সংশোধিত সামুদ্রিক মৎস্য আইন-২০২০ এর সাংঘর্ষিক বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল করে আইনটি পুনরায় সংশোধনের দাবিতে সাগরে মাছ শিকার বন্ধ করে একযোগে ধর্মঘট শুরু করেছে বাণিজ্যিক ফিশিং ট্রলার মালিক, স্কিপার, মেরিন অফিসার ও নাবিকরা। তারা রোববার সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরে বিক্ষোভ, প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে আইনটি পুনরায় সংশোধের দাবি জানান। এর আগে গত শনিবার দিবাগত রাতে মাছ শিকার বন্ধ করে একযোগে উপকূলে ফিরে ধর্মঘট শুরু করে বাণিজ্যিক ফিশিং ভ্যাসেলগুলো। আইনটি প্রণয়নের আগে মেরিন ফিশিং জাহাজ মালিক সমিতি, মেরিন ফিশিং জাহাজ অফিসার সংগঠন, মেরিন ফিশিং জাহাজ নাবিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা, মতবিনিময় কিংবা মতামত না নেয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, ২৬ নভেম্বর গেজেট নোটিফিকেশন আকারে প্রকাশ হওয়া “মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩ রহিতক্রমে উহার বিধানাবলি বিবেচনাক্রমে সময়ের চাহিদার প্রতিফলনে নূতন আইন প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন” এর বেশ কয়েকটি ধারা সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবসা ও মৎস্য শিকার কার্যক্রমের সাথে সাংঘর্ষিক দাবি করেন এ খাতের মালিক, মেরিন অফিসার, নাবিকসহ সংশ্লিষ্টরা।
আইনটি সংশোধনের দাবি করে রোববার আয়োজিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে দুপুর ১২টায় আগ্রাবাদ সরকারি কার্য ভবন-১ এর সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে বাণিজ্যিক ফিশিং ট্রলার মালিকদের সংগঠন মেরিন হোয়াইট ফিস ট্রলার ওনার্স এসোসিয়েশন। এরপর ফিশিং ট্রলার মালিক নেতৃবৃন্দ অধিদপ্তরের পরিচালক (সামুদ্রিক) আ ক ম শফিকজ্জামানের সাথে মতবিনিময় করেন। এসময় নেতৃবৃন্দ সংশোধিত আইনের বিলের মধ্যে বেশ কিছু সাংঘর্ষিক ধারা বিলুপ্ত করে পুনরায় ফিশিং ট্রলার মালিকদের মতামত সংযোজন করে আইনটি সংশোধনের দাবি জানান। প্রতিবাদ সমাবেশ ও মতবিনিময়কালে বক্তব্য রাখেন মেরিন হোয়াইট ফিস ট্রলার ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. জানে আলম, সাধারণ সম্পাদক মো. তাজ উদ্দিন তাজু। উপস্থিত ছিলেন ছৈয়দ আহম্মদ, দিদার সওদাগর, মো. নুর নবী, মো. জসিম, সাইফুল ইসলাম বুলবুল, মো. মাসুদ আকতার মান্নান, আনোয়ার সাদাত মোবারক , মো. আলাউদ্দিন, মো. কামাল, মাজহার সাহেদ, মনোয়ার হোসেন প্রমুখ। এর আগে গত ২৯ নভেম্বর সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত আইনটির সাংঘর্ষিক ধারা বাতিল করে পুনরায় সংশোধনের দাবি জানিয়ে পরিচালক (সামুদ্রিক) ও নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসারকে পৃথক চিঠি দেয়া হয়।
এব্যাপারে সংগঠনের সাধারন সম্পাদক তাজ উদ্দিন তাজু দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘নতুন সামুদ্রিক মৎস্য আইনটির বেশ কয়েকটি ধারা মেরিন ফিশিং ভ্যাসেল মালিক, কর্মকর্তা, শ্রমিক সকলের জন্য সাংঘর্ষিক। নতুন আইনটি বাস্তবায়ন হলে ফিশিং ভ্যাসেল মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই ক্ষতির শিকার হবেন। যখন তখন জেল জরিমানার মুখোমুখি হবেন। আবার মালিকানা নিয়েও সমস্যার মুখোমুখি হবেন। আইনটি করার আগে আমাদের সাথে কোন প্রকার পরামর্শও করা হয়নি। কারো মতামতও নেয়নি মন্ত্রণালয়। এছাড়া সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের পরামর্শকেও আমলে নেয়নি মন্ত্রণালয়। তাই নতুন আইনটির কয়েকটি ধারা বাতিল করে পুনরায় আইন সংশোধন করার দাবি জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে সাগর থেকে সব ধরনের বাণিজ্যিক ট্রলার (জাহাজ) মাছ শিকার বন্ধ করে ফিরে এসেছে। এখন কার্যত ধর্মঘট চলছে। আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া না হলে মালিক, মেরিন অফিসার, শ্রমিকদের নিয়ে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।’
একই সময়ে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ‘সামুদ্রিক মৎস্য আইন প্রতিরোধ কমিটি’। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ‘সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০২০’ সংশোধন না করে যদি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয় তহালে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে মেরিন ফিশিং ভ্যাসেল স্কিপার, মেরিন অফিসার ও নাবিকদের সমন্বয়ে গঠিত ‘সামুদ্রিক মৎস্য আইন প্রতিরোধ কমিটি’। কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ও এক্স ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সামছুল ইসলাম রাশেদী এ ঘোষণা দেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ক্যাপ্টেন দোলন কুমার বড়ুয়া, বেইজ ক্যাপ্টেন মো. আলমগীর কামাল, মোরশেদ রশিদ আহমেদ, ইমরান হোসেন প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলন চলাকালে এক্স ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকশ’ সদস্য মানববন্ধনও করেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ১৬ নভেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয়। ২৬ নভেম্বর ২০২০ সালের ১৯ নম্বর আইন হিসেবে গেজেট নোটিফিকেশন হয়েছে। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এ আইন অফিশিয়াল নোটিশের মাধ্যমে এখনো জারি করা হয়নি।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, আইনটি প্রণয়নের আগে মেরিন ফিশিং জাহাজ মালিক সমিতি, মেরিন ফিশিং জাহাজ অফিসার সংগঠন, মেরিন ফিশিং জাহাজ নাবিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা, মতবিনিময় কিংবা মতামত নেয়া হয়নি। এ আইনে ফিশিং ভ্যাসেল নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের দায়িত্ব মহাপরিচালক পালন করবেন বলা হয়েছে। কিন্তু এ কর্মকর্তাদের নিয়োগ যোগ্যতা কী হবে এবং ফিশিং ভ্যাসেল মেরিটাইম যোগ্যতা থাকবে কিনা তা উল্লেখ নেই। তাই আইন বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
আইনে ৮ম-১২তম অধ্যায়ের ৩২-৫৮ নম্বর ধারাগুলোতে অনভিপ্রেত, অগ্রহণযোগ্য ও আপত্তিকর কিছু বিষয় তথা ফিশিং ভ্যাসেল মালিক, অপারেটর, স্কীপার, সংশ্লিষ্ট যেকোনো ব্যক্তিকে ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ বা ‘ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ দিয়ে যখন তখন হয়রানি, নাজেহাল, বিনা ওয়ারেন্টে দণ্ড ও জরিমানা করার মতো ক্ষমতা দেয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এব্যাপারে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সামুদ্রিক) আ ক ম শফিকুজ্জামান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আগের অধ্যাদেশটি বাতিল করে এখন সম্পূর্ণ একটি আইন হয়েছে। আইনটি সংসদে পাশ হয়েছে। আইনটি গত ২৬ নভেম্বর গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেব।’ তিনি বলেন, ‘ভ্যাসেল মালিক, মেরিনাররা নতুন আইনের অসঙ্গতির কথা বলছেন। তারা তাদের বক্তব্য জানিয়েছেন। তারা যেহেতু মুল স্টেকহোল্ডার। যে কারণে তাদের বক্তব্য আমরা শুনেচি। তাদের পক্ষ থেকে একটি চিঠিও দেয়া হয়েছে। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। এর বাইরে কোন উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ আমাদের নেই।’