বেশিরভাগ পরিবারে মূল উপার্জনকারীরা পুরুষ। তাই পুরুষদের অসুখ-বিসুখে দ্রুত ডাক্তার দেখানো হয়। মেয়েদের অসুখের কথা পরিবার তেমন আমলে নেয় না। বিশেষ করে শ্বশুরবাড়িতে। আবার অনেকসময় দেখা যায় বেশিরভাগ একক পরিবারে মেয়েরা সারাদিন সংসারের কাজ করতে গিয়ে, স্বামী সন্তানের কথা ভাবতে গিয়ে, নিজের প্রতি খেয়াল-ই রাখে না। আমাদের দেশে নারীর অগ্রগতির হার বাড়লেও এখনো পর্যন্ত নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার পরিবার, সরকার, কারো জোর নেই বললেই চলে। কিছুদিন আগে একটা ঘটনা দেখে আমার চোখে জল ধরে রাখতে পারিনি।এখনো একা বসলে আমাকে খুব ভাবায়। আমি হাসপাতালে ভর্তি হবার আটদিন পর অনেকটা সুস্থ। অনেকদিন পর মনে হলো আমি নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। আমি আরো বাঁচবো। হাসপাতালে যাবার ছয়দিন আগে, পরিচিত ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবন করেছি। অসুস্থতা বেড়ে গেলে আমি হাসপাতালে ভর্তি হই। তার আগে স্কয়ার হাসপাতালে ডাক্তারের দেয়া টেস্ট করিয়ে জানতে পারি আমার করোনা পজেটিভ। আমার যেহেতু সবগুলো টেস্ট করা ছিল তাই যাওয়ার সাথে সাথে আমার চিকিৎসা শুরু হয়ে যায়। সকাল দশটায় নার্স, ডাক্তার দেখতে আসলেন আমাকে। এখন শরীরের অবস্থা কেমন? করোনা টেস্ট করিয়েছেন? বললাম ভালো। হ্যাঁ, নেগেটিভ এসেছে। আমাকে কখন ছাড়বেন? ডাক্তার বললেন, সুস্থ হলে চলে যাবেন.. আপনাকে জোর করে রেখে দেবোনা বলে একটা হাসি দিলেন। একটু পর পাশের রুমে হৈচৈ পড়ে গেল। নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন, খুব খারাপ অবস্থা! অঙিজেন নেয়ারও শক্তি নেই। ডাক্তার, নার্সরা বলছেন অনেক দেরি করে ফেলেছেন। তাতে স্বামীর কোন আক্ষেপ নেই, বললেন, দেরি হয়েছে তো কি হয়েছে! আপনারা আছেন কিসের জন্যে, চিকিৎসা শুরু করুন। নার্স অঙিজেন দিয়ে চলে গেলেন।আগে টেস্ট করাতে হবে। রিপোর্ট আসার পর চিকিৎসা শুরু করবেন। তবে জ্বর, কাশির ওষুধ দিয়ে গেছেন। আমি আস্তে আস্তে গেলাম দেখতে।দূর থেকে দেখছি। খুব কম বয়সী একটা মেয়ে। বয়স বাইশ তেইশ হবে। ছোট একটা বাচ্চা বাসায় রেখে এসেছে। অভিমানী চেহারা নিয়ে শুয়ে আছে। মুখে কোন কথা নেই,চোখ দিয়ে টপ টপ পানি ঝরছে।যেন বলছে আমাকে বাঁচাও, আমার কিছু হয়ে গেলে আমার ছোট্ট বাচ্চাটাকে কে দেখবে! একজন মায়ের আকুতি দেখতে পাচ্ছি তাঁর চোখে মুখে! আমার ছেলের জন্য বাঁচতে চাই! নাম পারভীন। ছয়দিন ধরে খুব জ্বর আর কাশি নিয়ে বাচ্চা দেখা থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজ করেছে।শুরু থেকেই স্বামীকে বলেছে আমার ১০৩/৪ ডিগ্রি জ্বর, খুব খারাপ লাগছে! আমাকে একটু ডাক্তার দেখাও। তাঁর স্বামী বলেছে সব ঘরে ঘরে জ্বর হচ্ছে, সবাই কি ডাক্তারের কাছে দৌড়াচ্ছে? এইস আর কাশির ওষুধ খাও কমে যাবে। সাতদিনের দিন দেখে সে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না! তাও তাকে ডাক্তারের কাছে নেয়নি! নয় দিনের দিন সকালে তাকে নিয়ে যায় হাসপাতালে।তখন তার অঙিজেন লেভেল খুবই কম।এতোক্ষন আমি সাথে আসা খালার সাথে দূরত্ব রেখেই কথা বলছিলাম। বললেন, আমি জানলাম কাল রাতে। পারভীন তখন কাশির জন্য আমার সাথে ভালো করে কথাও বলতে পারছে না! একজন নার্স এসে আমাকে বললেন আপা, এভাবে আপনার দাঁড়ানো ঠিক না। আপনি আপনার জায়গায় চলে যান।এই কয়দিনে তাঁদের সাথে একটা খুব সুন্দর সম্পর্ক হয়েছে আমার। আমি গিয়ে আমার বেডে শুয়ে পড়লাম। একঘন্টা পর খালার চিৎকার, চলে গেলি তুই! চলে গেলি! হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠি।
একজন নারী অবহেলার কারণে অকালে ঝরে গেলো? একটা শেষ নিঃশ্বাস এক সেকেন্ডের ব্যাপার।কে বলতে পারে কখন কার মৃত্যু হবে! ঐ নারীর মৃত্যু হলেও হয়তো তাঁর আত্মা থেকে গেছে তাঁর জন্ম দেয়া বাচ্চাটার কাছে।আমি কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছি না! একটু আগে দেখে আসা মেয়েটার এতো তাড়াতাড়ি প্রাণ যেতে পারে! হয়তো দুইদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করালে মেয়েটা বেঁচে যেতো। লেখাটা লেখার উদ্দেশ্য হলো, নারীরা যাতে জ্বর, কাশি বা অন্য কোন অসুস্থতায় ভুগলে, যখন বুঝতে পারবে স্বাস্থ্য খারাপের দিকে যাচ্ছে, দেরি না করে পরিবার বা আত্মীয় স্বজনের সাহায্যে নিয়ে যেন হাসপাতালে ভর্তি হন এবং সুস্থ জীবন নিয়ে বাসায় ফিরে যান। একজন স্বামীই হলো একজন নারীর শক্তি। যৌথ-পরিবারে একজন স্বামী নারীর দেখাশুনা না করলেও পরিবারের অন্যরা খেয়াল রাখতেন আগেকার দিনে। ভাগাভাগি করে কাজ করতেন বলে তেমন কাজের চাপও পড়তো না। এখন একক পরিবার। বলা বাহুল্য, একজন নারীর ওপরেই নির্ভর করে পরিবার আর সন্তানের দেখাশুনা। রাতের ঘুম ছাড়া পুরোটা সময় ব্যয় করে সংসারের জন্য একটু সুখ-শান্তির আশায়। তাই সবার আগে একজন স্বামীকেই এগিয়ে আসা উচিত নারীর সহযোগিতায়।