দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

না এ হয় না, হওয়া উচিৎ নয়। মানে মানবজাতির আদিতম মানবদের একজন পিকিং মানবের দেশে পা রেখে, তার জন্মের সাড়ে সাত লক্ষ বছর পরের প্রজন্মের কেউ, এখানকার ঠাণ্ডায় একটুতেই দমে যাবে, তা তো হওয়া মোটেই উচিৎ নয় । আর তা হলে তো পিকিং মানবের ইজ্জতই থাকে না! নগ্ন পিকিংমানব তো এই চরম প্রকৃতিতেই খাপ খাইয়েছিল প্রাকৃতিক উপায়েই । সেখানে পুত্ররা আমার তো যাচ্ছে বেশ ভাল রকমের গরম কাপড় পরেই, যেগুলো ঢাকার তীব্রতম শীতে পড়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলে নির্ঘাত ঘামতে হবে যে কারোরই ।
“দাদা, দাদা ওরা কোথায় যাচ্ছে ?” দীপ্র অভ্র দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঐটি খুলে যাওয়ার পর দু ভাই বাইরের দিকে পা বাড়াতেই হাহাকার করে উঠলো হেলেন
“কি ব্যাপার, কি চিন্তা করছ তুমি? তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ না, নাকি ?” লাজুর কণ্ঠে ঝরে পড়লো তীব্র বিরক্তি একই সাথে আমাকে বলেই গেছে ওরা। আমাদের বাসটা এলো কি না ওটা দেখতে গেছে। চিন্তার কিছু নাই আমিও যাচ্ছি ওদের পিছু পিছু , ঠাণ্ডা গলায় এ কথা বলেই রওয়ানা দিলাম আমিও -নাহ যত উৎসাহ নিয়ে দু ভাই বেরিয়েছিল তা ততই দ্রুতই যে মিইয়ে গেছে দু ভাইয়ের , গেটের বাইরে পা রেখেই বুঝতে পারলাম দু জনকে তড়িঘড়ি বা দিক থেকে ফিরে আসতে দেখে । তবে এ ফাঁকে নিজেও চোখ বুলিয়ে নিলাম চকিতে বা দিকটায় নানা নম্বরের নানান বাস দাঁড়ানোর নির্দিষ্ট স্থানগুলোর উপরে; যদিও অন্য কোন বাস এল কি না এল তাতে কিছুই যায় আসে না আমার, তারপরও দেখলাম । হ্যাঁ আরো একটা বাস দেখলাম এসে দাঁড়িয়েছে ওদিকটায় এর মধ্যে, শুধু আমাদের বাসের নির্দিষ্ট জায়গাটাতেই এখনো আছে খা খা শূন্যতা। অতএব ওরা কাছে আসতেই দুজনকেই বগলদাবা করে ফের ঢুকে গেলাম লাউঞ্জের উষ্ণতায় ।
আমাদের ত্রিমূর্তির লাউঞ্জে তড়িঘড়ি প্রত্যাবর্তন দেখেই লাজু বলে উঠল -“কি বোঝা গেল কি বাইরের মজা?’
শোন আগামী ক’দিন কিন্তু এরকম শীতেই আমাদের ঘুরে বেড়াতে হবে বেইজিংএ, তার একটু প্র্যাকটিস হল আর কি? লাজুর কথার উত্তরে এ বলে দুই পুত্রকে নিয়ে আমাদের নির্ধারিত আসনে বসে চায়নিজ কমলা বা ম্যান্ডারিন খেতে এবং খাওয়াতে মনোযোগ দিতে দিতে ভাবলাম, কপাল ভাল শীত বলে আমার নিজেরই যেমন তৃষ্ণা পায়নি এখনো , তেমনি অন্য কেউ বলছে না পানি খাওয়ার কথা। তাতেই রক্ষা!
অতপর সুমিষ্ট চায়নিজ কমলা খাওয়া শেষে, সে রসে বাপবেটা তিনজনের গলা ভিজে উঠতেই, পুত্রদ্বয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল যার যার প্যাড পড নামের হাতানো যন্ত্রে খেলা নিয়ে। সুতরাং ভাবলাম দেখি একটু আমার ভ্রমণ ফাইলটির বেইজিং অংশ ঘেঁটে। সাড়ে চারটায় রওয়ানা দিয়ে কটায় পৌঁছুতে পারব হোটেলে তা যদিও জানি না; তারপরও ভাবছি হোটেলের আশেপাশে যদি দর্শনিয় কোন কিছু থাকে তবে এই শীতে সবাইকে নিয়ে না হলেও অন্তত নিজেই একটা চক্কর দিয়ে রেকি করে রাখতে পারব আজ রাতেই । তাতে সুবিধা হবে পরের দিন সবাইকে নিয়ে ধীরে সুস্থে ঘোরার ব্যাপারে।
নানান ব্যস্ততায় ঢাকা থেকে রওয়ানা করার আগে, কানমিং ইন্টারকন্টিনেন্টাল রিসোর্টের এতটা কাছেই যে দিয়াঞ্চি লেক, তা ভাল করে পড়ে দেখিনি বলে, প্রথম রাতে কোথাও বের হবার চিন্তাই করিনি । হোটেল সম্পর্কে যতটা পড়েছিলাম অনলাইনে বুকিং করার সময়, তা তো পড়েছিলাম কমপক্ষে দেড় দুই মাস আগে। আর সেই পড়া থেকে মনের ভেতর যে দুটো কথা গেঁথে গিয়েছিল, তার একটা ছিল হোটেলের দশের মধ্যে ৯ পাওয়া রেটিং। আর দ্বিতীয় যা মনে বসেছিল গ্যাঁট হয়ে ঐ হোটেল সম্পর্কে, তা হল কোন এক রিভিউয়ারের লেখা একটি বাক্য, ‘ইন দ্য মিডল অব নো হয়ার’।
হ্যাঁ ঐ বাক্যটি মনে এমনই অনুরণন তুলেছিল যে, সেই থেকে যখনই কানমিং ইন্টারকন্টিনেন্টাল রিসোর্টের কথা মনে করেছি বা করছি, বারবারই সেই বাক্যটি মনের গলা মনের কানে বলছে এখনও । একই রকমভাবে বেইজিং এর হোটেল বুকিং করতে গিয়েও যখন নানান হোটেলের ব্যাপারে নানান রিভিউয়ারের মন্তব্য পড়ছিলাম তাতে রিজেন্ট বেইজিং নিয়ে একজন রিভিউয়ারে যে বাক্যটি মনে গেঁথে গিয়েছিল , এইমাত্র ফাইলটি হাতে নিতেই সেই বাক্যটি বেজে উঠলো মনে আর তা হল “গ্রাউন্ড জিরো অফ বেইজিং”!
আরো মনে পড়ল এই যে, প্রায় প্রত্যেক রিভিউয়ারই এই হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্ক আর কন্সিয়াজ নিয়ে মুক্ত কণ্ঠে তাদের প্রশংসা করেছিল,তাদের অত্যন্ত সহযোগিতামূলক আচরণের জন্য, আর কোন রকম ধস্তাধস্তি করা ব্যতিরেকে সহজে ইংরেজিতে বাৎচিত করার পারঙ্গমতার জন্য । যার কারণে আরো ক’টা ৯ রেটিং পাওয়া হোটেলের মধ্যে এটিকেই আমি বেছে নিয়েছিলাম পিকিং মানবের দেশে আমাদের স্বল্পকালীন আস্তানা হিসাবে। দেখি না এখন সেই হোটেলের ধারে কাছে কি আছে ?
ফাইলের পাতা উল্টে বেইজিং অংশে আসতেই, প্রথমেই চোখে পড়ল রিজেন্ট হোটেলের বুকিং কনফার্মেশনের কাগজটা। নাহ বিশেষ কিছু লেখা নেই তাতে। যা কিছু লেখা আছে এ পাতায়, তার সবই হল আমাদের রিজার্ভেশন বিষয়ক তথ্য। মানে ক’রাতের বুকিং করা হয়েছে। কয়টা রুমের বুকিং করেছি। মোট কত টাকা দিতে হবে এইসব তথ্য আর কি! আরো আছে অবশ্যই তার ঠিকানা সাকিন। তবে কাগজটার নীচের দিকে চোখে পড়ল একটা ছোট্ট ম্যাপও; যাতে ইংরেজিতে লেখা আছে কয়েকটা রাস্তার নাম !
এমনিতেই আমি হলাম দিককানার মতো ম্যাপকানাও । যে কোন ম্যাপ হাতে নিলেই প্রথমেই পড়ি উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম বিষয়ক বিভ্রমে। আর সে বিভ্রমে পড়লেই প্রথমে মনে করার চেষ্টা করি ছোট বেলায় শেখা ম্যাপ দেখার নিয়মটা । আর তা মনে করতে গিয়েও পড়ি ঝামেলায়, উত্তর আর দক্ষিণের কোনটা ম্যাপের উপরের দিকে, আর কোনটা নীচের দিকে তা নিয়ে। পড়লাম এখনো সেই যন্ত্রণায়। অতএব আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম দ্রুতই এ নিয়ে। যার মানে হল হোটেলের আশেপাশে হাঁটা দূরত্বে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে কি না, সেটি রেকি করবার যে পরিকল্পনা করবো ভেবেছিলাম এ মুহূর্তে সেই প্রাক পরিকল্পনা করার পরিকল্পনাটি বাদই দিতে হল। কিন্তু ভাবনা ছাড়া কি থাকা যায়? তাই ভাবলাম, আগে গিয়ে পৌঁছাই না হোটেলে। তারপর না হয় অন্ধের মতোই একটা চক্কর দিয়ে নেব প্রথমে, তারপর রুমে ফিরে হোটেলের ওয়াই ফাইয়ের সহায়তায় শরণ নেব গুগুল মামার !
গুগুলের সহায়তা নেব বেইজিংএ! এই চিন্তা মনে আসার সাথে সাথেই কালবিলম্ব না করে যে কথাটি মনে হল, তা হল গুগুল ম্যাপ বা গুগুলের কি আদৌ প্রবেশাধিকার আছে বেইজিং এ? বা গোটা চায়নার কোথাও? চায়নায় এসে এ পর্যন্ত তো ঠিকমতো উঠতেই তো পারিনি আজকের ডিজিটাল দুনিয়ার ইন্টারনেট কেন্দ্রিক সুপার হাইওয়েতে। ফেসবুক, টুইটার তারা বন্ধ করে রেখেছে বাকস্বাধীনতার নামে চায়নিজরা যাতে, যা তা বলা তো দূরের কথা সরকারেরও সামান্যতম যৌক্তিক সমালোচনাও না করতে পারে তা যেমন সহজে বোধগম্য; সে বোধ থেকে বুঝি যে তারচেয়ে অনেক বেশি যৌক্তিক কারন আছে এখানকার সরকারের গুগুল ম্যাপ বন্ধ রাখার ব্যাপারে। কারণ গুগুল ম্যাপের কারণে তো অতি সহজেই চায়নার শত্রুরা চায়নায় না এসেও, সহজেই নির্ণয় করে ফেলতে পারবে এদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সমূহের অবস্থান । আর তা তো চায়নার সামরিক স্ট্রাটেজিস্ট হতেই দিতে পারে না। অতএব বুঝতে পারলাম, নাহ গুগুল মামার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে চায়নায় কোন ধরনের সহায়তা পাওয়ার আশার সকলই গরল ভেল!
আবার মনে হল, গুগুল বন্ধ রাখলেই কি আর না রাখলেই কি আর আজ? বেশ অনেক কাল আগে থেকেই তো এ গ্রহের তাবৎ পরাশক্তিরা নানান মাপের আর শক্তির কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যের নানা স্থানে ফিট করে রেখেছে। ফলে কোন দেশেরই গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলি আর অগুরুত্বপূর্ণ স্থান বলি, তার কোনটাই তো তাদের অজানা নয়। তবে এও ঠিক শুধু এ কারণেই চায়নিজ সরকার নিশ্চয় গুগুলকে এরকম অবারিত প্রবেশধিকার দেবে না এখনো তাদের নামের সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যে । এছাড়া শ্‌ত্রুর উপগ্রহ যাতে চায়নার ঐরকম স্ট্রাটেজিক কোন গোমর ফাঁক না করতে পারে, সেজন্য নিশ্চয় তারা উপগ্রহ নামের ঐসব আসমানি গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দেবার ব্যবস্থাও করে রেখেছে তাদের তীক্ষ্ণ চায়নিজ বুদ্ধিতে।
নাহ, আপাতত তোলা থাক আমার মতো আদার ব্যাপারি অতসব বড় বড় জাহাজ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার বৃথা চেষ্টা। বরং একটু দেখি বেইজিং এর শীর্ষ দশ দর্শনীয় স্থান কি আছে ঐ সবের লিস্টি আর বিবরণ। আজ সহ চাররাত পাঁচদিন পিকিং মানবের দেশে থাকার পরিকল্পনা থাকলেও, এই ভ্রমণটির পরিকল্পনা করার সময়ই পুরো একদিন বরাদ্দ রেখেছিলাম শপিং এর জন্য। যার মানে হল, আগামীকাল আর পরশু এই দুইদিনেই আমাদের দেখতে হবে শীর্ষদশ দর্শনীয় স্থানের যে ক টা পারা যায়।
অতএব ফাইলে গাঁথা হোটেল বুকিং এর রশিদ জাতীয় পাতাটি উল্টে পরবর্তী পাতাতেই যেতেই শীর্ষদশের প্রথমটির নাম দেখেই, বেশ পুলকিত হয়ে উঠলাম বহুকাল আগে দেখা অকল্পনীয় একটি স্বপ্নের কাছাকাছি চলে এসেছি এমন ভাবনায়।
হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন সে নাম হলো গ্রেট ওয়ালের। বেইজিং এর শীর্ষ দশ দর্শনীয় স্থান নিয়ে নানা মুনির নানা মতের মতো, ইন্টারনেটের নানান সাইটের এডমিনদের নানান মত থাকলেও, গ্রেট ওয়ালকে শীর্ষদশ তালিকার শীর্ষে শিরস্ত্রান হিসাবে স্থান দেয়ার ব্যাপারে তারা সবাই একাট্টা। বাকি স্থানগুলোর শীর্ষদশ তালিকার স্থান নিয়ে অবশ্যই তাদের মতভিন্নতা আছে। আর তা তো হতেই পারে। কারণ কথায় তো আছেই, যার নয়নে যারে লাগে ভাল। হ্যাঁ নরনারীর প্রেমের ব্যাপারে যেমন এ কথা সত্য, তেমনি ভ্রমণকারীর চোখেও একথা সত্য যে, যার প্রাণে যে জায়গা টানে।
ফলে শুধু বেইজিং না। যে কোন শহরেরই, শীর্ষদশ নিয়ে গুগুল মামার শরণ নিলে দেখা যাবে লিস্টি আসে বেশ কটা। যার মধ্যে এক শীর্ষদশ লিস্টিতে যে স্থান আছে হয়তো পাঁচনম্বর স্থানে আরকেটিতে গেলে দেখা যাবে সেটি চলে গেছে ৯ নম্বরে, আরেকটিতে হয়তো ঐটা এক্কেবারে বাদই হয়ে গেছে শীর্ষদশ থেকে। ছোট বেলায়ও দেখেছি একই ঘটনা নানান সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে, এই গ্রহের মানবসৃষ্ট সপ্তাচর্য নিয়ে, যা নিয়ে তখন বেশ বিরক্ত হতাম ধন্দে পড়ে। কারণ তখন তো জানতাম না যার প্রাণে যে জায়গা টানের মর্ম।
এছাড়া ছোট বেলায় কি কারণে যেন বিশ্বাস জন্মেছিল সত্য নিত্য ও সর্বজনীন। আর শুধু ছোটবেলার কথাই বলছি কেন? বড় হয়ে চারপাশে তাকিয়ে তো অনেক আগেই বুঝে গেছি যে আমাদের সমাজের বেশীর ভাগ ডিগ্রিধারী প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষই তো জানে না, বোঝে না, সত্যের অনিত্যতা ও আপেক্ষিকতার ব্যাপারটা। অল্পকিছু মানুষই আছে যারা এটা জানে, বোঝে; কিন্তু মানে না। জেনে বুঝে মানে না যারা, তাদের অনেকেই তা করেন নিজেদের বিশ্বাসের ঘোরটোপের নিরাপদ স্থান থেকে উন্মুক্ত অসীম অজানায় ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে বেহাল অবস্থায় না ফেলার ভয়ে। বাকীরা তা করে বৃহত্তর আমজনতাকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। এরাই হল যে কোন সমাজের জ্ঞানপাপী। এই শঠেরাই কালে কালে শতকে শতকে দশকে দশকে নানান সমাজে তাদের নানান শঠতা দিয়ে করেছে সমাজের বিষম রকমের ক্ষতি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআসুন আমরা দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই
পরবর্তী নিবন্ধপশ্চিম বাংলার আসন্ন নির্বাচন: বিপদোন্মুখ দুই বাংলা