প্রত্যেক জাতির প্রায় অর্ধেক পুরুষ এবং অর্ধেক নারী। তাই নারী শিক্ষা সামাজিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। পুরুষ ও নারীর মৌলিক অধিকার সমান ও অভিন্ন। একুশ শতকে পদার্পণ করে বর্তমান বিশ্ব যেভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পালা বদলে অংশ নিচ্ছে নারী সেখানে এক অপরিহার্য অংশীদার, জীবনযুদ্ধের অন্যতম শরীক ও সাথী। কিন্তু আমাদের দেশের নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছে আর এই পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ সে নারী বলে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো ছেলে ও মেয়েকে পার্থক্যের চোখে দেখে। আর এই পার্থক্যের কারণেই আমাদের কোমলমতি মেয়েরা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। ছেলে ও মেয়েতে শুধু শরীরিক গঠনে পার্থক্য রয়েছে কিন্তু মেধায় ও সক্ষমতায় নয়। সামান্য সুযোগ-সুবিধা পেলেই আমাদের মেয়েরা হয়ে উঠে এক একটা নক্ষত্র। সমাজে এবং পরিবারে একটি ছেলে যে সুযোগ পায় একজন মেয়ের তা সমানভাবে পাওয়া উচিত।
একটা মেয়ে যদি শিক্ষিত হয় তাহলে তার পরিবার এমনকি সমাজের আমূল পরিবর্তন হয়। সবচেয়ে বড় সত্য কথা হলো মেয়েদের শিক্ষিত হতে হবে তার নিজের জন্য। তার নিজের পায়ের নীচের মাটি শক্ত করার জন্য। একটা মেয়ে যখন শিক্ষিত হবে, তখন তাকে সমাজ, পরিবার কেউই ছোট করে দেখতে পারবে না। আর এই জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, যেমন মেয়েদের উপবৃত্তি, অবৈতনিক শিক্ষা ইত্যাদি। কিন্তু এত সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমাদের মেয়েরা সামনে এগিয়ে যেতে পারে না ধর্মীয় গোড়ামী, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হওয়ার কারণে। আমরা যতই বলি আমরা আধুনিক জাতি কিন্তু আমাদের চিন্তা-চেতনা এখনও অনেক ক্ষেত্রে সেই মধ্যযুগের মত। উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য আমাদের মেয়েদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে দিতে হবে। তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা না হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।
বাঙালি নারীকে শিক্ষার অঙ্গনে নিয়ে আসার অগ্রদূত ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ। নারী শিক্ষা আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক নারী শিক্ষার আলো পেয়েছে ও স্বাবলম্বী হয়েছে। কিন্তু বাকি অর্ধেক এখনো অন্ধকারে পড়ে রয়েছে। অনেক মেয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও অকালে ঝরে পড়ে। এখনও বেশির ভাগ মেয়ে স্কুল থেকেই ঝরে যাচ্ছে আর এর প্রধান কারণ হলো অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া। অল্প বয়সে বিয়ের কারণে একটা মেয়ের মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি হয়। সে তখন এক প্রতিকূল পরিবেশে হাবুডুবু খেতে থাকে। তার দুরন্ত কৈশোর তার থেকে অনেক দূরে চলে যায়। সে জীবনে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অল্প বয়সে বিয়ের পর খুব কম মেয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পায়। এসব মেয়েদের বাবা-মা’রা মেয়ের বিয়েকে তাদের মেয়ের ভবিষ্যত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার উপায় মনে করেন। তাদের এই ধারণা মারাত্নক ভুল। শিক্ষাবঞ্চিত অকালে বিয়ে হওয়া মেয়েটি স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ হারিয়ে একজন অসহায় এবং অবহেলিত নারীতে পরিণত হয়। অল্প বয়সে বিয়ে ও মা হওয়ার কারণে ভগ্নস্বাস্থ্য ও হতশ্রী নারী যেন ব্যর্থ জীবনের প্রতিমূর্তি।
পরিবারে যখন একটি মেয়ে শিশু জন্ম গ্রহণ করে তখন থেকেই পরিবার এবং সমাজ তাকে শিখায় সে একজন মেয়ে, তার মানে একজন ছেলের সাথে তার পার্থক্য রয়েছে। সে মেয়ে বলে সব কিছু করতে পারবে না। অধিকাংশ বাবা মা’ই মেয়ের তাড়াতাড়ি বিয়ে হবে এটাই মনে করে থাকে। যার কারণে তারা মেয়ের লেখাপড়ার চেয়ে ছেলের লেখাপড়ার দিকে বেশী দৃষ্টি দিয়ে থাকেন। অধিকাংশ মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার একটি যুক্তি সবসময় শোনা যায় যে, ভাল একটি পাত্র পাওয়া যাচ্ছে। এমন ভাল পাত্রের সাথে বিয়ের সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। কিন্তু প্রকৃত সত্যি হচ্ছে একজন নারী যদি শিক্ষিত হয় তাহলে এই রকম সুযোগ্য ছেলে সে পড়াশোনা শেষ করেও পাবে এবং সে তখন অনেক ভালো থাকবে। কারণ আমাদের সমাজে চাকরিজীবী ও স্বাবলম্বী মেয়ের কদর আছে।
এই জন্য প্রত্যেক মা’র উচিত তার মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করা। কারণ মেয়েরা প্রাকৃতিক ভাবে একটু দুর্বল থাকে। সেই জন্য একজন মেয়ের শিক্ষিত স্বাবলম্বী হওয়া খুব জরুরি। মেয়ে শিক্ষিত হলে সে অবশ্যই চাকুরি ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে স্বাবলম্বী হবে। আর এটা তার পরিবারের জন্য খুব প্রয়োজন। এছাড়া পরিবারের মা যদি শিক্ষিত হয় তাহলে সে তার সন্তান-কে ভালোভাবে বড় করতে পারে। পরিবার এবং সমাজকে অর্থনৈতিক ভাবেও সহযোগিতা করতে পারে।
অনেক সময় বিভিন্ন কারণে বিয়ের সম্পর্কগুলি স্থায়ী হয়না। সেখানেও দেখা যায় পরিবার ও সমাজ মেয়েকে দোষ দেয়। এর ফলে সে সবার কাছে বোঝা হয়ে উঠে। কিন্তুু নারী যদি শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হয় সে তার মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ করতে পারবে এবং পরিবার ও সমাজের বোঝা হবে না। অন্যের দিকে তাকে চেয়ে থাকতে হবে না।
নারী’কে সামনে এগিয়ে যেতে একটু সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। এ সহযোগিতা পেলে আমরা নারীরা নিজ শক্তি বলে জ্বলে উঠতে পারি। তাই বলতে চাই অল্প বয়সে বিয়ে নয়, আমরা পড়তে চাই, আমরাই হব ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিকা, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, সাংবাদিক এমনকি নারী উদ্যোক্তা। বর্তমান যুগে দেখা যায় যে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অনেকাংশে এগিয়ে আছে। শুধু শিক্ষা নয় অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রেও এখন মেয়েরা ছেলেদের পাশাপাশি সমান তালে তাল মিলিয়ে চলছে। এক্ষেত্রে দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, সকল নারী যেন সঠিকভাবে পড়াশোনা করার সুযোগ পায় তার জন্য পরিবার এবং সমাজকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। মেয়ে বলে তাকে যেন অবহেলা না করা হয় সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। মেয়েদের জন্য সমান সুযোগ তৈরী করলে শিক্ষিত, স্বাবলম্বী, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল নারীরা একটি সমৃদ্ধ ও সুখী সমাজ গঠন করবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী