আগামী এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে পশ্চিম বঙ্গের বিধান সভা নির্বাচন। বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষা একই ভাষা ভাষী ও সংস্কৃতির ভারতীয় রাজ্য ওপার বাংলার নির্বাচন নিয়ে এদেশের রাজনীতি সচেতন মহলে সচরাচর কৌতূহল থাকলেও এবারের নির্বাচন ও তার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই নির্বাচনে চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে-মমতা ব্যানার্জীর পরোক্ষ সহযোগিতা ও অপশাসনের কারণে। দুই বাংলার বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য এ এক অশনি সংকেত- সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও হিংসার নবতর কালো অধ্যায়ের অশুভ সূচনার এক দুর্যোগময় মুহূর্ত। পাকিস্তান আমলেও ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে এদেশে ধর্মান্ধ শক্তি ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তৃতি লাভ করে সাম্পদ্রায়িক বিভেদের এক সমাজ মানস তৈরি করে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জীবন অস্থির অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। কিন্তু ’৫০ এর দশক থেকে পশ্চিম বাংলায় শক্তিশালী ও দৃঢ় অসাম্প্রদায়িক বাম রাজনীতির প্রভাব, জাতীয় কংগ্রেস ও বামদের পর পর দুই দফে প্রায় ৬৫ বছর শাসনের কারণে সেখানে সংখ্যালঘুদের বৈষয়িক নানা সমস্যা থাকলেও প্রশাসনিক বৈষম্য ও ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে ১৯৫১ সনের নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির পর সংখ্যালঘুদের দেশ ত্যাগের মতো উল্লেখযোগ্য কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নি। কিন্তু ধর্মীয় বৈষম্য ও নিপীড়নের নানা ঘটনায় বিগত ৭০ বছর ধরে বারে বারে বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ অব্যাহত রয়েছে নীরবে-নিভৃতে। ১৯৪৭ সালে এ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ২৫ শতাংশাধিক থেকে বর্তমানে ১০ শতাংশে ঠেকেছে অন্যদিকে একই সময়ে পশ্চিম বাংলার ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ২০ শতাংশ থেকে এখন প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে। এই হলো সব বিতর্কের উর্ধ্বে এক বাস্তব তুলনামূলক চিত্র। এর একমাত্র কারণ ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর রাজনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী সংখ্যালঘু ও প্রগতিশীলদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “শির কুচল দেঙ্গেঁ”, অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ১৯৪৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে এক চিঠিতে লিখেছেন – ডযধঃবাবৎ যধঢ়ঢ়বহং রহ চধশরংঃধহ, ড়ঁৎ ঃধংশ রহ ওহফরধ রং পষবধৎ, বি সঁংঃ ঢ়ঁৎংঁব রিঃয বাবহ মৎবধঃবৎ ফবঃবৎসরহধঃরড়হ ঃযধহ রহ ঃযব ঢ়ধংঃ ড়ঁৎ বভভড়ৎঃং ধঃ ভড়ৎসরহম ধ ংবপঁষধৎ ংঃধঃব রহ যিরপয সবহ ড়ভ ধষষ পড়সসঁহরঃরবং পধহ ধিষশ রিঃয ঃযবরৎ যবধফং যরময. এই ছিল অসাম্পদ্রায়িক, ধর্ম বিশ্বাসে সংশয়বাদী রাষ্ট্রনেতা নেহেরুর দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু মোদির মতো চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক ভন্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার ফলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। নেহেরুর হাতে গড়া বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা যেহেতু এখনো সেদেশে ক্ষমতা পরিবর্তনে একমাত্র উপায় সেহেতু সংখ্যালঘুদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও সংহত অবস্থান পশ্চিম বাংলায় তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়িয়েছে। দীর্ঘদিন বাংলায় কোন সাম্প্রদায়িক দলের অস্তিত্ব না থাকাতে কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট পার্টি এই দুই প্রধান দলের মধ্যে যেকোন একটিকে তারা স্বচ্ছন্দে বেছে নিতে পেরেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে দুই প্রধান দলের মধ্যে বিএনপি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে পুঁজি করে, ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক নীতি বাতিল করে, স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে নিয়ে অরাজনৈতিক উৎস থেকে রাজনীতিতে আবির্ভূত হয় ফলে ওপার বাংলার মতো শক্তিশালী বাম বিকল্পের অনুপস্থিতিতে সংখ্যালঘুসহ প্রগতিমনা মানুষ শুধু একটি দলকে সমর্থন করার অস্বস্তিকর সংকটে পড়ে যায়। দুই বাংলার রাজনীতি ও সমাজচিত্রের এই বিশিষ্ট পার্থক্যটি খুব কম লোকই অনুধাবন করেন।
২০০০ সালের পর থেকে পশ্চিম বাংলার সেই উদার ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমে অধোগতি হতে থাকে। কট্টর বাম বিরোধী, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী মমতা ব্যানার্জী বামদের প্রতি কংগ্রেসের কথিত নমনীয়তার অভিযোগ তুলে উগ্র কমিউনিস্ট বিরোধী শ্লোগান দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাচ্যুত হতাশ কংগ্রেস কর্মীদের বিরাট এক অংশ নিয়ে পাল্টা তৃণমুল কংগ্রেস গঠন করে পশ্চিম বাংলায় কংগ্রেসকে বিভক্ত করে ফেলে। ক্ষমতাসীন বামের বিকল্প হিসেবে কংগ্রেসের এই ভাঙ্গন চূড়ান্ত বিচারে পশ্চিম বাংলার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য ক্ষতিই করেছে বলা যায়। কংগ্রেস ক্রমে দুর্বল হতে থাকে আর মমতা একা বামেদের সাথে পেরে উঠতে না পেরে সমস্ত নীতি আদর্শ বিসর্জন দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিজেপির ছাতার নীচে আশ্রয় নেন। তিনি দুবার বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন। বিজেপি শূন্য পশ্চিম বাংলায় বিজেপিকে নিয়ে এসে নিজেদের আসন ছেড়ে এক বিজেপি নেতাকে লোক সভায় জিতিয়ে আনেন ২০০৪ সালে। এভাবে পশ্চিম বাংলায় মমতার পৌরহিত্যে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অভিষেক হয়।
বামেরা ৩৪ বছরের শাসনে কৃষি, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে গ্রামীণ পশ্চিম বাংলার চেহারা পাল্টে দেয়। দৃঢ় অসাম্প্রদায়িক ভূমিকার কারণে ধর্মীয় সংখ্যলঘুদের প্রায় একচেটিয়া সমর্থনে গ্রাম বাংলায় গড়ে উঠে গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক ও মধ্যবিত্ত হিন্দু-মুসলিম কর্মী-সমর্থকদের দুর্ভেদ্য বলয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে সিপিএম এর মধ্যে সুবিধাবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটে। অন্যদিকে নেতৃত্বের আত্মসন্তুষ্টি, গণবিচ্ছন্নতা, কেন্দ্র এবং কর্পোরেট ক্যাপিটেলের ষড়যন্ত্র, সাড়ে তিন দশকের একচেটিয়া শাসন থেকে তরুণ সমাজের মধ্যে পরিবর্তনের প্রত্যাশা, সিঙ্গুঁর-নন্দীগ্রামে বিশাল শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার সঠিক উদ্যোগ মমতার অপকৌশল যথা সময়ে মোকাবেলা করতে না পেরে ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি কারণে ২০১১ সালে প্রণব-মমতা জুটির কাছে বামেরা পরাজিত হয়। তবে বামেদের সব চাইতে বড় যে ব্যর্থতা আমার কাছে মনে হয় তা হলো তারা দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থেকে সাধারণ মানুষ দূরে থাক, পার্টির নেতা কর্মীদের কমিউনিস্ট কালচারে বা উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিকশিত করতে পারে নি বা সীমিত পরিসরে হলেও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করতে পারে নি- আধ্যাত্মিক ভাবালুতা থেকে দল এবং মধ্যবিত্ত বাঙালিকে মুক্ত করার কঠিন কাজকে গুরুত্ব দেয়নি, যা সম্ভব ছিল। এতে উর্বর হতে থাকে বিজেপির রাজনৈতিক আদর্শ–বিশ্বাস আর অন্ধত্বের পোড়ো জমি। ইতোমধ্যে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ঘটনাবলিসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির অভিঘাতে মুসলিমদের মধ্যে বাম বিরোধী ইসলামী মৌলবাদ জায়গা করে নিতে থাকে। ২০০৭ সালে তসলিমা নাছরিনকে কেন্দ্র করে কলকাতায় সিদ্দিকুল্লাহর নেতৃত্বে দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি তার উদাহরণ। মমতা এই শক্তিকে কাজে লাগায়। পরবর্তীতে ক্ষমতায় গিয়ে এককভাবে সংখ্যালঘু ভোট পাওয়ার নির্বাচনী কৌশল হিসেবে মুসলিম মৌলবাদকে খুশি করতে দৃষ্টিকটুভাবে তোষণনীতির সূচনা করে। পশ্চিম বাংলার উদার সেকুলার মুসলিম লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দিয়ে মমতার এসব কাজের নিন্দা করেন যা শেষ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে তাঁরা সতর্ক করে দেন। এদিকে এর প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুদের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভ ভালভাবেই হিন্দুত্ববাদী বিজেপি লুফে নেয় এবং বিজেপি অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মাঝে অবস্থান তৈরি করে নেয়, যা ৫ বছর আগেও চিন্তা করা যায় নি। মমতার মুসলিম মৌলবাদ তোষণ আর বিজেপির হিন্দুত্ববাদ মিলে বামেদের পরিশ্রমে দীর্ঘদিন ধরে তিল তিল করে গড়ে উঠা পশ্চিম বাংলার উদার অসামপ্রদায়িক সহিষ্ণু সমাজ আজ বিভেদের নীল বিষে জর্জরিত হয়ে গেছে- ধর্মীয় বিভাজন আর মেরু করণের ফলে বিজেপি আজ পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করছে। পশ্চিম বাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় গেলে নাগরিকপঞ্জী, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি করে সংখ্যালঘু জনমানসে ভীতি ও সংঘাতের আবহ সৃষ্টি করবে। তার জেরে পার্শ্ববর্তী আমাদের দেশে ইতোমধ্যে ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টিকারী মৌলবাদীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইবে, ফলে সীমান্তের দুই দিকেই অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। অনিশ্চিত সংকটে পড়বে দুই বাংলার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও প্রগতিশীল শক্তি। এজন্য এখন থেকে এদেশের বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে দুই দেশের অসভ্য, বর্বর, ধর্মান্ধ অন্ধকারের অভিন্ন শক্তিকে মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আশার কথা হলো সম্প্রতি পশ্চিম বাংলায় বামেরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে সাংগঠনিকভাবে। মমতার দমনপীড়ন করার ক্ষমতা আগের মতো নেই। সাম্প্রদায়িকভাবে বিভাজিত এই পরিস্থিতিতে এবারেই হয়তো বামেরা ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তৃণমূল বা বিজেপি যেই ক্ষমতায় যাক বামেরা লক্ষ জনতার সমর্থনে কলকাতা ঘেরাও করে ক্ষমতাসীনদের অপকৌশল ও বিভেদের রাজনীতি রুখে দাঁড়াতে পারবে। নিজেদের অপরাজেয় ভাবা মোদি-অমিত গং লক্ষ লক্ষ কৃষকের দিল্লী ঘেরাও অভিযান থেকে আজ বুঝতে পারছে ভারত বর্ষে যা ইচ্ছা তা করা যাবে না। অমানুষদের কাছে মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভব কখনো শেষ কথা হতে পারেনা-এই বিশ্বাসে আমরা পথ চলি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, অধ্যাপক।