সারা বিশ্বজুড়ে শান্তি, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব, মানবতাবাদ আর গণতন্ত্রের এক মূর্ত প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার এই রাষ্ট্রপিতা বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষের কাছে জীবন্ত কিংবদন্তী হিসেবে নন্দিত হয়েছেন। সাদা-কালোর তফাত ঘুচিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাঁর অসাধারণ ত্যাগ আর নেতৃত্ব সারা বিশ্বের মানুষকে প্রভাবিত করেছে। ম্যান্ডেলা পরিণত হয়েছেন বিশ্ব শান্তির এক প্রতীকে, হয়ে উঠেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী। আজ তাঁর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী।দক্ষিণ আফ্রিকার উমতাতু প্রদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্ম নেলসন ম্যান্ডেলার। সকলে তাঁকে ডাকতো ‘রোরিলালা’ নামে, স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ ‘উপদ্রবকারী’। এই ‘রোরিলালা’ই একদিন হয়ে ওঠেন ‘মাদিবা’ সকলের ‘বন্ধু’। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে ১৯২৫ সালে ম্যান্ডেলার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। তরুণ বয়সে চলে যান জোহানেসবার্গে এবং আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেন উইটওয়াটারস্ট্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৪৩ সালে ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগ দেন। তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় চলছে তীব্র বর্ণবাদী শাসন। কালোরা ছিল ক্রীতদাস। মানুষে মানুষে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন গড়ে তোলেন তরুণ নেলসন ম্যান্ডেলা। ক্রমে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়। ম্যান্ডেলার ওপর চলে বর্বর, নির্মম নির্যাতন। বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠী ম্যান্ডেলাকে রবেন দ্বীপের কুখ্যাত নির্জন কারাগারে আটকে রাখে ২৭ বছর। তাঁর ওপর চরম নির্যাতন চালায়। আর কারাগারে সশ্রম কারাদণ্ডে বন্দি ম্যান্ডেলার স্বপ্ন পূরণে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহ। নিজেদের মুক্তির জন্য বিদ্রোহে অংশ নিয়ে অকাতরে প্রাণ দিতে থাকে কালো মানুষেরা। কারাগারে মান্ডেলা ছিলেন সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত ডি গ্রুপের বন্দি। উপরন্তু তাঁদের দিয়ে চুনাপাথরের খনিতে শ্রমিকের কাজ করানো হতো। হাড়ভাঙা খাটুনির এই কাজটি ছিল স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় ২৭ বছর কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের গণআন্দোলন, রক্তক্ষয় এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আফ্রিকান সরকার ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেয়। মুক্তির পর দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন মানবতাবাদী এই নেতা। বর্ণবাদী সরকারের সাথে নতুন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু হয় আলোচনা যেখানে বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবার সমানাধিকার থাকবে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ম্যান্ডেলার এই নেতৃত্বকে সম্মান জানাতে ১৯৯৩ সালে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে ম্যান্ডেলার জন্মদিনকে ‘ম্যান্ডেলা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশে আসেন। দ্বিতীয়বারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেননি। সদা হাস্যময়, অমায়িক, বিশ্ব মানবের অনুপ্রেরণা নেলসন ম্যান্ডেলা প্রয়াত হন ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর।