অনেক দূর এগোলেও জায়গা সংক্রান্ত জটিলতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ১শ শয্যার বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট স’াপন প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বাতিল করে চীন সরকার। তবে এক দফায় বাতিল করলেও ২য় দফায় আরো একটি প্রস্তাব দেয় দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত। বিশেষায়িত ইউনিটের পরিবর্তে চট্টগ্রামে এবার বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতাল স’াপনে আগ্রহের কথা জানিয়েছে দেশটি। আর সেটি হবে চীন সরকারের শতভাগ অনুদান সহায়তায়। চীনের প্রস্তাব অনুসারে চট্টগ্রামে বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতালটির নাম হবে ‘বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ বার্ন হাসপাতাল’।
চীনের রাষ্ট্রদূতের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতাল স’াপনের লক্ষ্যে জায়গা নির্ধারণ করতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেয় স্বাস’্য অধিদপ্তর। গত ২৪ সেপ্টেম্বর অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) ডা. আফরিনা মাহমুদের স্বাক্ষরে এ চিঠি দেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে প্রাথমিকভাবে দুটি জায়গা নির্বাচন করে জেলা প্রশাসন। এর একটি খুলশী এলাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল এবং অপরটি একই এলাকার পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়ের সম্মুখ অংশে (ডান পাশে) রেলওয়ের খালি জমি। তবে গতকাল আরো কয়েকটি খাস জমির তথ্য পেয়েছে জেলা প্রশাসন, যা চান্দগাঁও, বাকলিয়া ও উত্তর পতেঙ্গা এলাকায় বলে জানা গেছে।
এদিকে জেলা প্রশাসন নগরীর বিভিন্ন এলাকায় খাস জমি চিহ্নিত করে জায়গা নির্বাচনে কাজ করলেও বিশেষায়িত হাসপাতালটি স’াপনে চীনা প্রতিনিধি দলের প্রথম পছন্দ চমেক হাসপাতাল ক্যাম্পাস বা এর আশেপাশের এলাকা। এ তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. সামন্ত লাল সেন। সারা দেশে বার্ন চিকিৎসাসেবা সমপ্রসারণে সমন্বয়কের দায়িত্ব পাওয়া ডা. সামন্ত শুরু থেকেই চট্টগ্রামের এই প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করছেন। তবে চীনা প্রতিনিধি দলের প্রথম পছন্দ চমেক হাসপাতাল ক্যাম্পাসে হলেও সেখানে উপযুক্ত খালি জায়গা সংকটের কথা জানিয়েছেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর।
অপরদিকে বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতালটির জন্য প্রাথমিকভাবে পছন্দ করা জায়গা দেখতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে আসছেন স্বাস’্য সচিব আব্দুল মান্নান। ডা. সামন্ত লাল সেনও স্বাস’্য সচিবের সাথে থাকছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক। তিনি জানান, স্বাস’্য সচিব ও ডা. সামন্ত লাল সেন প্রথমে চমেক হাসপাতাল পরিদর্শন করবেন। বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতালের জন্য আগের জায়গাটিই দেখাবেন বলে প্রাথমিকভাবে ঠিক করেছেন তারা।
তবে যে জায়গাটির কথা বলা হ”েছ, তাতে নির্ধারিত পরিমাপের তুলনায় জমির পরিমাণ কম থাকায় প্রথম দফায় ১শ শয্যার বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট প্রকল্পটি আর গতি পায়নি। এখন পুনরায় ওই একই জায়গা দেখানো হলে চীনা প্রতিনিধি দল এ প্রকল্প থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন ডা. সামন্ত লাল সেন।
গতকাল তিনি আজাদীকে বলেন, চীনা প্রতিনিধি দলের সাথে কথা বলে যেটি বুঝা গেছে, তারা চমেক হাসপাতালের ক্যাম্পাস বা এর আশেপাশেই বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতালটি তৈরি করতে চায়। আর জায়গা পছন্দ না হলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। শতভাগ অনুদান সহায়তায় তারা এমন একটি বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতাল স’াপন করে দিতে চায়, যেখানে আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় সব সুবিধা থাকবে। সবকিছুই তারা করে দেবে। সেটি হলে আগুনে পোড়া রোগীদের নিয়ে আর ঢাকায় ছুটতে হবে না। এটি চট্টগ্রামবাসীর জন্য বিশাল একটি ব্যাপার। কিন’ জায়গা সংক্রান্ত জটিলতায় এমন সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে, তাও দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ। এটি কোনোভাবেই মানা যায় না।
এর আগে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ আলাদা অবকাঠামোয় চট্টগ্রামে বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করে চীন সরকার। আগ্রহ প্রকাশের পর চীনা প্রতিনিধি দল প্রথম দফায় ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চমেক হাসপাতাল এলাকায় সম্ভাব্য স’ান পরিদর্শন করে। ৯ সদস্যের ওই প্রতিনিধি দলকে নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন ডা. সামন্ত লাল সেন।
ওই সময় হাসপাতালের পেছনের অংশে খালি জায়গা ও গোয়াছি বাগান এলাকাসহ বেশ কয়েকটি স’ান দেখানো হয় দলটিকে। এর মধ্য থেকে হাসপাতালের পেছনের অংশে খালি জায়গায় বিশেষায়িত এ ইউনিট গড়ে তুলতে চীনা প্রতিনিধি দল আগ্রহ প্রকাশ করে। হাসপাতাল প্রশাসনও তাতে সায় দেয়। এর প্রেক্ষিতে চীনা দলটি দেশে গিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা অবহিত করে। চীন সরকারও তাতে সম্মতি জানায়।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর চিহ্নিত এ জায়গা ঘিরে বিশেষায়িত বার্ন ইউনিটের অবকাঠামো নির্মাণের ডিজাইনও শেষ করে চীনা দলটি। পরে ২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ২য় দফায় চমেক হাসপাতাল পরিদর্শনে আসলে নতুন তথ্য পায় তারা। হাসপাতাল প্রশাসন থেকে তাদের জানানো হয়, ওই জায়গাটি আগে থেকেই একটি আধুনিক রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং সেন্টার স’াপনের জন্য চিহ্নিত করা। সেটি নির্মাণ করা হবে জাপানি দাতা সংস’া জাইকার অর্থায়নে।
জাইকার প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের ডিপিপি চূড়ান্ত হয়েছে। একনেকেও সেটি অনুমোদন করা হয়েছে। তাই চিহ্নিত এ জায়গা পরিবর্তন করা কঠিন বিষয়। সেটা হলে পুনরায় নতুন করে ডিপিপি তৈরি এবং তা আবার একনেকে পাস করাতে হবে। আর সেটি সময় সাপেক্ষ। অন্যদিকে, চীনা প্রতিনিধি দলটির ভাষ্য, তারাও চিহ্নিত জায়গাটি ঘিরে ডিজাইন শেষ করেছে। নতুন কোনো জায়গা চিহ্নিত করলে তার জন্য পুনরায় সরকারের সম্মতি নিতে হবে। আর এ প্রক্রিয়ায় শুধু সম্মতি নিতেই পুনরায় ২ থেকে ৩ বছর সময় লেগে যেতে পারে।
এমন পরিসি’তিতে খালি জায়গাটিতে দুই পক্ষকে আলাদাভাবে অবকাঠামো নির্মাণের প্রস্তাব দেয় চমেক হাসপাতাল প্রশাসন। ওই সময় গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীরা জানান, ওই খালি অংশটিতে ২ হাজার ৫০৮ বর্গমিটার জায়গা রয়েছে। যেখানে জাইকার প্রকল্পটির অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৪৫২ বর্গমিটার জায়গা প্রয়োজন। এই অংশটুকু বাদ দিলে ১ হাজার ৫৬ বর্গমিটার জায়গা অবশিষ্ট থাকে। কিন’ বার্ন ইউনিটের অবকাঠামোর জন্য অন্তত দেড় হাজার বর্গমিটার জমির প্রয়োজন বলে জানিয়েছে চীনা প্রতিনিধি দল। ফলে ওই অংশে জায়গা সংকট দেখা দেয়। সব মিলিয়ে একই জায়গায় দুই প্রকল্প ঘিরে অনাকাঙ্ক্ষিত সংকট দেখা দেয়। প্রথমে স’ানীয়ভাবে, পরে স্বাস’্য অধিদফতর ও স্বাস’্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকেও এ সংকটের সুরাহা হয়নি। পরে জায়গা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে চীনের পক্ষ থেকে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর আজাদীকে বলেন, হাসপাতালের পেছনের অংশে রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং সেন্টার যেখানে হবে, সেখানে এক পাশে প্রায় ১১শ বর্গমিটার জায়গা রয়েছে। বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতালের জন্য আমরা সেটাই দেখানোর কথা চিন্তা করেছি। এটি ছাড়া স’াপনা নির্মাণের মতো উপযুক্ত জায়গা ক্যাম্পাসে আপাতত দেখছি না।
এ বিষয়ে ডা. সামন্ত লাল সেনের অভিমত, ক্যাম্পাসে না পেলেও অন্তত হাসপাতাল ক্যাম্পাসের আশেপাশে বিশেষায়িত হাসপাতালটির জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করা উচিত। এ কাজে চট্টগ্রামের মন্ত্রী-এমপিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের এগিয়ে আসা উচিত।