অবশ্যই আমি তোমাদের সবার কাছে আল্লাহতায়ালার রাসূল (সা.) (হিসেবে এসেছি), আকাশমালা ও পৃথিবীর যাবতীয় সার্বভৌমত্বের একচ্ছত্র মালিকানা তাঁর, তিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, তিনিই জীবন দান করেন, তিনিই মৃত্যু ঘটান, অতপর তোমরা আল্লাহতায়ালার ওপর ঈমান আনো, তাঁর বার্তাবাহক উম্মি রসূলের ওপর তোমরা ঈমান আনো, যে (রসূল নিজেও) আল্লাহতায়ালা ও তাঁর বাণীতে বিশ্বাস করে এবং তোমরা তাকে অনুসরণ করো, আশা করা যায় তোমরা সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে যাবে’। হযরত আবু হুরাইরাহ্ (রা) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন যে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন: আমার প্রত্যেক উম্মতই জান্নাতে যাবে, শুধুমাত্র ঐ ব্যক্তি ব্যতীত যে অস্বীকার করলো। সাহাবাগণ প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করবে, সে জান্নাতে যাবে। আর যে আমার বিরুদ্ধাচরণ/ নাফরমানী করবে, সেই অস্বীকার করলো’। হযরত আবু হুরাইরাহ্ (রা) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে দুটো জিনিস রেখে গেলাম। যতদিন পর্যন্ত এই দুটো জিনিস আঁকড়ে ধরবে, তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো, আল্লাহর কিতাব-অন্যটি হলো, আমার সুন্নাত।
লেখক : সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি)
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল