২১ বছর আগে সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ইউপি চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন খুনের ঘটনায় একই উপজেলার সদর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান সহ ১০ জনের ফাঁসির রায় দিয়েছেন আদালত। একই রায়ে আরও ৫ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। এছাড়া অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ৪ আসামিকে খালাস দিয়েছেন আদালত।
গতকাল রোববার দুপুরে বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ একেএম মোজাম্মেল হক চৌধুরী চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত সাতকানিয়া থানার চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলাটির রায় দিয়েছেন। আদালতের এজলাস কক্ষের বাইরে আসামি ও বাদীপক্ষের শত শত লোকজনের উপস্থিতি ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত এ মামলাটির রায় দেয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, সাতিকানিয়ার বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান নেজাম উদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা বশির আহাম্মদ প্রকাশ বশির, মানিক ওরফে ঠোঁট কাটা মানিক, জাহেদ, তারেক, ফোরখ আহাম্মদ ফোরখ, জিল্লুর রহমান, জসিম উদ্দিন জসিম, আবু মো. রাশেদ হোসেন ও নাছির উদ্দিন প্রকাশ রফিক। এছাড়া মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি আসামিদের প্রত্যেককে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড আরোপ করা হয়।
এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা বশির আহাম্মদ, তারেক ও জসিম পলাতক থাকলেও সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান নেজাম উদ্দিন নেজামসহ বাকী সাত আসামির সবাইকে পুলিশের প্রহরায় প্রিজন ভ্যানে করে আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়েছিল।
রায় শোনার পর প্রিজন ভ্যানে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় আসামিদের বিমর্ষ দেখা যায়।
একই মামলায় আদালত মোর্শেদুল আলম মোর্শেদ, আইয়ুব, হারুন অর রশিদ হারুন, ইদ্রিছ ও আরেক আসামি ইদ্রিছকে হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতার অপরাধে প্রত্যেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন। অর্থদণ্ড অনাদায়ে আসামিদের যাবজ্জীবন সাজার অতিরিক্ত এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন হারুন ও ইদ্রিছ। বাকী তিন আসামি ছিলেন পলাতক।
এছাড়া খুনের অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পাওয়া চার আসামি হলেন, আবু তাহের প্রকাশ তাহের, আব্দুল মালেক (পলাতক), খায়ের আহাম্মদ খায়ের (পলাতক) ও মো. মোস্তাক (পলাতক)।
আদালতের রায়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক দণ্ডাদেশ বহাল রাখা সাপেক্ষে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া সাতদিনের মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিলের সুযোগ রাখার পাশাপাশি দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের সাজা কাযর্কর করতে সাজা পরোয়ানা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছেন আদালত।
রায়ের পর এজলাস কক্ষ থেকে বের হয়ে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পিপি আয়ুব খান সাংবাদিকদের জানান, রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত করতে পারায় আদালত ১০ জনকে ফাঁসি ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ না পাওয়ায় ৪ আসামিকে খালাস দেয়া হয়েছে। এ মামলায় মোট ২১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছিল বলে জানান ট্রাইব্যুনালের পিপি।
১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর রাত ১২টায় সাতকানিয়া থানার মির্জাখীল বাংলা বাজার এলাকার একটি চায়ের দোকানে বসে কথা বলার সময় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় পরদিন নিহতের স্ত্রী সৈয়দা রওশন আক্তার বাদী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা বশির, নেজামসহ বিশজনের নামে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
শুরুতে মামলাটি পুলিশ তদন্ত করলেও পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্তভার সিআইডির হাতে পড়ে।
২০০০ সালের ২২ ডিসেম্বর বিশজনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। ২০০৪ সালের ২৫ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়।
হত্যাকাণ্ডের ১৯ বছর পর ২০১৯ সালে মার্চে ২১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। গত ১১ নভেম্বর মামলাটির অধিকতর যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের অপেক্ষায় থাকে। গত দুই ধার্য্য তারিখের পর অবশেষে গতকাল রোববার বহুল আলোচিত এ মামলাটির রায় দিয়েছেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। এর আগে চলতি বছর আলোচিত এ মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আসে।
অ্যাডভোকেট আয়ুব খান জানান, হত্যা মামলাটির এজাহারভুক্ত বিশ আসামির মধ্যে লুৎফর রহমান প্রকাশ লুতু নামে এক আসামি মারা যাওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
২১ বছর পর স্বামী হত্যায় বিচার পেয়ে আনন্দিত হওয়ার কথা জানিয়ে রওশন আক্তার বলেন, স্বামী হত্যার বিচারের জন্য একুশ বছর ধরে অপেক্ষা করে আসছি। এখন এ রায় শোনার পর আমি আনন্দিত। এর আগে রোববারের রায় ঘিরে আদালত এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। রায়ের আগে আসামি ও বাদীপক্ষের শতশত লোকজন আদালত ও এজলাস কক্ষের সামনে জড়ো হয়। এসময় হাতাহাতির ঘটনা ঘটলে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
বাদীপক্ষের আইনজীবীরা জানান, ১৯৯৯ সালে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় পুলিশের যৌথ অভিযানে ডাকাত গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করেন আমজাদ হোসেন। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ডাকাতদের জবানবন্দিতে তাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে নেজাম উদ্দিন ও বশির আহমদের নাম উঠে আসে। ডাকাতি নির্মূলে ভূমিকা নেওয়ায় এবং এলাকায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় লুৎফর রহমান লুতু ও নেজাম উদ্দিন, বশিরসহ অন্যান্যরা মিলে আমজাদ হোসেনকে খুন করে।