আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের গতি বাড়লেও চট্টগ্রাম কাস্টমস ল্যাবের (রাসায়নিক পরীক্ষাগার) সক্ষমতা বাড়েনি। এখনো সেকেলে যন্ত্রপাতি দিয়ে একপ্রকার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ল্যাবের কার্যক্রম। এছাড়া মাত্র একজন রাসায়নিক পরীক্ষক এবং একজন সহকারী রাসায়নিক পরীক্ষক বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষণের দায়িত্বে আছেন। যা বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় একবারেই নগণ্য। রাসায়নিক পরীক্ষক সংকটে আমদানি পণ্যের নমুনা পরীক্ষায় জট লেগে আছে। আবার যন্ত্রপাতি সংকটের কারণেও অনেক পরীক্ষায় ঢাকার ওপর নির্ভর করতে হয়। অনেক সময় একেক ল্যাবের একেক ধরনের পরীক্ষার কারণেও পণ্য যাচাই প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হয়। তাই কাস্টমসের ল্যাব আধুনিকায়ন এবং জনবল নিয়োগের মাধ্যমে সেবার মান বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা। এদিকে জনবল না বাড়ানো পর্যন্ত কাস্টমসের ল্যাবে আমদানিতকৃত ফলের ফরমালিন পরীক্ষা বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি লিখেছেন চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার। সম্প্রতি পাঠানো সেই চিঠিতে বলা হয়, ‘বেনাপোল, সোনা মসজিদ, ভোমরাসহ বিভিন্ন স্থল বন্দর দিয়ে আসা ফলের ক্ষেত্রে ফরমালিন পরীক্ষা করা হচ্ছে না। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা বিদেশী ফলের নমুনা পরীক্ষায় দেখা যায়, অধিকাংশ ফলে ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া যায় না। আবার ফলের ফরমালিন পরীক্ষা করতে গেলে অন্য নমুনার পরীক্ষায় প্রভাব পড়ছে। অন্যদিকে জনবল সংকটের কারণে সঠিক সময়ে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া যায় না, এতে পণ্য খালাসে বিলম্ব হয়। এছাড়া ল্যাবে আসা বিভিন্ন নমুনার বিপরীতে গড়ে ৩০ শতাংশ পণ্য মিথ্যা ঘোষণা শনাক্ত হয়। রাসায়নিক পরীক্ষাগারে জনবল বৃদ্ধি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপিত হলে আরও অধিক সংখ্যক নমুনা এই কাস্টমসের ল্যাবে করা সম্ভব হবে। ফলে আরো বেশি মিথ্যা ঘোষণার পণ্য শনাক্ত হবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, আমদানি পণ্য বন্দর থেকে খালাসের আগে ক্ষেত্র বিশেষে নমুনা পরীক্ষা করতে হয়।
রাসায়নিক পরীক্ষকরা ঘোষণা অনুযায়ী পণ্যের গুণগতমান ঠিক আছে কিনা সেটি পরীক্ষা করে দেখেন। কেবল রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট সন্তোষজনক হলেই খালাসের অনুমতি মেলে। আবার কোনো আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য নিয়ে এলে নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদনে পরীক্ষকরা সেই পণ্যের যথাযথ শুল্কায়নের জন্য সুপারিশ করে থাকেন।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ল্যাবে বিদ্যমান জনবল কাঠামোতে ১৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ৫ জন। এছাড়া কাঠামোর বাইরে দু’জনকে ‘ঊর্ধ্বতন সহকারী পরীক্ষক’ পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এরমধ্যে বর্তমানে আছেন মাত্র একজন। অথচ জনবল কাঠামো অনুযায়ী একজন প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক এবং ৩ জন উপ-প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষকের পদ ল্যাবের কার্যক্রম শুরু থেকেই শূণ্য রয়েছে। বর্তমানে দুইজন রাসায়নিক পরীক্ষকের মধ্যে আছেন একজন। এছাড়া ৬ জন সহকারী রাসায়নিক পরীক্ষকের মধ্যেও আছেন একজন। জনবল কাঠামো অনুযায়ী ৩ জন ল্যাব এটেন্ডেন্ট থাকলেও আবার পিয়ন নাই। ফলে প্রতিদিন ল্যাবে যে পরিমাণ পণ্যের নমুনা এসে জমা হচ্ছে, সেইসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেই রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে পরীক্ষকদের।
ল্যাবের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ল্যাবে প্রতিদিন গড়ে বিভিন্ন পণ্যের শতাধিক নমুনা আসে। এই বিশাল পরিমাণ নমুনা পরীক্ষা করতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরীক্ষকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এছাড়া অনেক নমুনার পরীক্ষা আবারও দ্রুত করে দিতে হয়। বর্তমানে যে অবস্থা এতে অন্তত ১০ জন রাসায়নিক পরীক্ষক দরকার। এছাড়া যন্ত্রপাতিরও সংকট আছে। যদিও বিভিন্ন সময় ল্যাবে ৬টি আধুনিক যন্ত্র এসেছে, কিন্তু কিছু কিছু যন্ত্রাংশের অপ্রতুলতার কারণে তা চালু করা যায়নি। ল্যাবে আসা নতুন মেশিন ছয়টি হচ্ছে-ইউভি-ভিস স্পেক্ট্রেফটোমিটার, হাইপারফরম্যান্স লিকুইড ক্রমোটোগ্রাফি (এইচপিএলসি) এবং গ্যাস ক্রমোটোগ্রাফি, মেটালর্জিক্যাল মাইক্রোস্কোপ, কোলটার ময়েশ্চার অ্যানাইলাইজার এবং সেমি অটোমেটেড ফোর্স টেনশমিটার। অন্যদিকে ল্যাবে ফ্লেইম ফটোমিটার, ভিসকোমিটার, এক্সরে ক্রিসটালোগ্রাফি, ফ্রিজিং পয়েন্ট অ্যাপারেটাস, নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রিজোন্যান্স (এনএমআর), ইন্ডাক্টিভলি কাপল্ড প্লাজমা ইমিশন স্পেকট্রোসকপি, ইউনিভর্সাল টেস্টিং মেশিন ফর মেটাল ও সুপারক্রিটিক্যাল ফ্লুইড ক্রোমেটোগ্রাফির মতো আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। ফলে অনেক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা বাইরের ল্যাবের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে পণ্য খালাসে বিলম্ব হয়।
বন্দরের সেবাগ্রহীতারা জানান, সময়ের সাথে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে অথচ কাস্টম হাউজের ল্যাবটি চলছে সেই মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে। ল্যাবে রাসায়নিক পরীক্ষক সংকটের কারণে একদিনে যে পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা, তা শেষ হতে এক সপ্তাহও লেগে যায়। আবার অনেক পরীক্ষার জন্য ঢাকার উপর নির্ভর করতে হয়। কাস্টমসের ল্যাবটি স্বয়ংসম্পূর্ণ করা সম্ভব হলে দ্রুত পণ্য খালাস হতো। এখন শুধুমাত্র নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টের জন্য ব্যবসায়ীদের সময়ক্ষেপণ হয় এবং ব্যবসায়ীদের পোর্ট ডেমারেজ দিতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার মো. ফখরুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ল্যাবের জনবল এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির বিষয়ে আমি গত মাসেও এনবিআরে চিঠি লিখেছি। প্রত্যেক শুল্ক স্টেশনে রাসায়নিক পরীক্ষাগার ও পদ সৃষ্টির জন্য মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সেই নির্দেশনার প্রায় ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের কোনো স্থল ও সমুদ্র বন্দরে নতুন করে রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপিত হয়নি। বিশেষ করে বর্তমানে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ল্যাবে জনবল সংকটের কারণে ল্যাবের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিষয়টি আমরা এনবিআরকে অবহিত করেছি।