চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্ন বিভাগের দাবি, মশক নিধনে প্রতি ওয়ার্ডে দৈনিক চারজন পরিচ্ছন্নকর্মী ওষুধ ছিটান। অথচ সাধারণ লোকজন বলছেন, ওষুধ ছিটাতে তারা দেখেন না। অতীতে স্থানীয় কাউন্সিলরগণ ওয়ার্ড পর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রম তদারকি করতেন। কিন্তু গত চার মাস ধরে কাউন্সিলর না থাকায় মনিটরিংয়ের অভাবে এ কার্যক্রম গতি পাচ্ছে না বলে মনে করছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ বলছেন, চসিকের দাবি সত্য হলেও মশার উৎপাত কমছে না কেন। তবে কি ‘অকার্যকর’ ওষুধ ছিটনো হচ্ছে? এ অবস্থায় স্টোরে থাকা ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে চসিক।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘রাতে মশা দিনে মাছি, দুই তাড়িয়ে কলকাতায় আছি’। তৎকালীন সময়ে মশা-মাছির অত্যাচারে অতিষ্ঠ কলকাতাবাসীর দুঃখ কিছুটা হলে ফুটে ওঠে বাঙালি কবির এ ছড়ায়। ১৮৯ বছর পর এসে চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দাদের কষ্ট যেন কলকাতার চেয়েও বেড়েছে। কারণ, এখানে শুধু রাতে নয়। বরং দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা সমানতালে কামড়াচ্ছে মশা। সকাল-সন্ধ্যা বাসা-বাড়ি, দোকানপাট, অফিস-আদালত সবখানেই ‘গুনগুন’ ধ্বনিতে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে মশা। অথচ বরাবরই মশক নিধনে সিটি কর্পোরেশন নানা কর্মকাণ্ডের দাবি করেই যাচ্ছে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ নভেম্বর মশক নিধন কার্যক্রমের আওতায় মশার প্রজনন রোধে নগরে খাল পরিষ্কার কর্মসূচি শুরু করে চসিক। একদিন পর ৬ নভেম্বর মাস্টার পোল এলাকা থেকে ওষুধ ছিটানোর আরেকটি কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। সংস্থাটির পরিচ্ছন্ন বিভাগের দাবি, প্রতিটি ওয়ার্ডকে চারটি জোনে ভাগ করে প্রতিদিন ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। পরবর্তীতে ১১ নভেম্বর মশক নিধন কার্যক্রম তদারকির জন্য আট সদস্যের মনিটরিং সেলও গঠন করে সংস্থাটি। এতকিছুর পরেও মশক নিয়ন্ত্রণে সাফল্য নেই বললেই চলে। তবে কি ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে সাধারণ মানুষের সন্দেহই সত্যি? নাকি দাবি করলেও বাস্তবে ওষুধ ছিটানোয় গতি নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে মশক নিধনের ওষুধ সংগ্রহ করে চসিক। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনও ওষুধ সংগ্রহ করত। গত বছর ঢাকায় ছিটানো ওষুধ পরীক্ষা করে ‘অকার্যকর’ বলেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি)। ফলে ঢাকায় ‘অকার্যকর’ ঘোষিত ওষুধ চট্টগ্রামে কতটা কার্যকর হবে সেটা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ওঠে। অবশ্য চসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বরাবরই দাবি করেন, কয়েক দফা পরীক্ষা শেষে সরবরাহকৃত ওষুধ স্টোরে ঢোকানো হয়। তাই অকার্যকর হওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে এ বছর মশার উৎপাত না কমায় পরীক্ষার জন্য গত সোমবার বিসিএসআইআর (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ) গবেষণাগার চট্টগ্রামে আধা লিটার করে লার্ভিসাইড (মশার ডিম ধ্বংসকারী ওষুধ) এবং এডালটিসাইড (পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসকারী) প্রেরণ করে। তবে গতকাল মঙ্গলবার সংস্থাটি চসিককে জানায়, মশার ওষুধের গুণগত মান তাদের ল্যাবে পরীক্ষা করা হয় না। বিসিএসআইআর গবেষণাগার থেকে জবাব পেয়ে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়েরে সাথে যোগাযোগ করে চসিক।
মশক নিধন কার্যক্রম সম্পর্কে চসিকের গঠিত মনিটরিং সেলের আহ্বায়ক ও সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক আজাদীকে বলেন, প্রতিদিন ওষুধ ছিটনো হচ্ছে। আবার এক লোকের পক্ষে প্রতিদিন একই জায়গায় ওষুধ ছিটানো হয়ত কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্ভব না। তাই কোথাও কোথাও একটু স্লো (ধীরগতি) হতে পারে। সেখানে মনিটরিংয়ের গ্যাপও হতে পারে। আমরাও লক্ষ্য করেছি মশার উপদ্রব একটু বেড়েছে। মশার ওষুধের এফেক্টিভনেস (কার্যকারিতা) সম্পর্কেও একটি পরীক্ষা করব। এ জন্য বিসিএসআইআর সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়েছি। কিন্তু তারা বলেছে পরীক্ষা করার মতো সক্ষমতা তাদের নেই। এখন ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে করার চেষ্টা করছি।
এদিকে শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, খাল ও নালা-নর্দমায় কিলবিল করছে মশার লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা। মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, বহদ্দারহটসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে খাল-নালায় বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে পানি চলাচল বন্ধ হয়ে স্থির রয়েছে। এসব স্থির বা আবদ্ধ পানিতেই বেশি কিলবিল করতে দেখা গেছে। বাকলিয়া থানাধীন আফগান মসজিদ এলাকা, কোতোয়ালী থানাধীন ঘাটফরহাদবেগ আতরজান মসজিদ এলাকা, চেরাগী পাহাড়, জামালখান, রহমতগঞ্জ, মোহাম্মদপুর, লাভলেইন, আতুরার ডিপো, এনায়েত বাজার গোয়ালপাড়া, দামপাড়া এক নম্বর গলি, হেমসেন লেইন, কাপাসগোলা, আসকারদিঘিসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত কয়েক মাসেও সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে ওষুধ ছিটাতে দেখেননি।
শিহাব উদ্দিন নামে ঘাটফরহাদবেগ এলাকার এক বাসিন্দা জানান, কাউন্সিলর না থাকায় মনিটরিং ঠিকভাবে হচ্ছে না। সে কারণে ওষুধ ছিটানোয় গতি নেই। পরিচ্ছন্নকর্মীরা কাজে ফাঁকি দিলেও সেটা দেখভালেরও কেউ নেই। কারণ মাঠপর্যায়ের কর্মীদের যে সুপারভাইজার তদারকি করেন তারাও পরিচ্ছন্ন বিভাগের। তাই কর্মীরা অবহেলা করেও রেহাই পাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন খাল-নালায় বদ্ধ পাানিতে দুয়েকদিনের মধ্যে কালো তেল ছিটানোর কার্যক্রম শুরু হবে। এ লক্ষ্যে ১৫ হাজার লিটার কালোতেল (এলডিও ও এইচএসডি) সংগ্রহে সম্প্রতি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে গতকাল ২০ ড্রাম কালোতেল চসিকে সরবরাহ করেছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল।